উপায়নগদবিকাশমোবাইল ব্যাংকিংরকেট

মোবাইল ব্যাংকিং এর আদ্যোপান্ত

মোবাইল ব্যাংকিং, একুশ শতকে এসে শব্দ দুটি প্রায় সবারই পরিচিত। বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং শুরু হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে এক দশক। বর্তমানে শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলেও অসংখ্য মানুষ প্রতিনিয়ত এই সেবা নিচ্ছে। দৈনন্দিন অথবা জরুরী প্রয়োজনে দেশের মানুষের কাজে আসছে মোবাইল হ্যান্ডসেট ভিত্তিক এই বিশেষ সেবাটি। বর্তমানে দেশে অনেক যুবকের কর্ম-সংস্থান হিসেবেও স্থান করে নিয়েছে এই মোবাইল ব্যাংকিং। করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে মোবাইল ব্যাংকিং যে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে তা ইতোমধ্যে পরিষ্কার। আর তার সাথে তাল মেলাতে হলে জানা চাই মোবাইল ব্যাংকিং এর আদ্যোপান্ত।

সূচিপত্রঃ

মোবাইল ব্যাংকিং কি?

মোবাইল ব্যাংকিং হলো সম্পূর্ণ মোবাইল ভিত্তিক একটি আর্থিক লেনদেন প্রক্রিয়া যার সাহায্যে গ্রাহক তার মোবাইলের মাধ্যমে দৈনন্দিন লেনদেন সম্পন্ন করতে পারে ও অন্যান্য আর্থিক পরিষেবার সুবিধা ভোগ করতে পারে। 

এ সমস্ত পরিষেবার মধ্যে আছে মোবাইল রিচার্জ, দাম পরিশোধ, বিল প্রদান, টাকা পাঠানো, টাকা তোলা, বিদেশ থেকে রেমিটেন্স গ্রহণ সহ আরো নানা কিছু। কোম্পানি ভেদে যার নানা রকমফের রয়েছে। সাধারণত মোবাইল ব্যাংকিং সেবা গুলো বড় বড় ব্যাংক এর অধীনে থাকে। তারা এসএমএস বা মোবাইল অ্যাপ দুই ভাবেই এ সকল সেবা পরিচালনা করে থাকে।

মোবাইল ব্যাংকিং এর ইতিহাস 

মোবাইল ব্যাংকিং এর পথ চলার সময়টুকু বেশ লম্বা। যদিও মোবাইল ব্যাংকিং এর প্রথম যুগের সেবার সাথে বর্তমান সেবার রয়েছে আকাশ পাতাল তফাত। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা নিয়ে আসে ইউরোপীয় ব্যাংক গুলো। এ সেবায় প্রথিকৃত ছিল জার্মানি ও নরওয়ে। প্রথম দিকে একাউন্টে অর্থের পরিমাণ ও পূর্ববর্তী লেনদেন গুলো দেখার মধ্যেই অনেকটা সীমাবদ্ধ ছিল এ সেবা। ১৯৯৯ সালে মূলত এসএমএস এর সাহায্যে শুরু হয় এর যাত্রা। তাই অনেকেই এটিকে ‘এসএমএস ব্যাংকিং’ নামেও অভিহিত করতেন। কিন্তু সময়ের স্রোতে প্রযুক্তির হাত ধরে বাড়তে থাকে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মান। সে সময়ে এই সেবা সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশ গুলোতে। 

