টেকনোলজিসাইবার ক্রাইম

সাইবার ক্রাইম কি? সাইবার ক্রাইম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য

মূলত কম্পিউটার ইন্ডাস্ট্রি বা নেটওয়ার্ক এর আধুনিকায়নের পরেই “সাইবার-ক্রাইম” (cyber crime) শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। যা কম্পিউটার সাইবার ক্রাইম (cybercrime) নামেও বেশ পরিচিত। সাইবার ক্রাইম কে মোটামোটি বড় ধরনের ঝুঁকির মূল হোতা ই বলা চলে কারণ এর সাথে জড়িত আর্থিক ক্ষতি, ডাটা ব্রীচ, সিস্টেমে সমস্যা, পাশাপাশি কোম্পানির সম্মান হানির বিষয় তো থাকেই। 

এমনকি একবিংশ শতাব্দীর মধ্যে এমন কোনো স্থান খুজে পাওয়া যাবে না যেখানে সাইবার ক্রাইম নামক অপরাধটি হয়নি। সেক্ষেত্রে বুঝতেই পারছেন আপনার-আমার ক্ষতির আশংকা নেহাৎ কম নয়। এই আলোচনায় আমরা জানবো সাইবার অপরাধ কি, সাইবার ক্রাইম কত প্রকার, সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধের উপায় সংক্রান্ত নানাবিধ তথ্য।

সূচিপত্রঃ

সাইবার ক্রাইম (cyber crime) কি?

নতুন নতুন প্রযুক্তি যেমন আমােদের জীবনযাত্রাকে সহজ করে তেমনি জন্ম দেয় নতুন কিছু অপরাধেরও। সংক্ষিপ্তাকারে বলতে গেলে; অবৈধ উপায়ে, অবৈধ কাজের জন্য যেকোনো যোগযোগ যন্ত্রের ব্যবহারই সাইবার ক্রাইম। এই অপরাধটি একটি কম্পিউটার বা একই নেটওয়ার্কের ভেতর একাধিক কম্পিউটারকে কেন্দ্র করে পরিচালনা করা হয়। পৃথক একজন ব্যাক্তি, ব্যবসায়িক সংস্থা, বা সরকারী প্রতিষ্ঠানকেও লক্ষ্য করে এই অপরাধটি সংগঠিত হতে পারে। 

ইন্টারনেটের বদৌলতে সাইবার অপরাধীরা গা-ঢাকা দিতে পারে খুব সহজে। কিন্তু বাস্তব জীবনের অপরাধীরা যেমন কোন না কোনো ক্লু ফেলে যায় তেমনি সাইবার অপরাধীরাও তার পরিচয় আর অবস্থানের ব্যাপারে কিছু না কিছু জানান দিয়ে যায়। 

লেনদেন ভিত্তিক অপরাধ গুলো নির্দিষ্ট মানুষ বা কর্পোরেশনকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। যেমন ফ্রড (fraud), ডিজিটাল পাইরেসি (digital piracy), মানি-লন্ডারিং (money laundering) ইত্যাদি। এগুলো মূলত মুনাফা বা রাজনৈতিক কারণেই ঘটে থাকে। অপরদিকে এমন কিছু অপরাধ আছে যেগুলো সংগঠিত হয় শুধুমাত্র ইন্টারনেটের কার্যক্ষমতায় বিঘ্ন ঘটিয়ে। যেমন:  স্প্যাম (spam), হ্যাকিং (hacking), বা সাইবার ট্যারোরিজম এর জন্য নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে সার্ভিস অ্যাটাক (service attacks)। সাইবার ট্যরোরিজম এতোটাই সাংঘাতিক আকার নিতে পারে যে তাতে করে একটি দেশের অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত অবকাঠামোকে শঙ্কার মুখে ফেলে দিতে পারে।

সাইবার ক্রাইম এর শ্রেণীবিভাগ

ক্যাটাগরী অনুসারে সাইবার ক্রাইমকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। 

