টেকনোলজিমোবাইল ফোন

মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকগুলো কি কি?

মোবাইল ফোনকে একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা আবিষ্কারগুলোর একটি বলে গন্য করা হয়। একসময় বিলাসিতা হিসেবে গন্য করা হলেও বর্তমানে মোবাইল ফোন সকলের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সারা বিশ্বকে হাতের মুঠোতে এনে দিয়ে জীবনযাত্রা সহজ করেছে যেই মোবাইল ফোন, তার ও রয়েছে কিছু ক্ষতিকর দিক। ভালো কোনো কিছুর অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের বরং ক্ষতি করে থাকে। ইদানীং কালে মোবাইল ফোনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ক্ষতিকর দিকগুলোর সম্মুখীন হতে হচ্ছে সকলকেই৷ আজকের এ লেখাতে মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে। 

মোবাইল ফোন ব্যবহারে শারীরিক ক্ষতিসমূহ

মোবাইল ফোন একটি নিত্য প্রয়োজনীয় ডিভাইস। এটি ব্যবহার করা ছাড়া যেহেতু এই আধুনিক যুগে জীবনযাত্রা কল্পনা করা সম্ভব নয় সেহেতু পরিমিত ব্যবহার করতেই হবে, তবে অতিরিক্ত ব্যবহারে বিভিন্ন শারীরিক ক্ষতির স্বীকার হতে হয়। যেমনঃ 

  • চোখ জ্বালা করাঃ সাধারনত ২ ঘন্টার বেশি সময় ধরে মোবাইল ফোন সহ যেকোন ইলেকট্রনিক স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ জ্বালা করা শুরু করে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা মনে হয় এমনকি অনেকক্ষেত্রে চোখ খোলা রাখতেও ক্লান্তিবোধ হয়। মোবাইল ফোন এখন ইন্টারনেট ব্যবহার সহ নানান কাজে ব্যবহার হওয়ায় অনেকেই দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকেন, ফলে চোখের এই সমস্যাটি হয়ে থাকে। এমনকি এর ফলে চোখের দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • টেক্সট নেকঃ মোবাইল ফোন সাধারনত আমরা হাতে নিয়ে ব্যবহার করি৷ অর্থাৎ মোবাইল স্ক্রিনের দিকে আমাদের তাকাতে হয় ঘাড় বাঁকিয়ে নিচের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে। মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে এই পজিশনে দীর্ঘক্ষন থাকলে যে ঘাড়ব্যথা হয় একে টেক্সট নেক বলা হয়ে থাকে। এভাবে ঘাড়ব্যথা প্রতিনিয়ত হতে থাকলে তা অন্যান্য শারীরিক অসুবিধার সৃষ্টি করে৷ 
  • ক্লান্তিঃ মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে শারীরিক পরিশ্রম কম করা হয়। এ সমস্যাটা প্রধানত শিশু কিশোরদের সাথে বেশি হয়ে থাকে। একদিকে কায়িক শ্রম না হওয়া, অন্যদিকে একটানা মোবাইল ফোনের ব্যবহার শরীরে অবসাদ নিয়ে আসে, ফলে সারাদিন শরীর ক্লান্ত অনুভব হয়।
  • কানে সমস্যাঃ অনেকে মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় সর্বক্ষন কানে হেডফোন লাগিয়ে রাখেন। উচ্চশব্দে হেডফোনে কান শোনার ফলে কানের অভ্যন্তরে এর প্রভাব পড়ে ও এতে পরবর্তিতে শ্রবণ শক্তি কমে যায়। এছাড়া কানের অন্যান্য ক্ষতিও হয়ে থাকে। 
  • জীবাণুর আক্রমনঃ একটি মোবাইল ফোনে টয়লেট সিটের চেয়েও দশগুন বেশি ক্ষতিকর জীবাণু থাকে। এসব জীবাণু থেকে নানারকম অসুখে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় যদি মোবাইল ফোন অতিরিক্ত ব্যবহার করা হয়। E.Coli সহ এমন অনেক জীবাণু রয়েছে যা জ্বর, সর্দি কাশি থেকে শুরু করে অন্যান্য অনেক রোগের কারন হতে পারে। মোবাইল ফোন অতিরিক্ত ব্যবহার করা মানে এসব জীবাণুর সংস্পর্শের ঝুঁকিতে বেশি সময় ধরে থাকা। এভাবে মোবাইল ফোন শারীরিক অসুখের কারন হয়ে থাকে।

