চাকরিসরকারি চাকরি

সরকারি চাকরির আবেদন ফরম পূরণের নিয়ম এবং বিস্তারিত

বর্তমানে চাকরির বাজারে সরকারি চাকরি একটি দুর্লভ বস্ত। অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী স্নাতক পাশ করেই ঝুঁকে পড়েন সরকারি চাকরির দিকে। কেউ কেউ অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। বর্তমান বাজারে বেসরকারি চাকরির দৌরাত্ম্য এবং সরকারি চাকরির ভীষণ আকাল অনেকের কাছেই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের আশেপাশের অনেকের মধ্যে যেকোনো একটি চাকরিতে ঢুকে নিজের পায়ে দাড়ানোর চিন্তাটা প্রায়শই দেখা যায়। কিন্তু একটি ভাল অবস্থানে যেতে হলে চাই একটি ভাল চাকরি। তাই অন্ধের মতো না হাতড়ে জানতে হবে যেই চাকরিতে আবেদন করবেন তার সকল বিস্তারিত। সরকারি চাকরিপ্রার্থীদের জন্য আজকের লেখাটিতে থাকছে সরকারি চাকরির আবেদন ফরম পূরণের নিয়ম এবং বিস্তারিত।

সূচিপত্রঃ

সরকারি চাকরিতে আবেদনের নিয়ম

সরকারি চাকরিতে আবেদন একটি স্পর্শকাতর প্রক্রিয়া। প্রায় সকল সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেই আবেদন অনেক বেশি পড়ে। তাই অশুদ্ধ ভাবে আবেদন করলে বা অনিচ্ছাকৃত কোন ভুল থাকলেও মনোনীত না হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ অতিরিক্ত আবেদনের চাপে সিলেকশন কমিটির মূল লক্ষ্যই থাকে কিভাবে প্রার্থী সংখ্যা কমানো যায়। তাই আবেদনের পূর্বে কি কি বিষয় যোগাড় করে রাখতে হবে, কিভাবে শুদ্ধ আবেদন করতে হয় তা জানাটা জরুরী এবং এর পাশাপাশি অনলাইনে আবেদনের পূর্বে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো জেনে নেওয়া উচিৎ।

আবেদনের পূর্ব প্রস্ততি

সরকারি চাকরির আবেদন ফরম পুরনের পূর্ব প্রস্ততি হিসেবে কিছু জিনিস হাতের কাছে থাকা দরকার। কারণ আবেদন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর এগুলো অতি দ্রুত জোগাড় করা কষ্টকর। তাই আবেদন শুরু করার আগেই যেসব তথ্য ও জিনিস সাথে রাখতে হবে।

জাতীয় পরিচয়পত্র

জাতীয় পরিচয়পত্র চাকরিতে আবেদনের পূর্বে অত্যন্ত জরুরী। জাতীয় পরিচয়পত্রের ১৭ বা ১০ ডিজিটের নম্বর ছাড়া কোনো চাকরিতে আবেদন করা অসম্ভব। ১৮ বছর হওয়ার পরেও আইডি কার্ড না পেয়ে থাকলে পরিচয় পত্রের অনলাইন কপি দিয়েও আবেদন করা যাবে।

জন্ম নিবন্ধন সনদ

অনেক চাকরিতে জন্ম নিবন্ধন সনদ এরও প্রয়োজন পড়ে। তাই ১৭ ডিজিটের জন্ম নিবন্ধন নম্বর ও সনদ কাছে রাখতে হবে।

ফলাফল প্রকাশের তারিখ

অনেক চাকরিপ্রার্থীই এই তথ্য দেওয়ার সময় বিপাকে পড়েন। তাই আগে থেকেই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কর্তৃক প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট ডিগ্রির ফলাফল প্রকাশের তারিখ জোগাড় করে রাখতে হবে।

