মোবাইল ব্যাংকিং

নিরাপদে মোবাইল ব্যাংকিং করার উপায়

ক্রমান্বয়ে আমাদের ব্যবহার করা অন্যান্য লেনদেনের মাধ্যমকে ছাপিয়ে যাচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং। আমাদের দেশে বর্তমানে প্রায় সব ক্ষেত্রেই মোবাইল ব্যাংকিং-এর সুযোগ তৈরি হয়েছে। এছাড়াও বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ব্যাংকিং সুবিধা মোবাইল ব্যাংকিং-এ যুক্ত করায় অনেকে এই প্লাটফর্মগুলোতে টাকা জমা রাখাও শুরু করেছেন। দেশের প্রতিটি এলাকায়, অলিতে-গলিতেই মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট থাকায় টাকা জমা করা বা উঠানোর কাজটাও ইদানিং খুবই সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু একই সাথে এর নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়েও এখন অনেক প্রশ্ন উঠছে। পুরো ব্যাপারটি ভার্চুয়ালি হওয়ায় এর মাধ্যমে নানা ধরনের জালিয়াতি, প্রতারণার ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। সেকারণে মোবাইল ব্যাংকিং করার সময় সবার সাবধানে থাকা প্রয়োজন। বেশ কিছু বিষয়ের দিকে সবসময় খেয়াল রাখলে নিরাপদেই মোবাইল ব্যাংকিং এর সুবিধা উপভোগ করা যায় । এখানে নিরাপদে মোবাইল ব্যাংকিং করার উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

মোবাইল ব্যাংকিং-এর নিরাপত্তা

মোবাইল ব্যাংকিং বেশ নিরাপদ একটি ব্যবস্থা। কিন্তু এর সকল কার্যক্রম ভার্চুয়ালি হওয়ায় এর মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ হওয়ার সুযোগ সাধারণ অফলাইন ব্যাংকিং সেবার চাইতে বেশি।

কিন্তু অন্যান্য স্বাভাবিক অনলাইন ব্যাংকিং-এর তুলনায় অনেক ক্ষেত্রেই মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বেশি নিরাপদ। এর একটি মূল কারণ হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা একটি নির্দিষ্ট সিম কার্ডের উপর নির্ভর করে কাজ করে। ফলে নির্দিষ্ট একটি একাউন্টের সকল অর্থ, তথ্য ঐ সিম কার্ডটির উপরেই নির্ভরশীল। সিম কার্ডটি ছাড়া ঐ একাউন্টটি ব্যবহার করা সম্ভব নয়।

মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইন ব্যাংকিং সেবার মাঝে তুলনা করলে, অনলাইন ব্যাংকিং সেবায় ব্যাংক একাউন্ট নাম্বারটিই সকল অর্থ ও তথ্যের বাহক। যেটি ব্যবহার করে যেকোনো স্থান থেকেই ঐ ব্যাংক একাউন্টটির সকল তথ্য ও টাকা ব্যবহার করা সম্ভব। তাই মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট থেকে সাধারণ ভাবে হ্যাকিং-এর মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করা অনেক বেশি কঠিন, যা অনলাইন ব্যাংকিং সেবাতে অনেক বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু তবুও এতে নানা ভাবে মানুষকে বোকা বানিয়ে টাকা চুরির ঘটনা প্রায়ই ঘটে। যা শুধুমাত্র সতর্ক থাকার মাধ্যমেই এড়ানো সম্ভব।

নিরাপদে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা উপভোগে করনীয়

মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যবহারে বিভিন্ন প্রকার সমস্যার মুখোমুখি হয়তো আমরা অনেকেই হয়েছি। সতর্ক থেকে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখলে মোবাইল ব্যাংকিং-এর সুবিধাগুলো নেয়া যায় সহজেই। এগুলো হলোঃ

বিশ্বস্ত সোর্স থেকে মোবাইল ব্যাংকিং-এর অ্যাপ ডাউনলোড করুন

প্রথমে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা শুধুমাত্র মোবাইলে নির্দিষ্ট ইউএসএসডি কোড ডায়াল করেই ব্যবহার করা যেতো। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় এখন আমাদের অধিকাংশ মানুষের হাতেই অ্যান্ড্রয়েড বা আইওএস চালিত মোবাইল ফোন রয়েছে। তাই, সকলের সুবিধার জন্য মোবাইল ব্যাংকিং সেবার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার তৈরি করেছে। যেগুলো ডাউনলোড ও ইন্সটল করে মোবাইল ব্যাংকিং-এর সকল কাজ খুব সহজেই করা যায়।

কিন্তু একই সাথে এই বিষয়টি মোবাইল ব্যাংকিং এর দূর্বলতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন চাইলে কেউ একই নামের একই লোগো সংযুক্ত অ্যাপ তৈরি করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দিতে পারে। যা ব্যবহার করলে একজন ব্যবহারকারীর সকল তথ্য অন্য ব্যক্তির কাছে চলে যাবে।