মোবাইল ফোন ব্যবহারে মানসিক ক্ষতিসমূহ

মোবাইল ফোনের শারীরিক ক্ষতির তুলনায় মানসিক ক্ষতি বেশি করে থাকে৷ মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারকে এক ভয়াবহ হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন মনোবিজ্ঞানীরা। 

  • ঘুমে ব্যাঘাতঃ মোবাইল ফোন ব্যবহারে প্রায় সকলের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে৷ মোবাইল ফোন এর অতিরিক্ত ব্যবহারের শারীরিক প্রভাবে ঘুম আসতে দেরী হয়, প্রতি রাতের যে “স্লিপ শিডিউল” তা বিঘ্নিত হয় এবং পর্যাপ্ত ঘুমানো সম্ভব হয়না। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে সারাদিন মেজাজ খিটখিটে থাকে। ঘুমাতে যাবার ঠিক আগে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা অনিদ্রা বা Insomnia রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়৷ 
  • দুশ্চিন্তাঃ গবেষনায় দেখা গিয়েছে কিশোর বয়সী কলেজ ছাত্ররা যারা মোবাইল ফোন অতিরিক্ত ব্যবহার করে থাকে, তারা বাকিদের চেয়ে অধিক দুশ্চিন্তায় ভুগে এবং খারাপ সময়ে খুব বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এমনটা ঘটে থাকে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়ার কারনে। 
  • ডিপ্রেশনঃ মোবাইল ফোন ব্যবহারে ডিপ্রেশনে পড়ার কয়েকরকম কারন রয়েছে। মোবাইল ফোন ব্যবহারে কম ঘুমানো, মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ইত্যাদি একসময় ডিপ্রেশনের দিকে ধাবিত করতে পারে ধীরে ধীরে। অন্যদিকে, সোশ্যাল মিডিয়াতে ভার্চুয়াল জগতের নানান ব্যাপার এর ফলে সৃষ্ট হীনমন্যতা থেকেও একপর্যায়ে ডিপ্রেশনে রূপ নিতে পারে৷ 
  • নোমোফোবিয়াঃ এটি একরকম ফোবিয়া বা ভয় যা মোবাইল ফোনের কারনে সৃষ্ট৷ মোবাইল ফোন বেশ দামী ও সর্বক্ষনের সঙ্গী হওয়ায় ব্যবহারকারীরা সর্বদা তা নিয়ে বেশ সতর্ক থাকেন। তা সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে রূপ নেয় ফোবিয়াতে৷ তাদের মধ্যে মোবাইল ফোন হারিয়ে ফেলার বা ঠিক জায়গায় আছে কিনা সর্বদা তটস্থ থাকার এই ফোবিয়া বা ভয় এর রোগকে মনোবিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘ নো মোবাইল-ফোন ফোবিয়া ‘ বা নোমোফোবিয়া। 