সকল সনদের মূল ও সত্যায়িত কপি

সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকল সনদেরই মূল ও সত্যায়িত কপি থাকতে হবে। বর্তমানে সাধারণত প্রাথমিক আবেদনের সময় সনদের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু প্রাথমিক লিখিত পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হলে মৌখিক পরীক্ষা দিতে হয়। সে সময় শিক্ষাগত যোগ্যতার সকল সনদপত্রের আসল কপি সাথে রাখতে হবে। তার সাথে কর্তৃপক্ষর কাছে জমা দেওয়ার জন্য প্রত্যেক সনদের সত্যায়িত ফটোকপি লাগবে। সত্যায়িত বলতে ফটোকপির এক অংশে যেকোনো প্রথম শ্রেণির চাকরিজীবীর (গ্রেড-১ থেকে গ্রেড-৯) সিল/স্বাক্ষর থাকতে হবে এবং ঐ চাকরিজীবীকে ‘সত্যায়িত’ বা ‘Atessted’ লিখে ঐ ফটোকপিকে সত্যায়িত করতে হবে। এছাড়া কোন কোটা সুবিধা নিলে সেই কোটা প্রমাণ করতেও প্রয়োজনীয় সনদ দাখিল করতে হবে।

উপরিউক্ত জিনিস গুলো ছাড়াও সরকারি চাকরিতে আবেদনের জন্য অবশ্যই ছবি, স্বাক্ষর ও মোবাইল নম্বরের দরকার পড়বে। এ সম্পর্কে যথা নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। যদি আবেদনের ফি ব্যাংকের মাধ্যমে ম্যানুয়ালি (Manually) প্রদান করে থাকেন তবে মূল চালানের স্ক্যান করা কপিও প্রয়োজন পড়তে পারে। 

আবেদন ফরম পূরণ

বাংলাদেশের সরকারি চাকরির আবেদন ফরম
সরকারি চাকরির আবেদন ফরম। সূত্রঃ জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগার, সুনামগঞ্জ

যেকোনো চাকরিতে আবেদন করার আগে প্রথমে আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী বাজারে কি ধরণের চাকরি রয়েছে সে সম্পর্কে ধারনা নেওয়া জরুরী। যা আপনি চাকরির খবর জানার ও আবেদন করার পোর্টাল গুলোতে নিয়মিত খোঁজ রাখলেই জানতে পারবেন। এরপরে পছন্দমত চাকরিতে আবেদন করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল জিনিস যোগাড় হলে আপনি আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন। এক্ষেত্রে সতর্কতা হিসেবে মোবাইল ডাটা কিনে রাখলে ভাল। যাতে আবেদনের সময় ইন্টারনেট বিছিন্ন হলেও আবেদন বিঘ্নিত না হয়। আবেদনের ধাপ গুলো ৫টি অংশে ভাগ করে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হলোঃ

ধাপ ১ঃ আবেদন ফরমে প্রাথমিক তথ্যপূরণ

সাধারণত মোট ১০-১২টি ধাপে প্রাথমিক তথ্যপূরণ করতে হয়। 

১) সঠিকভাবে নিজের নাম লিখতে হবে। 

২) লিঙ্গ নির্ধারণ করতে হবে। 

৩) বৈবাহিক অবস্থা নির্ধারণ করতে হবে। 

৪) জন্ম তারিখ উল্লেখ করতে হবে। এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট তারিখ অবধি আপনার বয়স কতো তা স্বয়ংক্রিয় ভাবে ফুটে উঠতে পারে।

৫) বাবা ও মায়ের নাম উল্লেখ করতে হবে। স্বামী অথবা স্ত্রী থাকলে তার নামও দিতে হবে। 

৬) মোবাইল নম্বর অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। এক্ষেত্রে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ পুরো আবেদন প্রক্রিয়াতে সেই মোবাইল নম্বর খুবই জরুরী।

৭) জাতীয়তা নির্ধারণ করতে হবে এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর উল্লেখ করতে হবে।

৮) বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ করতে হবে। মনে রাখবেন যে নিয়োগ পেলে সে সংক্রান্ত চিঠি এই ঠিকানাতেই আসবে। তাই অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ ও নিখুঁত ঠিকানা দিতে হবে।

৯) স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করতে হবে। এক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান/ পৌরসভার মেয়র/ ওয়ার্ড কাউন্সিলর কর্তৃক প্রদত্ত জাতীয়তা সনদে উল্লিখিত স্থায়ী ঠিকানা মোতাবেক প্রার্থীর স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করতে হবে। তবে অবিবাহিত মহিলাগণ আবেদন দাখিলের পরে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে প্রয়োজনীয় প্রমাণ দেখিয়ে স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন করতে পারবে।

১০) জেলা নির্ধারণ করতে হবে।

১১) নিজের ইমেইল আইডি উল্লেখ করতে হবে। 

নিজের নাম, বাবা, মা ও স্বামী / স্ত্রীর নাম পূরণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট চাকরির সার্কুলারের নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। সাধারণত সকল নামসমূহ ইংরেজিতে বড় অক্ষরে লিখতে হয়।