ব্যাক্তিকেন্দ্রীয়

ইন্টারনেটে ব্যাক্তিকেন্দ্রীক  যে অবৈধ কাজগুলো হয় সেগুলোই পৃথক সাইবার ক্রাইম বলে পরিচিত। উদাহরনস্বরুপ বলা যেতে পারে পর্নোগ্রাফী প্রচার, বা অনলাইন স্টকিং।

সম্পদ সংক্রান্ত

এ ধরনের সাইবার ক্রাইমে কারো ব্যাংক একাউন্ট বা ক্রেডিট কার্ডের তথ্য নিয়ে তাদের ফান্ডে সহজেই ঢুকে ইচ্ছামতো টাকা লেনদেন করা হয়। এছাাড়াও ব্যাক্তিগত তথ্যও চুরি করা হয়।

সরকারী

সরকারী প্রতিষ্ঠানে সাইবার ক্রাইম তেমন হয়না বললেই চলে তবুও যদি হয় তবে হ্যাকাররা সরকারী ডাটাবেজ ভেঙে দেয় এবং অফিশিয়াল ওয়েবসাইট গুলো হ্যাক করে। 

সাইবার ক্রাইম এর ধরন

সাইবার ক্রাইমের বিভিন্ন ধরন রয়েছে; এর মধ্যে সবচেয়ে কমন হলো: ই-মেইল ফ্রড, সোশাল মিডিয়া ফ্রড, ব্যাংকিং ফ্রড, স্পাইওয়্যার ইত্যাদি। এখন দেখে নেয়া যাক এই ক্রাইম গুলো কিভাবে কাজ করে:

হ্যাকিং (Hacking)

কোন ব্যাক্তিগত কম্পিউটারের বা নেটওয়ার্কের অবৈধ ব্যবহার করে তা বন্ধ করে দেয়া অথবা সেখানে থাকা তথ্য চুরি করাকে বলে হ্যাকিং। সেটা হতে পারে ক্রেডিট কার্ড নাম্বার বা মিউজিক (music), ভিডিও (video), শিশু পর্নোগ্রাফি (child pornography) সংক্রান্ত বিভিন্ন ফাইল শেয়ার।  

মূলত একটি সিকিউরিটি সিস্টেম এর দুর্বলতা খুজে বের করে হ্যাকার অনুপ্রবেশ ঘটায়। এক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই তারা ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন লিংকে ক্লিক করার মাধ্যমে তাদের কার্যসিদ্ধি করে। 

আইডেন্টিটি থেফ্ট (Identity theft)

আইডেন্টিটি থেফট বা পরিচয় চুরির নামের সাথে এর কাজ এরও মিল রয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় হ্যাকার অন্য একজন ব্যক্তি সম্পর্কে এমন সব তথ্য যোগাড় করার চেষ্টা করে যার মাধ্যমে সে তার ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করতে পারে। যেমন আমেরিকাতে অফিশিয়াল কোনো আইডি কার্ড ব্যবহার করা হয় না। তাদের থাকে একটি নাম্বার (identification number)। নাগরিকদের এ নাম্বারটির ওপর ভিত্তি করেই ট্যাক্স আদায় করা হয়। আবার অনেক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলো এই নাম্বারটি ব্যবহার করে তাদের কর্মী, ‍শিক্ষার্থীদের ট্র‌্যাক করে। এই নাম্বারটি দ্বারা একজন নাগরিকের ক্রেডিট কার্ডের রেকর্ডও চুরি করা যায়। এর ফলে তার দুই ধরনের ক্ষতি করতে পারে।

১. ক্রেডিট কার্ডের দ্বারা বড় কোন বিলের পেমেন্ট করে ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিকে ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে। 