মোবাইল ফোন ব্যবহারে অন্যান্য ক্ষতিসমূহ 

  • মোবাইল ফোন ব্যবহার কাজে মনোযোগ নষ্ট করার মাধ্যমে নানারকম সমস্যার সৃষ্টি করে। এর সবচেয়ে ভয়াবহ উদাহরণ হচ্ছে গাড়ির দূর্ঘটনা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, গাড়ি ড্রাইভ করার সময় মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকার ফলে চালক ঠিকমতো মনোযোগ দিতে না পারায় দূর্ঘটনা ঘটে যায়। এতে অনেক প্রাণহানি ঘটে। বর্তমানে এ ধরণের দূর্ঘটনার সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়ছে।
  • মোবাইল ফোন ব্যবহার কাজের উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়। যারা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন বা মোবাইল বেশি ব্যবহার করেন তাদের একটি প্রবণতা থাকে কাজের ফাকে ফাকে মোবাইল চেক করার, কোনো মেসেজ আসলো কিনা, কোনো কল আসলো কিনা। আবার অনেকে একই সাথে মোবাইল চালানো এবং পড়াশুনা, অফিসের কাজ ইত্যাদি করতে চান। কিন্তু গবেষনা বলছে, এই ধরণের মাল্টিটাস্কিং আপনার মনোযোগ ভাগ করে দেওয়ার ফলে, আপনার প্রোডাক্টিভিটি কমে যায়৷ অর্থাৎ, আপনি পূর্ণ মনোযোগ দিলে যে কাজটি এক ঘন্টায় করতে পারতেন, মোবাইল চালাতে চালাতে সে কাজটি করতে গেলে বা মাঝে মাঝে মোবাইলে মনোযোগ দেওয়ার ফলে একই কাজটি করতে আপনার আগের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগবে। সেজন্য কাজ বা পড়াশোনার সময় মোবাইল ফোন বাদ দিয়ে কাজটিতে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া উচিত। 
  • মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে ঘুম কম হয়ে থাকে। বিজ্ঞান বলে, আমাদের মেমরিতে কোনো তথ্য গেঁথে যাওয়ার জন্য অবশ্যই ঘুমের গভীরতম পর্যায়ে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু যেহেতু মোবাইল ফোন ব্যবহারে ঘুম কম হয়, তাই ডিপ স্লিপ খুব একটা হয়না বা খুব অল্প সময়ের জন্য হয়৷ তাই, কোনো কিছু বেশিদিন মনে থাকেনা, যেহেতু তা মেমরি সেলে গেঁথে নেওয়া সম্ভব হয়নি ডিপ স্লিপ স্টেজে না যেতে পারার কারনে। একারনে পড়াশোনার বিষয়বস্তু দ্রুত ভুলে যায় শিক্ষার্থীরা, যা তারা পর্যাপ্ত ঘুমাতে পারলে দীর্ঘদিন মনে রাখতে পারতো।

মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর দিক এড়ানোর উপায়

  • প্রয়োজন ছাড়া অপ্রয়োজনীয় কাজে মোবাইল ফোন ব্যবহার করবেন না। অবসর সময় কাটাতে খেলাধুলা বা অন্যান্য উপায় বেছে নেওয়ার চেষ্টা করুন।
  • ঘুমাতে যাবার ২ ঘন্টা আগে থেকেই মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধ করে দিবেন। এতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবেনা ও যথাসময়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারবেন। যেমন, যদি আপনি চান যে ১১ টা বাজে ঘুমিয়ে পড়বেন, তাহলে ৯ টার পর থেকেই আর মোবাইল ব্যবহার করবেন না। এতে ঘুম আসতে আর দেরী হবেনা। 
  • একটানা বেশিক্ষন মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকবেন না। মোবাইল ফোন যদি ব্যবহার করতেও হয়, একটু পর পর ব্রেক নিয়ে তাকাবেন। চোখ যতটা স্ক্রিন থেকে দূরে রেখে কাজ করা যায় ততই উত্তম।
  • কাজের সময় যাতে মোবাইলের বিভিন্ন এপ্লিকেশন আপনার মনোযোগের ব্যাঘাত না ঘটায় তাই ওই সময়ে মোবাইলের সকল এপ্লিকেশন এর নোটিফিকেশন অফ করে রাখবেন। আপনি চাইলে প্লেস্টোর থেকে অ্যাপ লক ডাউনলোড করে এ সময়ে সকল অ্যাপকে লক করে রাখতে পারেন যাতে কাজের সময় আপনি চাইলেও এসব অ্যাপে ঢুকে সময় নষ্ট করতে না পারেন। 
  • হেডফোনে উচ্চ আওয়াজে কিছু শোনা যাবেনা। খুব প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার দরকার নেই, এবং করলেও তাতে শব্দের মাত্রা কম থাকা উচিত। হেডফোনের ফলে কানে জীবাণুর আক্রমনের সম্ভাবনাও বাড়ে তাই এর চেয়ে মোবাইলের স্পিকার ব্যবহার ই উত্তম।