ধাপ ২ঃ ছবি ও স্বাক্ষর প্রদান

প্রাথমিক তথ্যপূরণের ধাপ গুলো শেষ হলে ছবি ও স্বাক্ষর প্রদান করতে হবে। এ সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হল। 

ছবি

সরকারি চাকরির আবেদন ফরম পূরণ করতে অবশ্যই সদ্য তোলা ছবি ব্যাবহার করা উচিৎ। সদ্য বলতে সাধারণত অনধিক ৩ মাস আগের তোলা ছবি বোঝানো হয়ে থাকে। চাকরি ভেদে ছবির বিভিন্ন রকমের সাইজ ও ফরম্যাট চাইতে পারে। তবে সাধারণত সাদা ব্যাকগ্রাউন্ড, জেপিইজি / জেপিজি ফরম্যাট ও ৬০০ × ৬০০ পিক্সেল রেজুলেশন সম্বলিত ছবি চেয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ছবির সাইজ সর্বোচ্চ ১০০ কিলোবাইট অবধি হতে পারবে। উলেখ্য যে, এখন প্রায় সকল চাকরির আবেদন অনলাইনে হয়ে থাকে। তাই ছবির স্ক্যান করা কপি অথবা সরাসরি সফট / ডিজিটাল কপি রাখতে হবে। ছবিটি অবশ্যই রঙিন হতে হবে এবং কান বা মুখের কোন অংশ ঢাকা থাকা চলবে না। উপরের প্রতিটি নিয়ম মানা অত্যন্ত জরুরী। নিয়ম না মেনে ছবি আপলোড করলে তা ইনফরমাল (Informal) ছবি হিসেবে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে আবেদন সাথে সাথে বাতিল করা হবে। 

স্বাক্ষর

স্বাক্ষর এর স্ক্যান কপি রাখা আব্যশক। সাধারণত ৩০০ × ৮০ পিক্সেল ও সর্বোচ্চ ৬০ কিলোবাইট আকারের ছবি আপলোড করতে হয়। এক্ষেত্রেও ব্যাকগ্রাউন্ড সাদা ও ছবির ফরম্যাট জেপিইজি / জেপিজি রাখতে হবে। 

উপরিউক্ত নিয়ম গুলো মেনে ছবি ও স্বাক্ষর তৈরি করে আবেদনপত্রে আপলোড করতে হবে। আপলোড করার জন্য ছবি ও স্বাক্ষরের স্থানে ‘Choose File’ অপশন থাকবে।

ধাপ ৩ঃ শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ

যেকোনো চাকরিতে আবেদন করতে হলে সেই চাকরির নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা চাই। শিক্ষাগত যোগ্যতা আপনার আবেদন পত্রের সবচেয়ে বেশি মূল্য নির্ধারণ করবে। তাই অত্যন্ত সাবধানতার সাথে নির্ভুল ভাবে শিক্ষাগত যোগ্যতা পূরণ করতে হবে।

১) পরীক্ষার লেভেল অনুযায়ী প্রত্যেক পরীক্ষার নাম উল্লেখ করতে হবে। অর্থাৎ আপনি কি সাধারণ স্কুল কলেজে পড়েছেন নাকি মাদ্রাসা অথবা কারিগরিতে পড়েছেন তা স্পষ্ট করতে হবে। 

২) এস. এস. সি. , এইচ. এস. সি. , স্নাতক ও স্নাতকোত্তর (যদি থাকে) ডিগ্রি নির্ধারণের পরে স্নাতকে কত বছরের কোর্স করেছেন তা উল্লেখ করতে হবে।

৩) এস. এস. সি. ও এইচ. এস. সি. পরীক্ষায় বিভাগ এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির বিষয় উল্লেখ করতে হবে। 

৪) বিভাগ ও বিষয় উল্লেখের পর কত জিপিএ / সিজিপিএ এর মধ্যে কত পেয়েছেন তা উল্লেখ করতে হবে। 

৫) অতঃপর পরীক্ষার বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করতে হবে।

৬) কত সালে পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়েছেন এবং ফলাফল ঠিক কত তারিখে প্রকাশিত হয়েছে তা উল্লেখ করতে হবে।

