অনলাইন ব্যাংকিংব্যাংকিং

ঋণ খেলাপি কি? খেলাপি ঋণ সম্পর্কে বিস্তারিত

ঋণ খেলাপি কি তা অনেকেরই অজানা। তবে বর্তমানে ঋণ খেলাপি (Debt default) বাংলাদেশের একটি অন্যতম জাতীয় সমস্যা। প্রতিনিয়তই দেশের অর্থনীতিকে রুখে দিচ্ছে এবং দেশকে দেউলিয়ার পথে নিয়ে যাচ্ছে ঋণ খেলাপি। ঋণ খেলাপি কি ও বাংলাদেশে ঋণ খেলাপির বর্তমান অবস্থাচিত্র থাকছে এই আলোচনায়।

দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিনিয়তই ঋণ খেলাপি বন্ধের চেষ্টা করছে। তবু খেলাপি ঋণের পরিমাণ গত ১০ বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩ গুণ। দেশের অর্থ বিভিন্ন বিনিয়োগক্ষেত্রে পুঞ্জিভুত অবস্থায় থেকে যাচ্ছে। ফলে জাতীয় প্রকল্পগুলোতে নিতে হচ্ছে বিদেশি ব্যাংকের ঋণ। কোনভাবেই আটকানো যাচ্ছেনা নতুন খেলাপি ঋণ। যা দেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।

ঋণ খেলাপি কি, বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের অবস্থা, পরিমাণ, ঋণ খেলাপি হওয়ার কারণ, দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব, ঋণ খেলাপির শাস্তি কি ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিত্রাণের উপায় নিয়ে বিস্তারিত থাকছে এই আলোচনায়।

সূচিপত্রঃ

ঋণ খেলাপি কি?

ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের ঋণপ্রদান চুক্তির শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান শর্ত হলো- নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এককালীন বা কিস্তিতে সুদসহ ঋণের আসল পরিশোধ করা। চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণ গ্রাহক ঋণের বা কিস্তির সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ না করলে/ পরিশোধ করতে অক্ষম হলে তাকে ঋণ খেলাপি বলে। আর যেই ঋণ বা ঋণের কিস্তি ফেরত পাওয়া যায় না বা সম্ভব হয় না, সেই অনাদায়ী অর্থের পরিমানই খেলাপি ঋণ।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ কার্যক্রম পরিচালনার প্রধান সমস্যা হলো ঋণ খেলাপি। দেশে ঋণ খেলাপির পরিমাণ বাড়ছে প্রতিনিয়তই। এর ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিও বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। 

অনাদায়ী ঋণের শ্রেনীবিভাগ

ঋণ গ্রাহকের কাছ থেকে অনাদায়ী ঋণের অর্থকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। যথা-

(১) ৩ মাসের বেশি ঋণ অনাদায়ী থাকলে তা ‘সাব স্ট্যান্ডার্ড (Sub Standard)’।

(২) ৬ মাসের বেশি ঋণ অনাদায়ী থাকলে তা ‘ডাউটফুল (Doubtful)’।

(৩) ৯ মাস থেকে ১ বছরের বেশি সময়ের জন্য ঋণ অনাদায়ী থাকলে তা ‘বেড ডেট (Bad Date), লস (Loss), কু-ঋণ (Bad Debt)’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করা হয়।

এখানে ঋণ খেলাপি কি বা কোনগুলো তার স্পষ্ট ধাপ রয়েছে। সাধারণত ৩-৬ মাস পর্যন্ত কোন ঋণ বা ঋণের কিস্তি অনাদায়ী থাকলে তা সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য। তবে ৬ মাসের বেশি ঋণ বা ঋণের কিস্তি অনাদায়ী থাকলে, তথা- ডাউটফুল (Doubtful) ও কু-ঋণ (Bad Debt) গুলোকে খেলাপি ঋণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের চিত্র

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের দিন দিন অবনতি হচ্ছে। আর এর মূলে রয়েছে ঋণ খেলাপি। দেশের ঋণ খেলাপির পরিমাণ এতটাই বেশি যা মোট ব্যাংকিং খাতের শতকরা হারেও প্রভাব ফেলেছে।