সেকারণে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করতে চাইলে অবশ্যই বিশ্বস্ত কোনো স্থান থেকে সেই অ্যাপটি ডাউনলোড করতে হবে। বিশ্বস্ত স্থান হতে পারে ঐ মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানীর নিজস্ব ওয়েবসাইট, গুগল প্লে স্টোর, অ্যাপ স্টোর প্রভৃতি।

জাল ম্যাসেজের প্রতি খেয়াল রাখুন

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় অধিকাংশ জালিয়াতিই হয় অসতর্কতার কারণে। এই অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে অনেকে ব্যবহারকারীদের মোবাইল নাম্বারে ভুয়া ম্যাসেজ পাঠায়। যেগুলোতে ব্যবহারকারীর কাছে তার ব্যক্তিগত তথ্য জানতে চাওয়া হয়। এবং পরবর্তীতে এইসকল তথ্য ব্যবহার করে নানান ভাবেই ব্যবহারকারীর একাউন্টের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়।

এইধরনের জাল ম্যাসেজ ব্যবহারকারীরা প্রায়ই বিভিন্ন অফিসিয়াল নাম্বারের আদলে ম্যাসেজের নাম্বার তৈরি করে থাকে। ফলে ঠিকভাবে খেয়াল না করলে অথবা না জানলে ভুল করাটাই স্বাভাবিক বিষয়।

তাই সকল ব্যবহারকারীরই জেনে রাখা উচিত যে, মোবাইল ব্যাংকিং সেবার কর্তৃপক্ষ সকল ব্যবহারকারীর তথ্য অনলাইন ডাটাবেজে সংরক্ষণ করে থাকে। তাই সাধারণত কর্তৃপক্ষের সেগুলো আলাদা করে চাওয়ার প্রয়োজন পরে না। আর একাউন্ট খুলতে এই তথ্যগুলো থাকা বাধ্যতামূলক। ফলে এই তথ্যগুলো জমা না হওয়া বা হারিয়ে যাওয়ার প্রশ্নও উঠে না।

এইধরনের জালিয়াতি থেকে বাঁচতে সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই। মোবাইল ব্যাংকিং সেবাগুলো সাধারণত সবসময়ই একটি নির্দিষ্ট নাম্বার থেকে ম্যাসেজ পাঠায় অথবা কল করে। সতর্ক থাকতে চাইলে সেই নাম্বারটি মনে রেখে এর বাইরের কো্নো নাম্বার থেকে এ সম্পর্কিত কোনো ম্যাসেজ আসলে তা উপেক্ষা করতে হবে।

মোবাইল ব্যাংকিং সেবা থেকে পাঠানো কোনো তথ্য কাউকে দেবেন না

মোবাইল ব্যাংকিং সেবার কোনো একাউন্টে কোনো কিছু পরিবর্তন করতে চাইলে কর্তৃপক্ষ  তা জানিয়ে ওই একাউন্টটির জন্য ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বারে এসএমএস পাঠায়। এসএমএসগুলো প্রায় সবসময়ই কোনো না কোনো ওটিপি অথবা অন্য কোনো কোড বহন করে। এই কোড ভুল মানুষের হাতে গেলে সে সহজেই ঐ একাউন্টের পাসওয়ার্ড, অন্যান্য অনেক তথ্য ও টাকা পয়সার কর্তৃত্ব নিয়ে নিতে পারে।

মোবাইল ব্যাংকিং সেবাগুলো সাধারণত ব্যবহারকারীর হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজে থেকে কোনো ধরনের ওটিপি পাঠায় না এবং সেগুলো জানতে চায় না। এজন্য কখনো নিজের হস্তক্ষেপ ছাড়া মোবাইল নাম্বারে এধরনের কোনো ম্যাসেজ আসলে সেগুলো কোনোক্রমেই অন্য কাউকে দেওয়া যাবে না। এবং নিজের কোনো ধরনের প্রয়োজন না থাকলে ঐ ম্যাসেজগুলো মোবাইল ফোন থেকে মুছে দিতে হবে।

অপরিচিত ওয়েবসাইটে একাউন্টের তথ্য প্রবেশ করাবেন না

মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে ইদানীং অনেক স্থানেই অনলাইনে পেমেন্ট করার সুবিধা রয়েছে। বিভিন্ন অনলাইন শপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন, ভর্তি আবেদন প্রভৃতিও মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে করা যায়। এসব কাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণত সেসকল প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার তথ্যগুলো দিতে হয়। এরপর সেখান থেকেই টাকা পরিশোধের কাজটি সমাধা হয়ে যায়।