২০০২ সালেই এস কে টেলিকম দক্ষিণ কোরিয়াতে অবলাল রশ্মি ভিত্তিক মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে। যদিও তা সফলতার মুখ দেখে নি কিন্ত তারই ধারাবাহিকতায় এল জি টেলিকম আইসি চিপ (IC Chip) ভিত্তিক মোবাইল ব্যাংকিং বাজারে আনে। অপর দিকে ২০০৪ সালে জাপানের NTT DoCoMo ফেলিকার আইসি চিপ ব্যবহার শুরু করলে তা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০০৬-০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম Wachovia ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং শুরু করে। মাত্র ৬ মাসের মধ্যে তাদের মোবাইল ব্যাংকিং এর গ্রাহক সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় ৫ লক্ষ। অতঃপর ২০০৯ ও ২০১০ সালে আসে যুগান্তকারী পরিবর্তন। সে সময়ে যথাক্রমে অ্যাপলের আইফোন ও এন্ড্রয়েড ভিত্তিক মোবাইলের জন্য মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপ নির্মাণ শুরু হয়। যদিও সেসব অ্যাপের কার্যক্রম ছিল বেশ সীমিত। কিন্তু সেখান থেকেই এক যুগের পথ পাড়ি দিয়ে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে বৈশ্বিক মোবাইল ব্যাংকিং।

বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং এর সূচনা

মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম

বাংলাদেশে প্রথম মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু হয় ২০১১ সালের ৩০শে মার্চ। ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড এর হাত ধরে প্রথম এ দেশে মোবাইল ব্যাংকিং চালু হয়। শুরুটা কিন্তু খুব বড় ছিল না। প্রথম দিকে মাত্র দুটি সিম অপারেটর এর সাহায্যে এই সেবা নেওয়া যেত। সেগুলো হল বাংলালিংক ও সিটিসেল। এর উদ্বোধন হয়েছিল স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংক এর তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানের হাত ধরে। ডাচ-বাংলা ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং এর প্রথম লেনদেন ছিল আতিউর রহমানের ২০০০ টাকা জমা ও ১৫০০ টাকা উঠানো। ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মতে তাদের লক্ষ্য ছিল এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ব্যাংকিং সেবা ছড়িয়ে দেওয়া। সে উদ্দেশ্যে তারা সফল হয়েছে তা বলাই বাহুল্য।

২০১১ সালে ডাচ-বাংলা ব্যাংক প্রথম মোবাইল ব্যাংকিং শুরু করলেও ২০১২ সালে মোট ১০টি ব্যাংক এ সেবা দেওয়া শুরু করে। যদিও গ্রাহক সংখ্যার বিবেচনায় ডাচ-বাংলা ও ব্র্যাক ব্যাংক এর অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান বিকাশ ছিল অন্য ব্যাংক গুলো থেকে যোজন যোজন এগিয়ে। এছাড়া এই ১০টি ব্যাংক বাদেও শুধু আন্তর্জাতিক রেমিটেন্স লেনদেনের অনুমতি ছিল আরো ৭টি ব্যাংকের। আর প্রায় ১ দশক পরে আজকের দিনে বাংলাদেশের প্রতিটি পাড়া মহল্লাতেই কোন না কোন মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট অবস্থান করছেন। সেবা দিয়ে যাচ্ছেন অবিরত।

বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং সমূহ

বর্তমানে বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে প্রায় ১৫টি প্রতিষ্ঠান। যদিও এর মধ্যে অনেক গুলোই দেশের মানুষের কাছে অপরিচিত। তাই লেখার এই অংশে আমরা বেশ কিছু মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। এতে করে আপনি আপনার লেনদেনের জন্য একমুখী না থেকে সুবিধামত বহুমুখী হতে পারবেন। 

বিকাশ

ব্র্যাক ব্যাংক এর অঙ্গসংগঠন মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস বিকাশ
ক্রেডিটঃ বিকাশ

বিকাশ বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে পরিচিত নাম। ব্র্যাক ব্যাংক এর এই অঙ্গপ্রতিষ্ঠানটি দেশের সর্ববৃহৎ মোবাইল ব্যাংকিং সেবাতে পরিণত হয়েছে। এর গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি। বিশেষত বিকাশ একাউন্ট খোলার নিয়ম আরো সহজ করে দেওয়ায় গ্রাহক সংখ্যা বেড়েছে অনেক বেশি। অনেক মানুষের কাছে মোবাইল ব্যাংকিং মানেই এখনো শুধুই বিকাশ। সেবার দিক দিয়ে এটি তার যেকোনো প্রতিযোগী থেকে এগিয়ে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু উচ্চ চার্জ এর কারণে বর্তমানে এর জনপ্রিয়তায় সামান্য হলেও ভাটা পড়েছে। তবে এই অ্যাপটির সাহায্যে সাধারণ লেনদেনের বাইরেও মূল ব্যাংক থেকে টাকা লেনদেন ও রেমিটেন্স লেনদেন করতে পারবেন সহজেই। 