মার্চ ২০২৩ অনুযায়ী বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লক্ষ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। যা মোট ব্যাংক ঋণের ৮.৮০ শতাংশ। ২০২২ সাল পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের ৮.১৬ % খেলাফি ঋণে পরিণত হয়েছে। যা ২০২১ সালের শেষ সময়ে ছিল ৭.৯৩ %।

ডিসেম্বর ২০২২ থেকে মার্চ ২০২৩ পর্যন্ত, মাত্র ৩ মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

ঋণ খেলাপি কি ও তার প্রভাব বাংলাদেশ ব্যাংকের সংক্রান্ত ডিসেম্বর-২০২২ প্রান্তিক এর হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী নিম্নোক্ত তথ্য উঠে এসেছিল –

২০২২ সালে ডিসেম্বর মাসের শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট প্রধানকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ লক্ষ ৭৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে শুধুমাত্র খেলাপি ঋণের পরিমাণই ১ লক্ষ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। ২০২১-২০২২ সালে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৭ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা।

বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের ঋণ খেলাপির হার

বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাতে ব্যাংকগুলোকে রাষ্ট্রায়ত্ত, বেসরকারি, বিশেষায়িত ও বিদেশী ব্যাংকে ভাগ করা হয়েছে। বর্তমানে এসকল ব্যাংকের ঋণ খেলাপি কি পরিমানে হচ্ছে তা নিচে তুলে ধরা হলো:

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ঋণ খেলাপির হার

বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ঋণ খেলাপির হার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ও বেসিক – এই ৬টি ব্যাংকের ঋণ খেলাপির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।

২০২২ সালের ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণকৃত ঋণ ৭৮ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৬ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। যা সেই ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ২০.২৮ শতাংশ।

সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি। তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়া বেশি চিন্তাজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বেসরকারি ব্যাংকে ঋণ খেলাপির হার

বাংলাদেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ঋণ খেলাপি কি পরিমান তা পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে।  খেলাপি ঋণ বর্তমানে ৫৬ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা। মোট বিতরণকৃত ঋণের ৫.১৩ শতাংশ খেলাপি ঋণের অন্তর্ভুক্ত।

বিশেষায়িত ৩ ব্যাংকে ঋণ খেলাপির হার

বিশেষায়িত ৩ ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান হলো- কৃষি ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। বিশেষায়িত এই ব্যাংক গুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ- ৪ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। যা ব্যাংক গুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ১২.৮০ শতাংশ।

বিদেশি ৯ ব্যাংকে ঋণ খেলাপির হার

বিদেশি মালিকানাধীন ৯ ব্যাংকের গত ডিসেম্বর মাসের প্রান্তিক খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল- ৩ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। যা ব্যাংক গুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ৪ দশমিক ৯১ শতাংশ।

দেশের বিভিন্ন এনজিও সংস্থা থেকে শুরু করে সরকারি ব্যাংক পর্যন্ত রয়েছে খেলাপি ঋণের ভয়াবহতায়। ঋণ খেলাপি এর ক্ষতি কতটা প্রভাব ফেলতে পারে তা বর্তমানেই আন্দাজ করা যাচ্ছে।

খেলাপি ঋণের শীর্ষে থাকা ২০ ব্যাংকের তালিকা

বাংলাদেশে ঋণ খেলাপির শীর্ষে রয়েছে ২০টি ব্যাংক। এর মধ্যে ৫ টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এবং ১৫ টি বেসরকারি ব্যাংক। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ খেলাপির প্রায় ৭৫ শতাংশই এই ২০টি ব্যাংকের অন্তর্ভুক্ত। দেশের বাকি লিপিবদ্ধ ৪১ টি ব্যাংকের মধ্যে ঋণ খেলাপি রয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ।

বিশাল পরিমাণ এই ঋণ খেলাপি কি কি ব্যাংকে বেশি তার তালিকা নিচে দেওয়া হলো:

(১) জনতা ব্যাংকে।

(২) ন্যাশনাল ব্যাংক।

(৩) অগ্রণী ব্যাংক।

(৪) রূপালী ব্যাংক।

(৫) সোনালী ব্যাংক।

(৬) ইসলামী ব্যাংক।

(৭) আইএফআইসি ব্যাংক।

(৮) পূবালী ব্যাংক।

(৯) বেসিক ব্যাংক।

(১০) অগ্রণি ব্যাংক।

(১১) ওয়ান ব্যাংকের

(১২) ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক।

(১৩) এনআরবিসি ব্যাংক।

(১৪) আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক।

(১৫) উত্তরা ব্যাংক।

(১৬) পদ্মা ব্যাংক।

(১৭) ঢাকা ব্যাংক।

(১৮) এনসিসি ব্যাংক।

(১৯) শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক।

(২০) ট্রাস্ট ব্যাংক।

ঋণ খেলাপি হওয়ার কারণ

ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ হওয়া একটি সাধারণ বিষয়। তবে অতিরিক্ত মাত্রায় ঋণ খেলাপি কি কারনে হচ্ছে তার পিছনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। ঋণ খেলাপির পিছনে প্রধান যে কারণগুলো রয়েছে তা নিচে উল্লেখ করা হলো:

ঋণের সুদব্যবস্থা ও কিস্তি পরিশোধের সময়কাল

বাংলাদেশের ঋণ গ্রহীতারা ব্যাংক ঋণের সুদ নগদে প্রদান না করে ঋণের স্থিতির সাথে পরিশোধ করে। যা একটি ব্যাংক তার মুনাফা হিসেবে প্রকাশ করে। তবে সুদের অর্থ নগদে গ্রহণ না করে স্থিতির সাথে গ্রহণ করাও খেলাপি ঋণের বড় একটি কারণ।

ঋণ খেলাপি কি কারনে হচ্ছে তার অনেক উত্তর আছে। তবে, ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের সময়সূচি এবং কিস্তির ধরন ঋণ গ্রহীতার জন্য উপযুক্ত নয়। ঋণ গ্রহণের সময় ঋণ গ্রহীতা ব্যাংকের সেই নির্ধারিত সময়সূচী ও নীতিমালার শর্ত সহজেই মেনে নিলেও পরে তার বাস্তবায়ন করতে পারেনা। 

সাধারণত বড় অংকের ঋণ নিয়ে ঋণগ্রহীতা ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মূলধনের বিপরীতে কাঙ্খিত মুনাফা সবসময় নাও আসতে পারে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের অর্থ সর্বদা বিনিয়োগকৃত অবস্থায় থাকে। তাই বড় অংকের ঋণ নিলে তা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় অনেকেই।

ঋণ খেলাপি সমস্যা সমাধানে সুদের হার আদায় পদ্ধতি ও ঋণের কিস্তির সময়সূচীকে গ্রাহক উপযোগী করতে হবে।

ব্যাংক ওভারড্রাফট

ব্যাংক ওভারড্রাফট (Bank Overdraft) বা ব্যাংক জমাতিরিক্ত হচ্ছে এক ধরনের ঋণ ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে ব্যাংক একাউন্টে জমা টাকার বেশি উত্তোলন করার সুবিধা দেওয়া হয়। তবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই অতিরিক্ত টাকার জন্য ঋণ গ্রাহকদের সুদ দিতে হয়। প্রতিদিনের ভিত্তিতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এই সুদ চার্জ করে থাকে।

ব্যাংক ওভারড্রাফট এর মাধ্যমে গৃহীত ঋণের অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা ও ব্যাংকের কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকেনা। ফলে এলোপাথারি ভাবে ঋণের অর্থ ব্যবহৃত হওয়ায় ঋণ খেলাপি কি পরিমাণ বাড়ছে তা লক্ষনীয়। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করার মাধ্যমে এর সমাধান করা সম্ভব।

খেলাপি ঋণ নির্ধারণ পদ্ধতির যোগোপযোগী নয়

এদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী ক্লাসিফিকেশন অব লোনস বা সিএল (Classification of Loans – CL)  পদ্ধতি অনুসারে বিতরণকৃত ঋণের শ্রেণীবিন্যাস করে প্রভিশন রাখা হয়। 