উল্লেখ্য যে শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই করে দেখা হয়। তাই ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত কোন ভাবেই এখানে অশুদ্ধ তথ্য দেবেন না। দিলে বিনা বিবেচনায় আবেদন বাতিল করা হবে।

ধাপ ৪ঃ কোটা নির্ধারণ ও প্রতিষ্ঠান পছন্দের ক্রম

সরকারি চাকরিতে নানা ধরনের কোটা দেওয়া হয়ে থাকে। আপনি যদি কোন কোটার যোগ্য হয়ে থাকেন তাহলে সেই কোটার তথ্য পূরণ করুন। সাধারণত যেই ৪টি কোটা দেওয়া হয়ে থাকেঃ

১) মুক্তিযোদ্ধা কোটা (মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি – নাতনিদের জন্য)।

২) উপজাতি কোটা।

৩) প্রতিবন্ধি কোটা।

৪) এতিম কোটা (শুধু এতিম খানায় বসবাস করেছেন এমন ব্যাক্তিদের জন্য)।

এছাড়াও অনেক সরকারি চাকরিতে একই পরীক্ষার সাহায্যে একাধিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া হয়। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে একটি পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি ব্যাংক গুলোতে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাই একাধিক প্রতিষ্ঠান থাকলে প্রতিষ্ঠানের পছন্দক্রম নির্ধারণ করে দিতে হবে। 

ধাপ ৫ঃ ফী প্রদান ও প্রমাণ সংগ্রহ

বর্তমানে বেশির ভাগ সরকারি চাকরিতেই আবেদনের ক্ষেত্রে ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করতে হয়। নিবন্ধিত হওয়ার সাথে সাথেই জব আইডি (Job ID) বা সিভি আইডি (CV ID) এবং একটি পাসওয়ার্ড (Password) পাবেন। সেই আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেই আবেদন সম্পূর্ণ করতে হবে। আবেদন জমা দেওয়ার আগে বা আবেদনের সময়ে নির্ধারিত ফী প্রদান করতে হবে। একেক চাকরিতে ফী একেক রকম এবং একেক উপায়ে ফী প্রদান করতে হয়। তবে বর্তমানে সকল সরকারি চাকরির আবেদনেই অনলাইন ব্যাংকিং বা মোবাইল ব্যাংকিং এর সাহায্যে ফী প্রদানের সুযোগ রয়েছে। আবেদনের আগেই অনলাইনে ফী প্রদান করলে তার Transaction ID (TxnlID) সংরক্ষণ করতে হবে। পরবর্তীতে অবশ্যই Payment Verify অপশন থেকে ভেরিফাই করিয়ে নিতে হবে। অথবা আবেদনের সময় ফী প্রদান করলে ৪ সংখ্যার একটি ওটিপি (OTP) দেওয়া হবে। সেই ওটিপি প্রবেশ করালে স্বয়ংক্রিভাবে পেমেন্ট ভেরিফাই হয়ে যাবে। 

ফী প্রদানের পরে আপনি যে ফী প্রদান করেছেন তার একটি প্রমাণ আপনাকে দেওয়া হবে। এটি বিভিন্ন নামে থাকতে পারে। যেমনঃ Tracking page, Payment Slip, Acknowledgement Slip ইত্যাদি। এই পেজ অথবা স্লিপটি অবশ্যই ডাউনলোড করে সংরক্ষণ করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের পরে অনেক ক্ষেত্রেই এটি ডাউনলোড করা যায় না। তাই আবেদন শেষ হওয়ার সাথে সাথেই প্রমাণটি সংরক্ষণ করলে সবচেয়ে ভাল হয়।

চলুন এবার জেনে নেয়ার যাক সরকারি চাকরির আবেদন করার আগে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় সম্পর্কেঃ

সরকারি চাকরির সুবিধা

সরকারি চাকরি সম্পর্কে একটি বহুল প্রচলিত কথা হল এর বেতন কম। যা আদতে সম্পূর্ণ ভুল ও হাস্যকর একটি কথা। ২০১৫ সালের বেতন কাঠামো অনুযায়ী সকল সরকারি চাকরিজীবীকে ২০টি গ্রেডে ভাগ করা হয়েছে। তাদের পরিচিত এখন সেই গ্রেড অনুযায়িই হয়ে থাকে। সরকারি চাকরিতে মূল বেতন কিছুটা কম হলেও নানা রকমের ভাতার কারণে মোট বেতন মূল বেতনের দেড় থেকে দুই গুণ হয়ে যায়। যেমনঃ বাড়ি ভাড়া ভাতা, যাতায়াত ভাতা, উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, অবসর ভাতা, ভ্রমণ ভাতা ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে সরকারি বাসস্থান, গাড়ি সুবিধা, গাড়ি ঋণ, বাড়ি ঋণ, কোটা সুবিধা সহ নানা সুযোগ–সুবিধা। সরকারি চাকরিতে এই সকল ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কারণেই বেসরকারি চাকরি থেকে এগিয়ে।