রকেট

ডাচ বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস রকেট
ক্রেডিটঃ রকেট

রকেট মূলত ডাচ-বাংলা ব্যাংকের অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান। এই ব্যাংকিটিই দেশের প্রথম মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করেছিলো। সময়ের পরিক্রমায় সর্ববৃহৎ হতে না পারলেও দুই কোটি গ্রাহক নিয়ে প্রথম সারিতেই রয়েছে এটি। বিশেষত নানা রকমের বিল প্রদানের জন্য এটি এখনো অনেকের প্রথম পছন্দ। এছাড়াও দেশের অনেক পোশাক শিল্প-কারখানা গুলো তাদের কর্মীদের রকেটের মাধ্যমেই বেতন দিয়ে থাকে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শুধু রকেটের মাধ্যমেই টাকা পরিশোধ করতে হয়।

নগদ

ডাক বিভাগের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা নগদ
ক্রেডিটঃ নগদ

ইদানীংকালে সবচেয়ে জনপ্রিয় মোবাইল ব্যাংকিং সেবা হিসেবে নগদ এর নাম শোনা যাচ্ছে। মাত্র দুই বছর আগে ২০১৮ সালে এই সেবাটি চালু করে বাংলাদেশের ডাক বিভাগ। সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা হওয়ায় লাভ নিয়ে খুব মাথা ঘামাতে হয় না এটিকে। তাই বর্তমানে দেশে সর্বনিম্ন ক্যাশ আউট চার্জ হাজারে ৯.৯৯ টাকা করতে সক্ষম হয়েছে নগদ। এছাড়া তাদের সেবার মানও ভাল। ক্যাশ আউট চার্জ কম হওয়ায় বড় লেনদেন এখন অনেকেই নগদে করছেন। তাই অতি স্বল্প সময়েই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় পরিণত হয়েছে নগদ। বর্তমানে গ্রাহক রয়েছে আড়াই থেকে তিন কোটি, আর তাদের এই বিশালাকার গ্রাহকের অনেকাংশই তৈরি হয়েছে গ্রাহকদের ঘরে বসেই নিজের নগদ একাউন্ট খোলার সুবিধা দেওয়ার কারনে। ফলে অনেকটাই যেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে বিকাশকে। যদিও এখনো রেমিটেন্সের আদান-প্রদানের মতো কিছু সুবিধা নগদ এ নেই। তবে আশা করা যায় এসব সীমাবদ্ধতা তারা দ্রুতই কাটিয়ে উঠবে। 

এম ক্যাশ

ইসলামি ব্যাংক এর মোবাইল ব্যাংকিং সেবা এম ক্যাশ
ক্রেডিটঃ এম ক্যাশ

এম ক্যাশ হল ইসলামী ব্যাংক এর একটি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা। এই সেবাটি এম ক্যাশ অ্যাপের পাশাপাশি সেলফিন অ্যাপের সাহায্যেও নেওয়া যায়। শরীয়া সম্মত ব্যাংকিং সুবিধা যারা নিতে চান, তাদের অনেকেই এটি ব্যবহার করেন। ক্যাশ আউট চার্জের ক্ষেত্রে এটি একটু ব্যাতিক্রমী নিয়ম অনুসরণ করে। ১০ – ১০০০ টাকা ক্যাশ আউটের জন্য ১০ টাকা চার্জ। অপরদিকে ১০০১ – ২৫০০০ টাকা ক্যাশ আউটে চার্জ ১%।