তবে দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের আশঙ্কার তুলনায় সঠিক পরিমাণে প্রভিশন রাখা হয়না। ফলে কখনো কোন ঋনগ্রহীতা ঋণ খেলাপি হলে তার বিপরীতে প্রভিশন থেকে ঋণের অর্থ অবলোপন করা যায় না। 

ছদ্মবেশী খেলাপি ঋণ 

ভালো ঋণের বিপরীতে দেশে ছদ্মবেশী ঋণ খেলাপির পরিমাণ তুলনামূলক কম নয়। সাধারণত পুনঃতফসিলের সুযোগ নিয়ে নিম্নমানের ও ছোট ঋণকে ভালো ঋণ হিসেবে প্রকাশ করা হচ্ছে। এতে ২ ধরনের ক্ষতিসাধন হয়-

  • পর্যাপ্ত প্রভিশন রাখা হয়না।
  • ঋণের উপর নির্ধারিত সুদ নগদে আদায় না করা হলেও ব্যাংকের মুনাফা হিসেবে দেখানো হয়।

ব্যাংকের মুনাফার বড় অংশ লভ্যাংশ এবং বোনাস হিসেবে বিতরণ হয়। যার ফলে ব্যাংকের অবলোপনযোগ্য অর্থ থাকেনা ও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পায়।

স্বেচ্ছায় ঋণ খেলাপি

দেশের বহু অসাধু ব্যবসায়ী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ স্বেচ্ছায় ঋণ খেলাপি হয়ে থাকেন। তারা নানা অজুহাতে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেনা। কেউ কেউ ঋণ গ্রহণ করে স্মৃতিশক্তি হারানোর অভিনয় করে। কেউবা আবার ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করে বিদেশে পাড়ি জমায়। ঋণ জালিয়াতি, দুর্নীতিযুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তা, দেশের অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা ইত্যাদি নানা কারণে ঋণ খেলাপি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

জামানত নিয়েও ব্যাংকে কেন এত খেলাপি ঋণ?

ব্যাংক তার ঋণ গ্রাহকের কাছ থেকে জামানত নিলেও তা ঋণের বিপরীতে যথাযথ হয়না। 

ব্যাংক ঋণে জামানতের ধরন

বর্তমানে সাধারণত ৩ ধরনের জামানত দেখা যায়-

(১) অস্তিত্বহীন জামানত

ঋণগ্রহীতা অনেক সময় ভুয়া ও নকল জামানত প্রদান করে। এক্ষেত্রে মালিকানা ভিত্তিক সমস্যা থাকে। যদিও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা যথাযথভাবে যাচাই করে। তবুও কিছু ক্ষেত্রে সে জামানতের সত্যিকার অর্থে কোন অস্তিত্ব থাকে না।

(২) কম মূল্যের জামানত

কিছু ক্ষেত্রে ঋনগ্রহীতা ব্যাংককে জামানত দিলেও, ঋণের অর্থ পরিশোধের জন্য তার পর্যাপ্ত বাজার মূল্য থাকেনা। তাছাড়া জামানতের সেই সম্পদ বিক্রি করার ক্ষেত্রে বা নিলামে তুললেও সঠিক‌ মূল্য পাওয়া যায় না। তাই খেলাপি ঋণ কিভাবে আদায় হবে তা প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে তা অনাদায়যোগ্য থেকে যায়।

(৩) মানসম্মত বা যথার্থ জামানত

দেশের ঋণ ব্যবস্থায় খুব অল্পসংখ্যক জামানত যথাযথ ও মানসম্মত হয়। যা প্রকৃত জামানত এবং ঋণের অর্থ পরিশোধের বাজারমূল্য রয়েছে।

দেশের অধিকাংশ ব্যাংক ঋণের জামানতই অযোগ্য। এই বিবেচনায় বলা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৭০% ঋণ জামানতবিহীন। ফলে কোন ঋণ গ্রহীতা ঋণ খেলাপি হলে ঋণের অর্থ অবলোপন বা আদায় সম্ভব হয় না। 

এজন্য ব্যাংক সহজ শর্তে তার ঋণ খেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিল করে পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধি করছে। তবুও ঋণ পরিশোধ করছেন না অনেকেই। অনেকের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেও ফল পাওয়া যায়নি। 

খেলাপি ঋণ সৃষ্টিতে দায়ী কি?