সরকারি চাকরির স্থায়িত্ব

স্থায়িত্বের দিক দিয়ে সরকারি চাকরি বাংলাদেশের যেকোনো বেসরকারি চাকরি থেকে সেরা। বর্তমানে একটি চাকরি পাওয়া যতটা কঠিন, চাকরি হারানোটা ততটাই সহজ। প্রতিনিয়ত নানা কারণে অসংখ্য চাকরিজীবী তাদের চাকরি হারাচ্ছেন। তাদের সিংহভাগই বেসরকারি চাকরিতে কর্মরত। বেসরকারি চাকরিতে চাকরির স্থায়িত্ব অনেকটাই নির্ভর করে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মর্জির ওপর। বেসরকারি চাকরিতে কোন চাকরিজীবীর চাকরি বাতিল হলে সেজন্য কোন জবাবদিহিতার প্রয়োজনই পড়ে না। কিন্তু সরকারি চাকরিতে বিষয়টি এমন নয়। সুর্নিদিষ্ট কারণ ব্যাতীত কোন সরকারি চাকরিজীবীকে বরখাস্ত করা যায় না অথবা অব্যহতি দেওয়া যায় না। এছাড়াও সরকারি চাকরিতে পদ বিলুপ্তি হলেও সেই চাকরিজীবীকে সর্বোচ্চ সহায়তা করা হয়। তাকে অন্য পদে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সম্ভব না হলে পূর্ণ অবসর ভাতা দেওয়া হয়। কিন্তু বেসরকারি চাকরিতে পদ বিলুপ্ত হলে কোন দ্বিতীয় কথার সুযোগ নেই। কোম্পানি অনেক সময়ই লোক ছাঁটাই এর জন্য কিছু পদ সাময়িক বা স্থায়ী ভাবে বিলুপ্ত করে দেয়। তখন চাকরিজীবীরা আন্দোলন করলেও আদতে কখনোই কোন লাভ হয় না।

এর বাইরেও বেসরকারি চাকরির আরেকটি গুরুতর সমস্যা রয়েছে। সেটি হল কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যাওয়া বা বন্ধ করে দেওয়া। এর চাক্ষুষ উদাহরণ আমরা দেখতে পারছি চলমান বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এর মধ্যে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অসংখ্য ক্ষুদ্র কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বেকার হয়ে পড়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। যেসব কোম্পানি এখনো টিকে আছে তার বেশির ভাগই কর্মীদের ৪ ভাগের ৩ ভাগ, অর্ধেক কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে তারও কম বেতন দিচ্ছে। অপর দিকে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন একই আছে। কারণ তাদের বেতন সরাসরি সরকার থেকে প্রাপ্ত। এটি শুধু কোভিড-১৯ মহামারির সাথেই জড়িত নয়। দেশের যেকোনো মন্দায় প্রথম আঘাতটি বহন করে বেসরকারি খাত। তাই বুঝতেই পারছেন, বেসরকারি চাকরি থেকে সরকারি চাকরি কতটুকু নিরাপদ।

তবে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, সরকারি চাকরির স্থায়িত্ব অপরিসীম নয়। অনেকের মধ্যেই এই ভুল ধারণাটি থাকায় তারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। কিংবা কাজে গাফিলতি করে। কিন্তু উপযুক্ত কারণ থাকলে সরকারি চাকরিজীবীদের বরখাস্ত হতেও খুব বেশি সময় লাগে না।