 

শেষকথা

মোবাইল ফোন ব্যবহার না করে আধুনিক এ যুগে জীবনযাপন প্রায় অসম্ভব, অন্যথায় যুগের তুলনায় পিছিয়ে পড়তে হবে। তবে পরিমিত ব্যবহারের চেয়ে বেশি ব্যবহার করলে এর রয়েছে নানাবিধ ক্ষতিকর দিক৷ আজকের লেখাটি থেকে মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর দিকসমূহ সম্পর্কে আপনারা জেনে উপকৃত হয়েছেন এবং এসব ক্ষতিকর দিক থেকে বেঁচে চলার চেষ্টা করবেন, এমনটাই কামনা করছি।

অনবরত জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

১) মোবাইল ফোন একটানা কতক্ষন ব্যবহার করলে শরীরের ক্ষতি হয়? 

মোবাইল ফোন এর স্ক্রিনের দিকে একটানা বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকলে চোখের অসুবিধা হয়, যা আর্টিকেলটিতে ব্যাখ্যা কর হয়েছে। আপনার কাজের স্বাপেক্ষে ব্যবহার করার সময়কাল বেশি লাগতেই পারে। তবে চেষ্টা করবেন মাঝে মাঝে ব্রেক নেওয়ার, একটানা যাতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে না হয়। যদি কাজের চাপ থাকেও ১৫-২০ মিনিট পরপর অল্প কিছুক্ষন ব্রেক নেওয়া উচিত।  

২) মোবাইল স্ক্রিন কতটুকু দূরত্বে থাকলে নিরাপদ?

এর কোনো সঠিক হিসাব নেই। আপনি নিজেই বুঝবেন কত কাছে আনলে মোবাইলের আলোতে আপনার চোখ জ্বাল শুরু করে। তবে, মানুষের স্বাভাবিক দৃষ্টিসীমার হিসেবে চোখ থেকে ২৫ সে.মি দূরের বস্তু সবচাইতে স্পষ্ট দেখে, ব্যক্তিভেদে তা পরিবর্তন হয়। দূরত্বের হিসাব টা অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারচেয়ে বরং যে দূরত্বেই হোক কতটা কম ব্যবহার করা যায় সে চেষ্টা করা উচিত। 

৩) মোবাইল আসক্তি কমাবো কিভাবে? 

মনোবল শক্ত রাখতে হবে। যদি কাজের কোনো ক্ষতি না হয়ে থাকে, ৩ দিন সম্পূর্ণভাবে মোবাইল থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতে পারেন। সাধারনত এরপর অভ্যাসে কিছুটা পরিবর্তন আসে। এছাড়াও, যেসব অ্যাপ এর কারনে আপনার মোবাইল আসক্তি, সেসব অ্যাপ আনইনস্টল করেও এই আসক্তি কমাতে পারেন। এতে শুরুতে কষ্ট হলেও ভবিষ্যৎ চিন্তা করলে অবশ্যই লাভজনক। 

৪) মোবাইলের তরঙ্গ কি হৃদপিন্ডের বা মস্তিষ্কের কোনো ক্ষতি করে? 

এখনো অব্ধি কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষনায় এ ধরণের কোনো তথ্য জানা যায়নি। মোবাইল ফোন থেকে নির্গত তরঙ্গ অত শক্তিশালী কিছু নয়। 

 

তথ্যসূত্রঃ

১) Psychguides.com

২) Sciencedirect.com

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button