ঋণ খেলাপি কি কারনে হচ্ছে সে বিষয়ে ঋণ গ্রাহককেই দায়বদ্ধ করা হয়। তবে এর পেছনে ব্যাংকের ঋণ নীতিমালা ও দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও দায়ী। খেলাপি ঋণ সৃষ্টিতে গ্রাহক ও ব্যাংকের দায় তুলে ধরা হলো:

খেলাপি ঋণ সৃষ্টিতে গ্রাহকের দায়

খেলাপি ঋণ সৃষ্টিতে ঋণগ্রহীতা সবচেয়ে বেশি দায়ী। নিম্নোক্ত কারণগুলোতে ঋণ গ্রহীতাকে দায়ী করা যায়-

  • নিজের পুঁজি স্বল্পতার জন্য ব্যাংকের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা।
  • সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ প্রদান করায় অপ্রয়োজনে বা অতিরিক্ত ঋণ নেওয়া।
  • ব্যাংকের কাছে তথ্য গোপন রেখে ঋণ সুবিধা গ্রহণ।
  • ঋণের বিপরীতে প্রকৃত ও পর্যাপ্ত বাজারমূল্য সম্পন্ন জামানত না দেওয়া।
  • ব্যাংক ঋণের অর্থ চলতি মূলধন হিসেবে ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে স্থায়ী সম্পদ ক্রয় করা। অনেকেই এ ধরনের কর্মকাণ্ড করে ব্যবসা পরিচালনায় ব্যর্থ হয় ও ঋণ খেলাপি হয়।
  • অর্থব্যবস্থাপনার যোগ্যতা না থাকলে ব্যবসায়িক ব্যক্তির পর্যাপ্ত মুনাফা না আসা খেলাপি ঋণের বড় কারণ।
  • ব্যবসায়িক অংশীদারদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি হলে ব্যবসা পরিচালনা ও ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা।
  • ঋণ গ্রহণের পর বিদেশে পাড়ি জমানো।

ইত্যাদি নানা কারণে ঋণ খেলাপির জন্য গ্রাহককে দায়ী করা যায়।

খেলাপি ঋণ সৃষ্টিতে ব্যাংকের দায়

ঋণ খেলাপি কি কারনে হয় তার পিছনে ব্যাংকের দায়বদ্ধতা-

  • ঋণগ্রহীতা নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন না করা এবং গ্রাহকের তথ্যের সত্যতা যাচাই না করা।
  • ঋণ গ্রহীতার সিআইবি (CIB) রিপোর্ট তদারকি না করা। 
  • পর্যাপ্ত জামানত না নেওয়া। এছাড়া জামানাতে দলিলপত্র ও মালিকানা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে অনুমোদন দেওয়া।
  • গ্রাহকের প্রয়োজন বিবেচনা না করে অতিরিক্ত ঋন দেওয়া।
  • ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তার স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি।
  • বহিঃস্থ ক্ষমতার প্রেক্ষিতে ঋণ অনুমোদন দেওয়া। 
  • বিতরণকৃত ঋণ ব্যবস্থাপনায় গ্রাহকের উপর তদারকি না করা।

এছাড়াও ব্যাংকের সুদ ব্যবস্থাপনা, কিস্তি পরিশোধের নির্ধারিত সময়কাল অন্যতম কারণ।

বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের প্রভাব

দেশের অর্থনীতিতে ঋণ খেলাপি কি পরিমান প্রভাব ফেলে তা উপরোক্ত খেলাপি চিত্রেই বোঝা যায়। ব্যাংকিং খাতে খেলাটি ঋণের প্রভাবগুলো হলো-

  • ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণ বা বিনিয়োগ গ্রাহকের কাছে আটকে যাওয়া।
  • বিনিয়োগের বিপরীতে ব্যাংককে কর দিতে হয়। পরে একদিকে বিনিয়োগ থেকে কোন লভ্যাংশ আসছে না অন্যদিকে বাড়তি খরচ।
  • ব্যাংকের মুনাফা কমে যায়।
  • ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দেয়। যার ফলে ব্যাংক নতুন ঋণ দিতে পারেনা।
  • ব্যাংকের নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে এবং মূলধনের উপর প্রভাব পড়ে।