ইউপে/উপায়

ইউসিবি ব্যাংক এর মোবাইল ব্যাংকিং সেবা উপায়
ক্রেডিটঃ উপায়

উপায় এর পূর্বের নাম হল ইউক্যাশ। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ২০১৩ সালে প্রথম ইউক্যাশ নামে এই সেবা দেওয়া শুরু করে। তবে কিছু দিন আগে নাম পরিবর্তন করে উপায় (UPAY) মোবাইল ব্যাংকিং নামে হাজির হয় অ্যাপটি। এই উপায় অ্যাপের সাহায্যে আপনি মোবাইল ব্যাংকিং এর পাশাপাশি ইউসিবি এর মূল ব্যাংকিং সেবাও বেশ কিছুটা নিতে পারবেন। প্রয়োজনে উপায় এর টাকা এটিএম থেকেও উঠাতে পারবেন। একই সাথে উপায় থেকে টাকা ইউসিবি অথবা অন্য কোন ব্যাংকের একাউন্টেও পাঠাতে পারবেন। এমনকি ক্রেডিট কার্ড এর বিল পরিশোধও করা যাবে উপায় থেকে, বিনামূল্যে। 

মাই ক্যাশ

মারকেন্টাইল ব্যাংক এর মোবাইল ব্যাংকিং সেবা মাই ক্যাশ
ক্রেডিটঃ মাই ক্যাশ

মার্কেন্টাইল ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা দিতে তৈরি করেছে মাই ক্যাশ এটির সাহায্যে আর ১০টি মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মতোই সাধারণ লেনদেন করা যায়। বিকাশের মত এটিরও ক্যাশ আউট চার্জ ১.৮৫%। এছাড়া ওয়াসা, ডেসকো সহ আরো নানা বিল দেওয়া যায়। বিলের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে চার্জ পরিবর্তিত হয়। মার্কেন্টাইল ব্যাংকে যাদের ডিপোজিট একাউন্ট আছে তারা মাই ক্যাশ এর সাহায্যেও ডিপোজিট করতে পারবেন।

টি ক্যাশ

ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা টি ক্যাশ
ক্রেডিটঃ টি ক্যাশ

ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড ‘ট্রাস্ট ব্যাংক মোবাইল মানি’ নামে একটি সেবা শুরু করে সেই ২০১০ সালে। যদিও তা কার্যকরী হয় নি। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে টি ক্যাশ নামক আরেকটি অ্যাপ উদ্ববোধন করে তারা। এই অ্যাপটিতে তিন ধরনের একাউন্ট খোলা যায়। ‘জেনারেল’ , ‘করপোরেট’ ও ‘স্টুডেন্ট’। তিন ধরনের একাউন্টের রয়েছে তিন ধরনের চার্জ। তবে এজেন্ট এর কাছ থেকে ৫০০০ টাকার বেশি ক্যাশ আউট করতে চাইলে এন আইডি কার্ড দেখানো বাধ্যতামূলক। 

শিওর ক্যাশ

শিওর ক্যাশ মোবাইল ব্যাংকিং সেবা
ক্রেডিটঃ শিওর ক্যাশ

উপরের সব কয়টি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা থেকে শিওর ক্যাশ কিছুটা ব্যাতিক্রমী। কারণ এটি কোন একটি ব্যাংকের অধীনে নয় বরং চারটি ব্যাংকের সাথে সংযুক্ত। তার মধ্যে প্রধান হলো রুপালী ব্যাংক। যা একটি সরকারী ব্যাংক। এর বাইরেও শিওর ক্যাশের সাথে যুক্ত রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংক। শিওর ক্যাশ অ্যাপটি ফিনটেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রাহকদের বেশ উন্নত মানের সেবা দিয়ে থাকে। বর্তমানে এর গ্রাহক সংখ্যা ২ কোটিরও বেশি।

এছাড়াও বাজারে রয়েছে আরো নানা মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান। ওকে, স্পার্ট ক্যাশ, ট্যাপ এন্ড পে ইত্যাদি। সকল প্রতিষ্ঠানই প্রায় সব ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। কিন্তু পার্থক্য গড়ে দেয় তাদের সেবার মান। আপনিও চাইলে একটি একটি করে সেবা গুলো ব্যবহার করে দেখতে পারেন। ফলে কোন প্রতিষ্ঠানের সেবা ব্যবহার করবেন তা নির্ণয় করাটা সহজ হবে।