২. পৃথক পৃথক ক্রেডিট কার্ডের নাম্বার দ্বারা নতুন আইডেন্টিটি বানিয়ে নিতে পারে। যেমন; হ্যাকার ক্রেডিট কার্ডের মেইল এড্রেসটি পরিবর্তন করে এবং নিজের ছবি দিয়ে ভূয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স বানিয়ে নিতে পারে। আবার ব্যাংক একাইন্ট খুলে লোন নিতে পারে। Bureau of Justice Statistics (BJS) রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১২ সাল পর্যন্ত আইডেন্টিটি চুরির সংখ্যা এক মিলিয়ন ছাড়িয়েছে।

এটিএম ফ্রড (ATM fraud)

এটিএম থেকে নগদ টাকা তুলতে ব্যবহারকারীকে একটি কার্ড এবং একটি পিন নাম্বার প্রদান করা হয়। এটিএম ফ্রডরা এসব কার্ডের ম্যাগনেটিক স্ট্রাইপ (magnetic strip) থেকে তথ্য এবং পিন নাম্বার বের করে ফেলতে পারে। এই তথ্য গুলো দ্বারা সহজেই নকল কার্ড বানিয়ে একাউন্ট থেকে যেকোনো পরিমান টাকা তুলতে পারে। 

ম্যালওয়্যার এটাক (Malware Attack)

সাইবার এটাক এর অনেক বড় একটি বিষয় হচ্ছে ম্যালওয়্যার; আবার এর মধ্যে রয়েছে ভাইরাস, ট্রোজান, ওয়ার্ম। সহজ ভাষায় বলতে গেলে ম্যালওয়্যার হলো লিখিত কিছু কোড যা কম্পিউটার এর তথ্য নষ্ট করার জন্য ব্যবহার করা হয়।

ফিশিং(Phishing)

থার্ড পার্টির দ্বারা ইমেইলের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করাকেই ফিশিং বলে। ফিশিং মেইল গুলো ইউজারদের একটি লিংকে ক্লিক করার জন্য ইনভাইট করে, তারপর ব্যাক্তিগত তথ্য পূরন করতে বলে। ইদানিং ফিশিং মেইল গুলো এতোটাই জটিল হয়ে গেছে যে ইউজাররা সাধারন ইনভাইটেশন আর ফিশিং মেইল এর পার্থক্য করতে পারে না। মোটামোটি পাঁচটি ধাপে ফিশিং করা হয় যেমন  ফিশিং প্রিপারেশন, ফিশিং সেট আপ, এটাক প্রসেস ঠিক করা, ডাটা রেকর্ড করা, এবং সবশেষে সংগৃহীত তথ্য গুলোর অবৈধ ব্যবহার। 

পাইরেসি

১৯৯০ সালের দিকে রেকর্ডিং কোম্পানি গুলোর মোটা অংকের আয় হতো সিডি (CDs) বিক্রি করে। তারপর আসলো “পাইরেসি” (piracy), যা কপিরাইট করা সিডি গুলোর অবৈধভাবে  ‍ডুপ্লিকেট কপি বানিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দিতে লাগলো। এটি ছিল রেকর্ডিং কোম্পানি গুলোর জন্য অনেক বড় একটি দুঃস্বপ্ন। 

রেকর্ডিং ইন্ডাস্ট্রির সংগঠন Recording Industry Association of America (RIAA), ন্যাপস্টার  (Napster) নামের একটি কেন্দ্রীয় কম্পিউটার দ্বারা খুব ক্ষতিগ্রস্থ হয়; যা ভোক্তাদের ইন্টারনেট দ্বারা MP3 ফরম্যাটে যেকোন গানের ফাইল দিয়ে দিত। ন্যাপস্টার এর ব্যবহারকারীরা নিয়মিতই কপিরাইট আইন ভাঙতে শুরু করে। তবে তাদের একটি যুক্তি ছিল যে প্রথম যে ব্যাক্তি একটি গানের সিডি কিনল, সে তো সঠিক দামেই কিনল তারপর সে সেটা চাইলে অন্য কারো সাথে শেয়ার করতেই পারে। এসব ব্যবহারকারীদের RIAA ডিজিটাল পাইরেট (digital pirate) হিসেবে ঘোষনা করার কিছুদিনের মধ্যেই ন্যাপস্টার বন্ধ হয়ে যায়। তবে অবৈধ ফাইল শেয়ারিং কিন্তু বন্ধ হয়নি।