সরকারি চাকরিতে কাজের চাপ 

কোন চাকরিতে ঢোকার পূর্বে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে সে চাকরিতে কাজের চাপ কেমন। অনেকে কাজপ্রেমী হন, আবার অনেকে নিজের জন্য একটু বেশি সময় বাচাতেই পছন্দ করেন। যদিও অনেকের ধারণা সরকারি চাকরিতে কাজের চাপ একেবারেই নেই। কিন্তু তা সত্য নয়। সরকারি চাকরিতে বেশ কাজ রয়েছে, কিন্তু এর বৈশিষ্ট্য হল ধরা বাঁধা নিয়ম। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা দৈনিক মোট ৮ ঘন্টা কাজ করতে হয়। সরকারি চাকরির বেশিরভাগ পদেই কাজ গুলো কর্মক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু প্রায় প্রতিটি পেশার জন্য সরকারি কোন না কোন চাকরি রয়েছে। অনেক পেশাতেই পেশাগত কারণে মাঠেঘাটে ছুটতে হয়। পরিদর্শন করতে হয়। যেমনঃ পুলিশের চাকরি। আবার ‘কাস্টমস’ এ চাকরি করলে আপনার কাজ কর্মক্ষেত্রের মধ্যেই একেবারে সীমাবদ্ধ।

তাই কতটুকু কাজের চাপ এবং কি ধরণের কাজ তা নির্ভর করবে আপনি কোন পদে চাকরি করবেন তার ওপর। কিন্তু বেসরকারি চাকরির সাথে তুলনা করলে বেশিরভাগ পদের সরকারি চাকরির কাজের চাপ কম। কারণ বেসরকারি চাকরিতে অনেক সময়ই কর্মীর উপর ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত কাজ দিয়ে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা শেষ না করলে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তুলনামূলক ভাবে সরকারি চাকরিতে এমন পরিস্থিতি অনেকটাই কম। এছাড়াও ছুটির কথা হিসাব করলে সাপ্তাহিক দুই দিন ছুটির কারণে সরকারি চাকরি এক্ষেত্রে এগিয়ে থাকে। আবার ঈদ, পূজা বা অন্য কোন বড় উৎসবে সরকারি চাকরিতে ছুটি একদমই কম। মূলত চাকরি সরকারি বা বেসরকারি যাই হোক না কেন, কাজের চাপ নির্ভর করবে নির্দিষ্ট পদের ওপর। তবে সার্বিক ভাবে সরকারি চাকরিতে চাপ কিছুটা কম থেকে থাকে।

সরকারি চাকরিতে যোগদানের পূর্বশর্ত 

সরকারি চাকরিতে যোগদানের রয়েছে নানা রকম নীতিমালা। অসংখ্য নীতিমালার মধ্যে একটি বিষয়ে একটু বিশেষ ভাবেই বলতে হয়। সেটি হল আবেদনকারীর ক্রিমিনাল রেকর্ড অর্থাৎ অপরাধমূলক কার্যক্রমের ইতিহাস আছে কিনা তা যাচাই। যেকোনো সরকারি চাকরিতে নিয়োগের পূর্বে চাকরিপ্রার্থীর সমস্ত ইতিহাস খুটিয়ে দেখা হয়। বিশেষত বিসিএস পরীক্ষায় মনোনীত হওয়ার পরেও কিছু সংখ্যক পরীক্ষার্থী গেজেটেড হন না। তার মূল কারণ পুলিশ ভেরিফিকেশন (Police Verification) এ আটকে যাওয়া। কোন নাগরিক যদি কোন রকমের ফৌজদারি অপরাধে দন্ডপ্রাপ্ত হন তাহলে কোন ভাবেই তিনি আর সরকারি চাকরিতে ঢুকতে পারবেন না। এছাড়া রাষ্ট্রবিরোধী কোন সংগঠনের সাথে নূন্যতম যোগাযোগও যদি থাকে; তাহলে সরকারি চাকরির আশা না করাই ভাল। তাই কারো লক্ষ্য যদি হয়ে থাকে সরকারি চাকরি; তাহলে তার অবশ্যই যেকোনো ধরনের অপরাধ ও ঝামেলামূলক কার্যক্রম থেকে দূরে থাকতে হবে।

এছাড়াও নিজের স্বাস্থ্যের দিকেও নজর রাখতে হবে। সামরিক বাহিনীতে চাকরির জন্য শারীরিক সক্ষমতা খুবই ভাল হতে হয়। বিসিএস বা অন্য সরকারি চাকরিতে সেরকম বাধ্যবোধকতা না থাকলে স্বাভাবিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়। বিশেষত বিসিএস পরীক্ষায় অতিরিক্ত কম বা বেশি ওজন, শরীরের কোন অপরূণীয় ক্ষতি থাকলে বাদ পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই চাকরিতে আবেদনের আগে থেকেই এসব বিষয় খেয়াল করে চলতে হবে। 