ব্যবসা হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং

মোবাইল ব্যাংকিং এর ব্যবসা বলতে মূলত বোঝায় এজেন্ট হিসেবে কাজ করা। ব্যবসা হিসেবে বর্তমানে এটি বেশ ভাল একটি উপায়। অনেক বেকার যুবকেরই কর্মসংস্থান হয়েছে এ সকল মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে। তার পাশাপাশি অনেক প্রতিষ্ঠিত দোকানদারও নিজের দোকান সামলানোর পাশাপাশি এজেন্টের কাজ করেন। কারণ আর কিছুই নয়, এ ব্যবসার লাভ। মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবসায় বেশ ভাল লাভ রয়েছে। এর কাজ গুলো তেমন কঠিন কিছু নয়। এক দুই দিন সময় দিলেই প্রায় সকল খুটিনাট শেখা যায়। এর জন্য খুব বেশি মূলধনেরও প্রয়োজন নেই। ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকার মধ্যেই শুরু করতে পারবেন এজেন্ট ব্যবসা। তবে দোকান কোথায় হবে তার উপর ব্যয় বাড়তে বা কমতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রয়েছে বিকাশ এর এজেন্ট।

বিকাশ এজেন্ট ব্যবসায় প্রতি ১০০০ টাকা লেনদেনে ৪.১ টাকা (ইউএসএসডি ডায়াল) অথবা ৪.৩ টাকা (বিকাশ অ্যাপ) কমিশন রয়েছে। এছাড়াও অ্যাপের সাহায্যে ০.২০ টাকা বাড়তি কমিশন পাওয়া যায়। ফলে প্রতি হাজারে লাভ হয় ৪.৫ টাকা। এভাবে দিনে ৮০ হাজার টাকা লেনদেন করতে পারলে কমিশন পাবেন ৩২৮ টাকা। যা মাস শেষে দাঁড়ায় ৯৮৪০ টাকায়। আপনার মূল ধন বেশি হলে লাভও বেশি হবে। মনে রাখবেন, একটি দোকানে চাইলে সকল ধরনের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে সব কিছু থেকে মাসিক ২০-৩০ হাজার টাকা আয় হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এমনকি বড় বিনিয়োগে মাসিক আয় ১ লক্ষ টাকাও হতে পারে।

দৈনন্দিন জীবনে মোবাইল ব্যাংকিং এর তাৎপর্য

যত দিন যাচ্ছে, দৈনন্দিন জীবনে মোবাইল ব্যাংকিং এর তাৎপর্য ততই যেন গভীর হচ্ছে। ২০২১ সালে এসে আমরা অনেকটাই নির্ভর হয়ে পড়েছি এই বিশেষ সেবাটির ওপরে। নগদ টাকার পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকে এ থাকা টাকাও একটি বড় অংশ দখল করে নিচ্ছে আমাদের জীবনে। কিন্তু এর পূর্ণ সুবিধা পেতে হলে দৈনন্দিন জীবনে মোবাইল ব্যাংকিং কে কিভাবে পুরোপুরি কাজে লাগানো যায় তা জানা জরুরী। 