২১ শতকের প্রথমদিকে কপিরাইটের মালিকরা ডিজিটাল ভাবে তাদের কপি বিক্রির কথা ভাবতে থাকেন। যেমন আই-টিউন স্টোর (iTunes Store) বা এমাজন মিউজিক (Amazon.com of music)। ২০০০ সালের দিকে যেখানে সিডি বিক্রির পরিমাণ ছিল ৮০০ মিলিয়ন, সেখানে ২০১৪ সালে এসে দাড়িয়েছে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে ডিভিডি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও। তবে এখন ডিজিটালি মিউজিক বিক্রির ফলে রেকর্ডিং কোম্পানিগুলো তাদের ক্ষতি থেকে বের হয়ে আসতে পারছে। 

DDoS অ্যাটাক (DDoS Attack)

ড্যানিয়াল অফ সার্ভিস (denial-of-service/DoS) অ্যাটাক কোন নেটওয়ার্কে সেবা প্রদানে সমস্যা সৃষ্টি করে। অ্যাটাকার-রা নেটওয়ার্কে অনেক বড় সাইজের ডাটা পাঠায় যেনো নেটওয়ার্কটি ওভারলোড হয়ে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। বিভিন্ন ধরনের DoS অ্যাটাক হতে পারে, এদের মধ্যে সবচেয়ে কমন হলো ডিস্ট্রিভিউটিভ ড্যানিয়াল অফ সার্ভিস (distributed denial-of-service/ DDoS)

এই ধরনের অ্যাটাক সহজে ধরা যায় না, কারন এটি কম্পিউটারকে হাইজেক করে সিকিউরিটি বা ইন্টারনেটকে অনেক ধীর গতির করে দেয়। আবার অনেক ডি-ও-এস অ্যাটাক সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেও ব্যবহৃত হয়। 

ম্যান ইন দ্য মিডল অ্যাটাক (Man-in-the-middle Attack)

ম্যান ইন দ্য মিডল অ্যাটাকে একটি কমিউনিকেশনের শেষ ইউজার যিনি তার কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে নেয়া হয়। উদাহরনস্বরুপ বলা যায়, অনলাইন ব্যাংকিং এর কথা। এখানে ইউজারের সাথে, ব্যাংকের নাম দিয়ে যোগাযোগ করা হয়। তাতে করে গ্রাহকের ব্যাংক একাউন্টের সব তথ্য অ্যাটাকার পেয়ে যান। 

ডাউনলোড অ্যাটাক (Download Attack)

সফটওয়্যার আপডেট এর নামে অনেক সময় হতে পারে ডাউনলোড অ্যাটাক। আর সেই লিংকে ক্লিক করলেই ক্ষতিকর কোড ইন্সটল হয়ে যায়। অনিচ্ছাকৃত এই ধরনের সব ডাউনলোড কেই ডাউনলোড অ্যাটাক নামে ডাকা হয়। সাধারনত এ ধরনের অ্যাটাক পুরোনো ব্রাউজার, অ্যাপ, অপারেটিং সিস্টেম এর সাহায্যে করা হয়।

সাইবার বুলিং (Cyber Bullying)

সাইবার বুলিং “অনলাইন বা ইন্টারনেট বুলিং” নামেও পরিচিত। টিনএজারদের মধ্যে এই অপরাধটি দিনকে দিন বেড়ে চলছে। কারো ব্যাপারে ক্ষতিকর বা লজ্জাজনক তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়াটাই সাইবার বুলিং, যা অনেকাংশেই মানসিক সমস্যার তৈরী করে থাকে। 

ড্রাগ পাচার (Drug Trafficking)