এছাড়া দেশের নতুন উদ্যোক্তা তৈরি ও অবকাঠামগত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। ঋণ খেলাপি বেশি হওয়ায় বিদেশি ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা পাওয়া যায়না। তাছাড়া খেলাপি ঋণ না থাকলে বাংলাদেশের বড় প্রকল্প গুলো দেশীয় অর্থায়নে করা যেত।

খেলাপি ঋণ কিভাবে আদায় করা যায়

গ্রাহকের সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক সুবোধ ছাড়া খেলাপি ঋণ আদায় করা সম্ভব নয়। অনেক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ঋণ গ্রহীতার বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে মামলা করে গেলেও ঋণের অর্থ আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া তাদের পর্যাপ্ত জামানত না থাকায় ব্যাংক তার প্রাপ্য অর্থ পাচ্ছেনা। 

তাই ঋণ খেলাপি কি উপায়ে আদায় করা যায় তার বিশেষ কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন-

  • ঋণ গ্রহীতাকে পর্যাপ্ত সময় দিয়ে, সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে ঋণ আদায়।
  • রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন।
  • প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ।
  • ঋণ মওকুফ, ঋণের পুনঃতফসিল করা ঋণের অবলোপন হ্রাস করা। 
  • ব্যাংকিং নীতিমালা বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে প্রণয়ন করতে হবে।

দেশের সরকার বর্তমানে ঋণ খেলাপিদের নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করছে। যা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে তা পরবর্তী সময়েই বলা সম্ভব।

খেলাপি ঋণ আদায়ের কৌশল

খেলাপি ঋণ আদায়ের কিছু কার্যকরী কৌশল নিচে উল্লেখ করা হলো:

খেলাপি ঋণ আদায়ে দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা 

বাংলাদেশের ঋণ খেলাপি প্রায় অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় ধরেই চলমান। শুধুমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংক বা একটি মাত্র ব্যাংকের পক্ষে দেশের খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব নয়। স্বল্প সময়ে এই জাতীয় সমস্যা থেকে উত্তরণও সম্ভব নয়। তাই সকল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত নীতিমালা প্রবর্তন করে দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন।

খেলাপি ঋণ আদায়ে অভিজ্ঞ ব্যাংকারদের গুরুত্ব

ঋণ খেলাপি কিভাবে আদায় করা যায় তার বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যাংক কর্মকর্তার প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা ব্যাংক কর্মকর্তার অধিকাংশই ঋণ খেলাপিতে বাস্তবমুখী ব্যবস্থা নিতে অক্ষম। শুধু আইনি ব্যবস্থার উপর জোড় না দিয়ে অভিজ্ঞ ব্যাংকারদের কর্মপরিকল্পনা নিশ্চিত করতে হবে। 

ঋণ খেলাপি কমানোর উপায়

দেশের পুঞ্জিগত খেলাপি ঋণ আদায়ের সুব্যবস্থার পাশাপাশি যাতে নতুন ঋণ খেলাপি তৈরি না হয় সেদিকে বিশেষ জোর দিতে হবে। সেজন্য ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে:

  • সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্য সকল ব্যাংককের সংঘবদ্ধ ব্যবস্থাপনা।
  • ঋণ পরিশোধের মেয়াদকাল বৃদ্ধি ও সুদের হার কমাতে হবে।
  • ঋণ বিতরণে ঋণগ্রহীতা সহ তার পারিবারিক সদস্য ও ঋণের গ্যারান্টারদের বিস্তারিত তথ্য যাচাই করতে হবে। 
  • ঝুঁকিপূর্ণ এবং বড় ঋণগুলোকে বীমার আওতায় আনতে হবে।
  • ঋণের বিপরীতে জামানতের সম্পত্তির সঠিক চলতি বাজারমূল্য যাচাই করা।
  • ব্যাংক ও ব্যাংকারদের উপর রাজনৈতিক প্রভাবশালীতা দূর করতে হবে।
  • ঋণ গ্রহীতাদের সুদ অবহার সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ঋণের অর্থ আদায়।
  • ব্যাংক কর্মকর্তাদের ঋণ প্রদানে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করা।
  • আদালতের মামলা দীর্ঘদিন পুস্তকগত না রেখে আইনি প্রক্রিয়া আরও উন্নত ও সংস্কার করা।
  • খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের কালো তালিকা প্রকাশ এবং ভবিষ্যতে ঋণ না দেওয়া।
  • একই খাতে বেশি ঋণ না দিয়ে বিভিন্ন খাতে ঋণ দিতে হবে।
  • কিছু ক্ষেত্রে আদালতের মামলা এড়িয়ে গ্রাম পঞ্চায়েত, মহল্লা উন্নয়ন কমিটি, বণিক সমিতি ইত্যাদি পর্যায়ে খেলাপি ঋণ আদায় করা বেশি কার্যকর।

এভাবে দীর্ঘদিনের ব্যবস্থাপনায় খেলাপি ঋণ রোধ করা সম্ভব।

ঋণ পরিশোধে ঋণ খেলাপিরা কি কি সুবিধা পাবেন 

সাধারণ ঋণ খেলাপিদের ঋণের অর্থ পরিশোধে নিম্নোক্ত সুবিধাগুলো দিতে হবে:

বাড়তি সময় দেওয়া

কোন ঋণগ্রহীতা ঋণের বা কিস্তির নির্ধারিত সময়ের ৯০ দিন পর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ না করলে, ঋণদাতার কাছে ৬০ দিনের নোটিশ পাঠানো হবে। অন্য ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্বে এটি বাধ্যতামূলক। এই সময়ের মধ্যে ঋণ দিতে ব্যর্থ হলে, ব্যাংক তার জামানতের সম্পত্তি বিক্রি করতে পারবে। তবে বিক্রির পূর্বে আরও ৩০ দিন সময় দিতে হয়।

জামানতের সঠিক মূল্য প্রাপ্তি

বাড়তি সময়ের মধ্যেও ঋণের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঋণ গ্রহীতার জামানত নিলামে উঠানো হবে। নিলামের পূর্বে নির্ধারিত মূল্যের উল্লেখ করে নোটিশ পাঠাতে হবে। ঋণ গ্রহীতার পরিচিত কেউ এর থেকে বেশি মূল্যে সম্পত্তি ক্রয় করলে ব্যাংককে জানাতে হবে।

নিলামের অতিরিক্ত অর্থ প্রাপ্তি

জামানত নিলামে বিক্রির পর, সে অর্থ থেকে ঋণ পরিশোধ করে বাড়তি অর্থ ঋণ গ্রহীতাকে দিতে হবে।

সম্পত্তি অধিগ্রহণে বাধা

এছাড়াও ঋণ গ্রহিতার সামর্থ্য থাকলে সম্পত্তি অধিগ্রহণে আপত্তির চিঠি দিতে হবে। এতে সর্বনিম্ন ৭ দিন সময় পাবেন।

বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ খেলাপিদের আরো নানা সুবিধা দিয়ে থাকে 

ঋণ খেলাপির শাস্তি

ঋণ খেলাপির বিপরীতে ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি তার জামানতকৃত সম্পত্তির উপর ব্যবস্থা জারি করতে পারবে। নিচে ঋণ খেলাপির আইন বিষয়ক কয়েকটি ব্যবস্থা উল্লেখ করা হলো:

(১) ঋণ গ্রহীতা ঋণ খেলাপি হলে গ্যারান্টরের উপরও দায় বর্তায়। ফলে ঋণ না নিয়েও গ্যারান্টার ঋণ খেলাপি হয়। ঋণ পরিশোধের জন্য তার বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

(২) ঋণ খেলাপি কি করেন এবং তার জামানতের পক্ষে মিথ্যা বক্তব্য দেওয়া দন্ডনীয়। উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৬ মাস মেয়াদে কারাদণ্ডে অথবা অনধিক ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

(৩) ব্যাংকের অন্যান্য বিধি, আদেশ, নির্দেশনা, গাইডলাইন, পরিপত্র জারির ক্ষমতা রয়েছে। ঋণ পূরণকল্পে, সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা এ সমস্ত বিধি আরোপ করতে পারবে।