এই পদ্ধতির সাহায্যে অনেকেই মোবাইল ব্যাংকিং সেবা থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। অনেক সময়ই বিভিন্ন অপরিচিত ওয়েবসাইট ঘুরে দেখার সময় নানান পপ-আপ (Pop-up) উঠে আসে। যেখানে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করে কেনাকাটার অপশন সামনে আসে। এছাড়াও অনেক অপরিচিত ওয়েবসাইটে দেখা যায় নামমাত্র মূল্যে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করে কেনাকাটার সুযোগ দেওয়া হয়। যা থেকে পরবর্তীতে গ্রাহকের মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টের টাকা আত্মসাৎ করার মত ঘটনাও ঘটতে পারে।

তাই মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে কোন ওয়েবসাইটে টাকা পরিশোধের প্রসঙ্গ আসলে অপরিচিত ওয়েবসাইটে একাউন্টের তথ্য ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে। খুব বেশী প্রয়োজন না হলে পরিচিত ও বিশ্বস্ত ওয়েবসাইটের বাইরে অন্য কোন ওয়েবসাইটে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার তথ্য প্রদানের প্রয়োজন হলে এড়িয়ে যেতে হবে।

সিম হারিয়ে গেলে যত দ্রুত সম্ভব উত্তোলন করুন

উপরেই উল্লেখ করা হয়েছিলো যে, মোবাইল ব্যাংকিং সম্পূর্ণভাবেই একটি নির্দিষ্ট সিম কার্ড অথবা একটি নির্দিষ্ট নাম্বারের উপরে নির্ভরশীল। তাই সিম কার্ডটি কারো কাছে থাকার অর্থ সেই মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টটিই তার হাতে থাকা। যদিও একাউন্টের পিন কোড সহ আরো বেশ কিছু বিষয়ের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি ব্যাংকিং কোম্পানীগুলো দিয়ে থাকে। তবুও এই নিরাপত্তা বলয়কে অনেকভাবেই কাটিয়ে উঠার পদ্ধতি ইতোমধ্যেই হ্যাকাররা বের করে ফেলেছে।

এছাড়াও মোবাইল ব্যাংকিং এর পদ্ধতি অনুযায়ী ঐ মোবাইল নাম্বারটি হাতের কাছে না থাকলে কোন একাউন্ট ব্যবহার করাও সম্ভব না। কাউকে টাকা পাঠানো থেকে শুরু করে, টাকা উত্তোলন, পেমেন্ট করা সহ সবকিছুর জন্যই ঐ মোবাইল নাম্বারটি হাতের কাছে থাকা প্রয়োজন।

সেকারণে ঐ মোবাইল নাম্বারটি হারানো গেলে একদিকে যেমন একাউন্টটি ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে অসৎকেউ সেই সিম কার্ডটি পেয়ে থাকলে একাউন্টের সকল টাকা পয়সা হাতিয়ে নিয়ে পারে চাইলে বেশ সহজেই। এছাড়াও ঐ একাউন্ট ব্যবহার করে কোন অপরাধমূলক কর্মকান্ড পরিচালনার সম্ভাবনা তো থাকছেই।

বর্তমানে দেশের সকল সিমকার্ড বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রেজিষ্ট্রেশন করায় সেসকল অপরাধের দায়ভার সিম কার্ডের প্রকৃত মালিকের দিকে আসাটাও অস্বাভাবিক নয়।  

তাই কোন কারণে যদি কোন সিম কার্ড হারিয়ে যায়, সেই নাম্বারটি যত দ্রুত সম্ভব সাময়িকভাবে অথবা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিতে হবে। যদিও মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট যুক্ত ফোন নাম্বার স্থায়ীভাবে বন্ধ করার চাইতে সাময়িকভাবে বন্ধ করাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। কারণ সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে সিম কার্ডটি পুনরায় তুলে নিয়ে আবার ঐ মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টটি স্বাভাবিক নিয়মেই ব্যবহার করা যায়।

শেষকথা

মোবাইল ব্যাংকিং সেবার উপরে আমরা সকলেই ইদানিং অনেক বেশী নির্ভর হয়ে যাচ্ছি। মোবাইল ব্যাংকিং সেবাগুলা অন্যান্য সাধারণ ব্যাংকিং সেবার মত সকল সুবিধা শুরু করায় ইদানিং অনেকের টাকা সঞ্চয়ের মাধ্যমও হয়ে উঠেছে এটি। সেকারণে মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টটি কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলে অনেক মানুষই অনেক ধরনের বিপদে পরে যেতে পারেন। তাই সবারই মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টের নিরাপত্তা নিয়ে সতর্ক থাকা খুবই প্রয়োজনীয়। উপরের বিষয়গুলো কেউ অনুসরণ করলে তার মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট অনেকখানিই নিরাপদ রাখা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button