  • অনলাইন শপিংঃ মোবাইল ব্যাংকিং সবচেয়ে বেশি কার্যকরী অনলাইন শপিং এর ক্ষেত্রে। অনলাইনে কেনাকাটার সময় অনেকেই ক্যাশ অন ডেলিভারি পছন্দ করেন। কিন্তু অনলাইন পেমেন্ট করলে পাওয়া যায় বেশ কিছু ডিসকাউন্ট। তাই বিশেষ ডিসকাউন্ট অথবা ফ্রি ডেলিভারির সুবিধা ভোগ করতে ব্যবহার করতে পারেন মোবাইল ব্যাংকিং। 
  • বিল পরিশোধঃ প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে বিল দেওয়ার জন্য ঠেলাঠেলি। এসব এখন স্মৃতি। যদিও কিছু বছর আগেই এই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হত অনেককেই। কিন্তু বর্তমানে সকল মোবাইল ব্যাংকিং সেবাই অনলাইনে বিল পরিশোধের সেবা দিয়ে থাকে। ফলে ঘরে বসেই পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ইন্টারনেট, টেলিফোন থেকে শুরু করে আরও বিভিন্ন বিল পরিশোধ করতে পারবেন সহজে।
  • নিরাপদে ভ্রমণঃ ভ্রমণের সময় নগদ টাকা সঙ্গে রাখাটা অনেকটাই অস্বস্তিদায়ক। আর সেই সমস্যার সহজ সমাধান হতে পারে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা গুলো। কোন যাত্রার পূর্বে টাকার একটি নির্দিষ্ট অংশ ক্যাশ ইন করে নিলেই যাত্রা পথে থাকতে পারবেন নিশ্চিতে। গন্তব্যে পৌছানোর পর আবার সহজেই সেই টাকা ক্যাশ আউট করে নিতে পারেন। 
  • মোবাইল রিচার্জঃ রাত বিরেতে অনেকেরই মোবাইল রিচার্জের দরকার পড়ে। কিন্তু এমন বেকায়দা মূহুর্তে মোবাইল রিচার্জ করাটা বড় মুশকিল। কিন্তু একটি মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট থাকলে মোবাইল রিচার্জ করতে পারবেন খুব সহজেই। 
  • রেমিটেন্স গ্রহণঃ আত্নীয় স্বজন বা পরিবারের আয়ের মানুষটা বিদেশে থাকলে মাসে মাসে ব্যাংকে দৌড়ানো ঝামেলাই বটে। তবে অধিকাংশ মোবাইল ব্যাংকিং সেবাই এ সমস্যার অবসান ঘটিয়েছে। এখন চাইলে মোবাইল ব্যাংকিং এর সাহায্যেই বিদেশ থেকে পাঠানো টাকা আইনত বুঝে নিতে পারবেন।

এছাড়াও মোবাইল ব্যাংকিং এর রয়েছে আরো নানা সুবিধা। তবে তার পাশাপাশি কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। যেহেতু মোবাইল ব্যাংকিং এর ক্ষেত্রে গ্রাহককে সরাসরি উপস্থিত থাকতে হয় না তাই এই খাতে প্রতারণার সুযোগ অনেকটাই বেশি। ভুয়া কলের ফাঁদে পড়ে অনেক গ্রাহকই প্রতারিত হয়ে তাদের ওটিপি প্রতারককে দিয়ে দেয়। ফলে একাউন্টের সমস্ত টাকাই হারাতে হয়। তবে নিজে সচেতন হয়ে চললে এ বিপদ এড়ানো তেমন কঠিন নয়। 

অনলাইন ব্যাংকিং এবং মোবাইল ব্যাংকিং এর মধ্যে পার্থক্য

অনলাইন ব্যাংকিং কে অনেকেই মোবাইল ব্যাংকিং এর সাথে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু এদের বৈশিষ্ট্য গুলো জানলেই এদের পার্থক্য ও সাদৃশ্য পরিষ্কার হয়ে যাবে।

অনলাইন ব্যাংকিং 

মোবাইল ব্যাংকিং 

ব্যাংক একাউন্টের প্রয়োজন। মোবাইল নম্বর ও ন্যাশনাল আইডি কার্ড থাকলেই যথেষ্ট।
একাউন্ট নম্বর ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগ ইন করতে হয়।মোবাইল নম্বর ও ৪-৫ সংখ্যার পিন নম্বর দিয়ে লগ ইন করতে হয়।
একাউন্টে টাকা ঢোকাতে ও উঠাতে তৃতীয় পক্ষের কোন প্রয়োজন নেই।একাউন্টে টাকা ঢোকাতে ও উঠাতে তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ এজেন্টের প্রয়োজন আছে। 
অনলাইন ব্যাংকিং সরাসরি ব্যাংক একাউন্টের সাথে সংযুক্ত বলে টাকা লেনদেনের সীমা অনেক বড়।মোবাইল ব্যাংকিং করতে আসল ব্যাংক একাউন্ট লাগে না বলে লেনদেনের সীমা তুলনামূলক ছোট।
অনলাইন ব্যাংকিং এর ক্ষেত্রে কম্পিউটার ভাইরাসের কারণে ডাটা চুরির ভয় থাকে।কম্পিউটারের তুলনায় ফোনে ভাইরাস আক্রমণ অনেক কম বিধায় মোবাইল অ্যাপ বেশি নিরাপদ। 