(৪) ঋণগ্রহীতার জামাতের ধারক প্রতিষ্ঠান আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত হলে, উক্ত প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নিযুক্ত প্রশাসক বা নির্বাহী সরকারি সিকিউরিটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিযুক্ত হতে পারবে। নিযুক্ত প্রশাসক বা নির্বাহী উক্ত প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধীন সরকারি সিকিউরিটির বিষয়ে আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারবে।

(৫) ঋন ধারকের মৃত্যু হলে মৃত্যুর পর আইনানুগ প্রক্রিয়ায় নমিনি পরিবর্তন বা বাতিল না হলে, ধারকের মনোনীত নমিনিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বা জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর নির্ধারিত পদ্ধতিতে সরকারি পাওনা অর্থ দিতে হবে।

(৬) নাবালক বা মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি অনূর্ধ্ব ১ লক্ষ টাকা মূল্যমানের সরকারি সিকিউরিটির ধারক হলে বাংলাদেশ ব্যাংক উক্ত সিকিউরিটির স্বত্ব উক্ত নাবালক বা মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তির উপযুক্ত প্রতিনিধির উপর ন্যস্ত করতে পারবে।

এছাড়াও ব্যাঙ্ক তার বিধিমালা অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোন ব্যক্তি ঋণ ঔঔপরিশোধ না করলে, তার কাছে নোটিশ প্রেরণ করবে। নোটিশে নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পরও যদি ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে ঋণের জামানত নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারবে।

শেষকথা

সম্পূর্ণ আলোচনায় ঋণ খেলাপি কি -তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের ঋণ খেলাপি সমস্যা দীর্ঘদিনের হলেও বর্তমানে তা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। এখন থেকেই যদি ভবিষ্যতে নতুন ঋণ খেলাপি সৃষ্টির পথ বন্ধ না করা হয়, তাহলে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার পাশাপাশি অবকাঠামগত উন্নয়নও থেমে যাবে। হতে পারে দেশ দেউলিয়া হওয়ার কারণ।

অনবরত জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

১। ঋণ পুনঃতফসিল কি?

ঋণ পুনঃতফসিল বলতে বোঝায়, কোনো একটি ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত সময়সীমা কমানো বা বাড়িয়ে দেওয়া। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঋণ পুনঃতফসিল বলতে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়াই বোঝায়। 

২। মৃত ব্যক্তির ঋণ খেলাপি কিভাবে আদায় করবে?

ঋণগ্রহীতা মৃত্যুবরণ করলে তার উত্তরাধিকারগন ঋণ পরিশোধ করবে। তারা ঋণ পরিশোধ না করলে জামানতকৃত সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যাংক অর্থ ফেরত নেবে।

৩। ঋণ অবলোপন বা রাইট অফ বলতে কী বোঝায়?

ব্যাংক ব্যবস্থায় কু-ঋণ শ্রেণিতে লিপিবদ্ধ খেলাপি ঋণ ব্যালান্স শিট (Balance Sheet) থেকে বাদ দেওয়াকে ঋণ অবলোপন বলে। যদিও এ ধরনের ঋণগ্রহীতা ঋণের সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ না করা পর্যন্ত তা খেলাপি ঋণ হিসেবে বিবেচিত হয়। ২০০৩ সাল থেকে দেশের ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলো অবলোপন করে আসছে।

৪। বর্তমানে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ কত?

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লক্ষ্য ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে তা প্রায় ছয় গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

৫। ঋণ খেলাপি নিয়ন্ত্রণে ঋণদাতারা কোন পদ্ধতি ব্যবহার করে?

বর্তমানে ঋন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ খেলাপি নিয়ন্ত্রণে নিম্নোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করে-

  • যথাযথ মূল্যের জামানাতের প্রতিশ্রুতি।
  • তৃতীয় পক্ষের ক্রেডিট গ্যারান্টি।
  • সিআইবি রিপোর্ট বিশ্লেষণ।
  • ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের খাত পরিহার।

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Back to top button