ক্রিপ্টোকারেন্সি টেকনোলোজির বিস্তারে, গোপন ভাবে অর্থ লেনদেন করা খুব সহজ হয়ে পড়েছে। এতে ড্রাগ মার্কেটিংও ফুলেফেপে উঠেছে। ডার্ক ওয়েবে কোকেইন, হিরোইন, মারিজুয়ানা কোন বাধ্য-বাধকতা ছাড়াই বিক্রি হচ্ছে। 

সাইবার চাঁদাবাজি (Cyber Extortion)

সাইবার ক্রিমিনালরা চুরি করা তথ্য ফেরত দিতে বা তাদের অপরাধপূর্ণ কার্যকলাপ বন্ধ করতে অনেক সময় মোটা অংকের টাকা দাবি করে থাকে। 

নকল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি (Online Recruitment Fraud)

বর্তমানে এ ধরনের বিজ্ঞপ্তির পরিমান অনেক বেড়ে গেছে। ভূয়া কোন কোম্পানির নামে দিয়ে নকল বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আবেদনকারীদের থেকে টাকা দাবি করা হচ্ছে। 

সাইবার স্পুফিং (cyber spoofing)

বিশ্বস্ত কোন ব্যাক্তির অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে তার মাধ্যমে অন্য কারো কম্পিউটারে অবৈধভাবে আইপি এড্রেস পাঠানো হলে তাকে সাইবার স্পুফিং বলে। অর্থাৎ হ্যাকার-রা অন্যের পরিচয়ে ইমেইল বা মেসেজ এর মাধ্যমে অপরাধটি ঘটিয়ে থাকে।

সাইবার ক্রিমিনাল (Cybercriminals)

যে ব্যাক্তি বা কোনো টিম তাদের টেকনোলোজিকাল স্কিল দ্বারা অবৈধ কাজ করে তারাই সাইবার ক্রিমিনাল। আবার সব হ্যাকারকেই সাইবার ক্রিমিনাল বলা যায় না। যারা বৈধ কোন উদ্দেশ্যে বা রিপোর্টিং এর জন্য কাজ করে তাদেরকে হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার বলা হয়। সে হিসেবে সাইবার ক্রিমিনালদের দুই ভাগে ভাগ করা যায় যেমন:

১. হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার (white hat hacker)

২. ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার (Black hat hackers)

যারা অনলাইনে অবৈধ কন্টেন্ট নিয়ে কাজ করে, স্ক্যাম বা ড্রাগ ডিলিং এ সাহায্য করে তারাই ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার। কাজ অনুসারে তাদের আরো কিছু নামে ডাকা হয় যেমন: সাইবার স্টকার (Cyberstalkers), সাইবার ট্যারোরিস্ট (Cyber terrorists), স্ক্যামার (Scammers)।

সাইবার ক্রাইম এর বাস্তব উদাহরন

রেভিল এন্ড কেসিয়া র‌্যানসামওয়্যার (REvil and Kaseya Ransomware) 

রেভিল একটি রাশিয়ান হ্যাকিং গ্রুপ, র‌্যানসামওয়ার-এজ-এ-সার্ভিস এর জন্যই তারা বিশেষভাবে পরিচিত। ২০২১ সালের জুলাই মাসে একটি সাইবার ক্রাইমের ঘটনা ঘটে যাকে “দ্য কেসিয়া ইনসিডেন্ট” বলেও ডাকা হয়। কেসিয়া কোম্পানির প্রোডাক্ট “SODINOKIBI REvil” এর র‌্যানসামওয়্যার এর শেষদিকে কাস্টমার নেটওয়ার্কে এই এটাক টি হয়; যেখানে পুরো বিশ্বের প্রায় ১০০০ জন কাস্টমার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। 

কয়েক ঘন্টার মধ্যেই রেভিল গ্রুপ এই এটাক এর কৃতিত্ব নেয় এবং ডার্ক ওয়েবের হ্যাপি ব্লগ ওয়েবসাইটে ৭০ মিলিয়ন ডলার দাবি করে। এই এটাক-টি এতোটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে ইউ এস সরকার রেভিল মেম্বার দের ধরিয়ে দেয়ার জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার পুরষ্কার দেয়ার ঘোষনা করে। তারপর ২২ বছরের এক ‍যুবক (Yaroslav Vasinskyi) এই এটাক এর জন্য ধরা পড়ে। 