শেষকথা

করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে যাবে। সবার আগে যেই জিনিস গুলো পরিবর্তন হবে তার মধ্যে একটি হল টাকার ধারণা। চীন সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে নগদ টাকার ব্যবহার যথা সম্ভব কমিয়ে এনেছে। আগামীর বিশ্বে হয়তো সব কয়টি দেশই অনলাইন কারেন্সির প্রতি জোর দেবে। আর তাই আগামীর সাথে মানিয়ে নিতে এখন থেকেই এসব সেবার সাথে সকলের পরিচিত হওয়া উচিত। 

অনবরত জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী 

১) বিকাশ থেকে রকেটে কি টাকা পাঠানো যায়?

উত্তরঃ বিকাশ থেকে রকেট বা এক মোবাইল ব্যাংকিং থেকে আরেক মোবাইল ব্যাংকিং সেবাতে টাকা পাঠানো যায় না। 

২) বিকাশ, রকেট, নগদ ইত্যাদির সাহায্যে কি আলিবাবা, আমাজন ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সাইটে কেনাকাটা করা যাবে?

উত্তরঃ না। এসব সাইটে কেনাকাটা করতে ডুয়েল কারেন্সি সম্বলিত কার্ড প্রয়োজন। তার জন্য ব্যাংক থেকে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড নিয়ে পাসপোর্ট দিয়ে এনডোর্স করে নিতে হবে। 

৩) একই নম্বর দিয়ে কি দুইটি একাউন্ট খোলা যায়?

উত্তরঃ না। একটি নম্বর দিয়ে একটি অ্যাপে শুধু একটি একাউন্টই খুলতে পারবেন। 

৪) একটি নম্বর দিয়ে বিকাশ একাউন্ট খুলেছি। তা দিয়ে কি রকেট বা নগদ একাউন্ট খুলতে পারবো?

উত্তরঃ অবশ্যই পারবেন।

৫) জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকলে জন্ম-নিবন্ধন সনদ দ্বারা কি একাউন্ট খোলা যাবে?

উত্তরঃ না। জাতীয় পরিচয়পত্রই লাগবে। 

৬) যেই ব্যাক্তির নামে একাউন্ট তিনি মারা গেলে টাকা কিভাবে উত্তোলণ করা যাবে?

উত্তরঃ ব্যাক্তির মৃত্যুর সার্টিফিকেট, জাতীয় পরিচয়পত্র, ওয়ারিশনের কাগজ ও অন্যান্য সকল প্রমাণাদি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করুন।

৭) মোবাইল ব্যাংকিং এ বাংলাদেশের অবস্থান কত?

উত্তরঃ পুরো বিশ্বে মোবাইল ব্যাংকিং এ বাংলাদেশের অবস্থান সবার শীর্ষে বলে ধারনা করা হচ্ছে।

 

 

তথ্যসূত্রঃ

(১) DBBL first to introduce mobile banking | The Daily Star

(২) Microsoft Word – MFS Final July 12_new.doc (bb.org.bd) 

(৩) History Of Mobile Banking (ukessays.com)

(৪) মোবাইল ব্যাংকিং: প্রতিযোগিতার পরিবেশ কতটা হল? | bangla.bdnews24.com

(৫) দৈনিক ইত্তেফাক

 

 

সর্বশেষ আপডেটের তারিখঃ ০৬/২৪/২০২১

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button