শেষকথা

চাকরি সরকারি হোক অথবা বেসরকারি। প্রত্যেক চাকরি এরই মূল্য রয়েছে। যদিও ভাল অবস্থান ও জীবনের আশায় অনেকেই সরকারি চাকরির পেছনে ছোটেন। আবার কেউ কেউ বেসরকারি চাকরিতে অবস্থান করতেই স্বাছন্দ্য বোধ করেন। তবে যে পথেই হাটুন, কোন চাকরিতে প্রবেশের পূর্বে চাই সে সম্পর্কে সঠিক ও বিস্তারিত ধারণা। নাহলে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে মাঝ পথেই।  আশা করি এই লেখাটি পড়ে সকলেই সরকারি চাকরির আবেদন ফরম পূরণের নিয়ম এবং আরও কিছু বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার কিছু ধারণা হয়েছে। তবে শুধু ধারণা পেলেই হবে না, সরকারি চাকরির জন্য সঠিক ভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ এটি ছেলের হাতের মোয়া নয় যে চাইলেই পাওয়া যাবে। এর জন্য চাই কঠোর পরিশ্রম, নিদারুণ অধ্যবসায় এবং নিয়মিত রুটিন অনুসরণ করা। আর নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়ে আপনি আপনার গন্তব্যে সফল ভাবে পৌঁছে যান, এই কামনাতেই আজকের লেখাটি শেষ করছি।

অনবরত জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

১) সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স কত?

উত্তরঃ সর্বোচ্চ ৩০ বছর।

২) সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়স কত?

উত্তরঃ ৫৯ বছর। তবে মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মকর্তা – কর্মচারীদের জন্য এই বয়সসীমা ৬০ বছর।

৩) অদূর ভবিষ্যতে কি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো হবে?

উত্তরঃ দীর্ঘদিন ধরে এমন দাবি উঠে চললেও, এখন অবধি মন্ত্রীসভা তা অনুমোদন করে নি। অদূর ভবিষ্যতে করবে কিনা এমন কোন তথ্যও তারা প্রকাশ করে নি। 

৪) স্নাতকে পঠিত বিষয় কি বিসিএস পরীক্ষায় কোন ভূমিকা রাখবে?

উত্তরঃ সাধারণ ক্যাডারে পরীক্ষা দিলে স্নাতকে কি পড়েছেন তাতে কিছুই যায় আসে না। সম্পূর্ণ মূল্যায়ন বিসিএস পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে হবে। তবে কারিগরি / পেশাগত ক্যাডারে পরীক্ষা দিতে হলে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে স্নাতক পাশ করতে হবে এবং ঐ বিষয়ের উপর বিশেষ পরীক্ষা দিতে হবে। 

৫) সরকারি চাকরিতে সর্বোচ্চ কোন পদে যোগ দেওয়া যায়?

উত্তরঃ সাধারণত ক্যাডার ও নন – ক্যাডার সকল চাকরিজীবী সর্বোচ্চ গ্রেড – ৯ এ চাকরিজীবন শুরু করেন। তবে নন – ক্যাডার কিছু পদে গ্রেড – ৬ এ যোগদান করা যায়। 

৬) বিসিএস পরীক্ষার সাহায্যে কি গ্রেড – ৯ এর উপরের পদে যোগদান সম্ভব নয়?

উত্তরঃ সম্ভব। অসাধারণ ভাল ফলাফল করলে প্রশাসন ক্যাডার ও পররাষ্ট্র ক্যাডারে গ্রেড – ৬ এর সহকারী সচিব পদে যোগদানের সুযোগ রয়েছে। তবে এর জন্য সরকারি কর্ম কমিশনের নীতিমালা রয়েছে। 

৭) সরকারি চাকরিতে না প্রবেশ করেও কি সরকারি বেতন গ্রেডে বেতন পাওয়া সম্ভব?

উত্তরঃ না, তবে ব্যাতিক্রম রয়েছে। যেমন বেসরকারি কলেজের এমপিও ভুক্ত শিক্ষকরা সরকারি বেতন গ্রেড অনুযায়ী বেতন পেয়ে থাকেন। তবে তারা কোন ভাতা পান না, শুধু মাত্র মূল বেতনটুকু পান। কিন্তু তাদের অবসর ভাতার সুবিধা রয়েছে।

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button