ম্যারিয়ট হোটেলস ডাটা ব্রিচ (Marriot Hotels Data Breach)

২০১৮ সালের নভেম্বরে ম্যারিয়ট হোটেলসে ডাটা ব্রিচের ঘটনা ঘটে যার প্রভাব প্রায় ৫০০ মিলিয়ন কাস্টমারের ওপর পরে।  অপরিচিত পার্টির দ্বারা কাস্টমারদের অনেক তথ্য বেরিয়ে পরে যেমন: মেইল এড্রেস, পাসপোর্ট নাম্বার, ফোন নাম্বার ইত্যাদি। 

ম্যারিয়ট গ্রুপ সাথে সাথেই সাইবার সিকিউরিটি গ্রুপ নিয়োগ দেয় এবং ওয়েবসাইট ও কল সেন্টার বসায়। পাশাপাশি তারা কাস্টমার দের মেইল করে জানায় তাদের শেয়ার করা সব তথ্য পাওয়া গিয়েছে।

সাইবার ক্রাইম এর প্রভাব

২০১৮ সালে (McAfee) এর রিপোর্টে বলা হয় সাইবার ক্রাইমের জন্য প্রতি বছর প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। অর্থনৈতিক ক্ষতিটাই সাইবার ক্রাইমের সবচেয়ে বড় ক্ষতি এছাড়াও আরো কিছু প্রভাব থাকে সেগুলো হলো:

  • সিকিউরিটি ব্রীচের প্রভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্রেতাদের কাছে তাদের মূল্য, আস্থা, বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। এতে বিনিয়োগকারী অনেক কমে যায়, তাতে প্রতিষ্ঠানের মূলধন কমে যায়। 
  • অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাস্টমারদের ডাটা হারিয়ে যায়, যার ফলে বেশ বড় অংকের ক্ষতিপূরন দিতে হয়। 
  • সাইবার সিকিউরিটি কোম্পানি নিয়োগ দেয়ার ফলে অনেক খরচ বেড়ে যায়। যেমন: বীমা খরচ, পাবলিক রিলেশন (PR)।

সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধের উপায়

  • অ্যান্টিভাইরাস (antivirus), ফায়ারওয়ালস (firewalls) এর মতো সিকিউরিটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানের তথ্য সুরক্ষিত রাখা। 
  • পাবলিক কোন ওয়াইফাই নেটওয়ার্কে কানেক্ট না হওয়া এবং সেটি ব্যবহার করে লেনদেন বা ক্রয় না করা। 
  • অপরিচিত ওয়েবসাইট থেকে কোন  ফাইল ডাউনলোড না করা। 
  • অপরিচিত কোন ব্যাক্তিকে নিজের ব্যাক্তিগত তথ্য না দেয়া। 
  • কম্পিউটার বা নেটওয়ার্কে অপরিচিত কোন লগ-ইন হচ্ছে কিনা তা সাইবার ফায়ারওয়াল (cyber firewall) এর সাহায্যে যাচাই করা।
  • অননুমোদিত কোন ওয়েবসাইট ভিজিট করতে হলে নিজের তথ্যগুলোকে সিকিওর করে নেয়া। 
  • ভিপিএন (VPNs) ব্যবহার করা। যা আইপি এড্রেস অপ্রকাশিত রাখতে পারে।
  • কম্পিউটারের মূল্যবান তথ্য সংযুক্ত ফাইলে রেস্ট্রিকশন দিয়ে রাখা।
  • নিজের সব পাসওয়ার্ড কে যথেষ্ঠ শক্তিশালী ও ইউনিক রাখা। সব অনলাইন একাউন্ট এর পাসওয়ার্ড ভিন্ন রাখা এমনকি কিছুদিন পরপর তা পরিবর্তন করা। 
  • সব একাউন্টে মাল্টি-অথেনটিকেশন নিশ্চিত করা। 
  • অপরিচিত মেইল এড্রেস থেকে আসা মেইল বা মেসেজ ওপেন না করা।
  • সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত আইন জানা ও সাইবার ক্রাইম মামলা কিভাবে করে তা জানা।
  • সংবেনশীল কোন তথ্য সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার না করা। যেমন পোষা প্রাণীর নাম, স্কুল বা পরিবারের মানুষের নাম শেয়ার করলে হ্যাকার রা সেটা থেকে হিন্টস পেয়ে একাউন্ট পাসওয়ার্ড অনুমান করে ফেলতে পারে। 
  • বাচ্চাদের সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে শিক্ষিত করে তোলা এবং অনলাইনে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করা।
  • আর্থিক সাহায্য চাওয়া কোন ব্যাক্তিকে যাচাই না করেই সহায়তা না করা। 
  • সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধের জন্য টুল ব্যবহার করা। যেমন: (1)Kali Linux, 2) Ophcrack, 3) EnCase, 4) SafeBack, 5) Data Dumber)
  • কোম্পানি বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের তথ্যের ব্যাকআপ রাখা। সাইবার ক্রাইমের পর ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো যেনো সহজেই ব্যাক আপ রাখা তথ্য গুলোর দ্বারা দ্রুত কাজ শুরু করতে পারে। 

সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০১৫

সাধারনত ১৮-৩০ বছরের মেয়েরাই বেশী আক্রান্ত হচ্ছে সাইবার ক্রাইমে। সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০১৫, এই আইনের ১৪ ধারাতে বলা হয়েছে কোন ব্যাক্তির অন্তরঙ্গ ছবি তোলা হলে তার জন্য শাস্তি ১০ বছরের কারাদন্ড অথবা ১০ লাখ টাকা অথবা উভয়দন্ডে দন্ডিত। এই আইনের ১০ ধারায় আরো বলা হয়েছে কোন মেসেজ এর মাধ্যমে কোন ব্যাক্তিকে ক্ষতিগ্রস্থ করা হলে তার শাস্তি ৫ বছর কারাদন্ড অথবা ৩ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত। এছাড়াও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অন্যের প্রতি ক্ষোভ বা অপমানজনিত কোন মন্তব্য না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। 

শেষাংশ

ইতোমধ্যে সাইবার ক্রাইম অনেক বেড়ে গিয়েছে, ডিজিটাল ডিভাইস গুলোর প্রচুর ব্যবহার, অসচেতন ব্রাউজিং এর অন্যতম কারন। এই অলোচনায় সাইবার ক্রাইম মানে কি, সাইবার অপরাধের বিকাশে প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তবে প্রতিরোধের জন্য নিজে সচেতন থাকার বিকল্প নেই। আপনার সচেতনতাই আপনাকে রক্ষা করতে পারে সাইবার ক্রাইম নামক অপরাধ থেকে।

অনবরত জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

১। সবচেয়ে বেশি সাইবার অপরাধ কোনটি?

২০২২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারনেট অপরাধ অভিযোগ কেন্দ্রের রিপোর্ট অনুযায়ী ফিশিং হচ্ছে সবচেয়ে বেশীবার সংগঠিত হওয়া সাইবার ক্রাইম। প্রায় ৩০০ হাজার ব্যাক্তি ফিশিং এর ভুক্তভোগী।

২। সাইবার ক্রাইম কবে শুরু হয়? 

সাইবার ক্রাইম এর শুরুটা  ১৯৬২ সালে এমআইটি কম্পিউটারকে টার্গেট করে করা হয়েছিল। আর ক্রাইমটা ছিল ডাটাবেজ থেকে পাসওয়ার্ড হ্যাক করা। 

৩। সাইবার অপরাধ মানে কি?

কম্পিউটারে বা অনলাইনের সাথে যুক্ত অপরাধই হলো সাইবার ক্রাইম।

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Back to top button