প্রতিবন্ধী ভাতা কি? প্রতিবন্ধী ভাতা আবেদনের নিয়ম
প্রতিবন্ধী ভাতা (Disability Allowance) সমাজসেবা অধিদপ্তরের একটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। দেশের প্রতিবন্ধী নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণ, সামাজিক মর্যাদা এবং নানান সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ ভাতা কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়। আগে প্রতিবন্ধী ভাতা আবেদন করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভায় গিয়ে বিভিন্ন জটিলতার সম্মুখীন হতেন অনেকেই। কিন্তু বর্তমানে প্রতিবন্ধী ভাতার আবেদন গ্রহণ প্রক্রিয়া অনলাইন ভিত্তিক হয়ে গেছে।
আপনি/আপনার পরিবারের সদস্য/প্রতিবেশীরা নিজেরাই মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহার করে প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য আবেদন করতে পারবেন। তারপর উপজেলা সমাজসেবা অফিসে চূড়ান্ত আবেদন জমা দেয়ার পর, কোনো প্রার্থী এই ভাতার আওতাভুক্ত হলে মোবাইল ব্যাংকিং (Mobile Banking) মাধ্যমে জিটুপি (G2P) পদ্ধতিতে তার কাছে ভাতার টাকা পৌঁছে যাবে।
তাই সঠিকভাবে আবেদন করতে, ভাতা প্রাপ্তির যোগ্যতা, অযোগ্যতা, প্রতিবন্ধী ভাতা আবেদনের নিয়ম, উপজেলা সমাজসেবা অফিসে আবেদন, ভাতার টাকার পরিমাণ, শর্তাবলী ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে আজকের লেখা থেকে।
সূচিপত্রঃ
প্রতিবন্ধী ভাতা কী?
বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী নাগরিকদের জীবনযাত্রা সহজ করার লক্ষ্যে প্রতিবন্ধী ভাতা কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল। ২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাহায্যার্থে এই কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে স্বল্প সংখ্যক প্রতিবন্ধী এই ভাতার আওতাভুক্ত হয়েছিল। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে, প্রায় ২৯ লক্ষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এই ভাতার সুবিধাভোগী হয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাই এই কর্মসূচির সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ভাতার অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর ভাতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অসহায় প্রতিবন্ধীদের ভোগান্তি অনেকাংশে কমেছে। যদিও অনলাইনে নিজে নিজে আবেদন করতে না পারলে, স্থানীয় জনপ্রশাসন কার্যালয়ে (ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভায়) আবেদন ফরম পূরণ করে জমা দেয়া যাবে। পরবর্তীতে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পুনরায় অনলাইনে সেই আবেদন সাবমিট করবেন।
অনলাইনে আবেদন করার পর উপযুক্ত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হলে মোবাইল ব্যাংকিং মাধ্যমেই ভাতার টাকা পৌঁছে যায়।
প্রতিবন্ধী ভাতা প্রাপকের যোগ্যতা ও শর্তাবলী
প্রতিবন্ধী ভাতা পাওয়ার জন্য আবেদনকারীকে নিম্নোক্ত শর্তাবলী পূরণ করতে হবেঃ
- আবেদনকারী যেই এলাকা থেকে আবেদন করবে সেই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে।
- আবেদনকারী শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী হলেই কেবল, এই প্রতিবন্ধী ভাতা পাবেন।
- প্রতিবন্ধিতার প্রমাণপত্র হিসেবে সুবর্ণ নাগরিক কার্ড থাকতে হবে। সমাজসেবা কার্যালয়ের অনলাইন ডাটাবেজে (Online database) নিবন্ধন করে এই পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যে জেলার স্থায়ী বাসিন্দা সে জেলা থেকে নিবন্ধন করে ও পরিচয়পত্র গ্রহণ করতে হবে।
- প্রার্থীকে উপজেলা সমাজসেবা অফিসের সংশ্লিষ্ট বাছাই কমিটি কর্তৃক নির্বাচিত হতে হবে।
প্রতিবন্ধী ভাতা প্রাপ্তির অযোগ্যতা
আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও এই ভাতার আওতাভুক্ত হবেন না। আর সেগুলো হলোঃ
- প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যদি সরকারি কর্মচারী হন কিংবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী হিসেবে পেনশনভোগী হন তবে তিনি ভাতার টাকা পাবেন না।
- আবেদনকারী অন্যকোনো কর্মসূচির আওতায় নিয়মিত সরকারি ভাতা পেলে এই ভাতার আওতায় আসবেন না।
- প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কোনো বেসরকারি সহযোগিতা সংস্থা (NGO)/সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিতভাবে আর্থিক অনুদান পেলে, তিনি ভাতার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অযোগ্য বিবেচিত হবেন।
প্রতিবন্ধী ভাতার অনলাইন আবেদন করতে যা যা লাগবে
অনলাইনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ভাতার আবেদন করার জন্য আবেদনকারীর নিম্নোক্ত কাগজপত্রগুলো প্রয়োজন হবেঃ
- ১৮ বছরের উর্দ্ধে হলে জাতীয় পরিচয়পত্র (National Identity Card)/১৮ বছরের নিচে হলে অনলাইন জন্ম নিবন্ধন (Online Birth Certificate)।
- সুবর্ণ নাগরিক কার্ড (প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পরিচয়পত্র)
- নগদ/বিকাশ একাউন্টসহ একটি সচল মোবাইল নাম্বার।
অনলাইনে প্রতিবন্ধী ভাতা আবেদন করার নিয়ম
প্রতিবন্ধী ভাতাসহ আরো সরকারি নানা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি’ বিষয়ক ওয়েবসাইট (Website) রয়েছে। এই ওয়েবসাইটে ভাতা প্রাপ্তির আবেদন ফরম পূরণ করে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। তারপর আবেদনের প্রিন্টেড কপি (Printed Copy) উপজেলা সমাজসেবা অফিসে জমা দিয়ে চূড়ান্ত আবেদন করতে হয়।
যেহেতু এই আবেদনের ভিত্তিতেই যোগ্যপ্রার্থী বাছাই করা হয়, তাই যত্নসহকারে সঠিকভাবে এই আবেদন করতে হবে। তাছাড়া ভাতার জন্য অনলাইনে আবেদন করার পর, সেখানে দেয়া তথ্যসমূহ পুনরায় সংশোধন করা যায় না। তাই প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে, সঠিক তথ্য দিয়ে আবেদন ফরম পূরণ করে সাবমিট করতে হবে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রতিবন্ধী ভাতা আবেদন করার বিস্তারিত প্রক্রিয়াটি নিচে ছবিসহ ধাপে ধাপে দেখানো হলোঃ
ধাপ ১: সমাজসেবা অধিদপ্তরের ভাতা আবেদন ওয়েবসাইটে প্রবেশ
অনলাইন আবেদন করতে সমাজসেবা অধিদপ্তরের, ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আবেদন ফরমে প্রবেশ করুন। সরাসরি মূল ওয়েবপেইজে (Webpage) যেতে- https://mis.bhata.gov.bd/onlineApplication, এই লিংকে (Link) প্রবেশ করুন। যারা আগে থেকেই এই ভাতা পাচ্ছেন তাদের আবেদন করার প্রয়োজন নেই।
এখানে, কার্যক্রম অপশনে ভাতার ধরন নির্বাচন করতে হবে। নিচের নির্বাচন করুন ঘরে ক্লিক (Click) করলে একটি ড্রপডাউন (Drop-down) মেন্যু (Menu) পাবেন।
এখানে প্রতিবন্ধী, বিধবা ও বয়স্ক ভাতার আবেদন করতে পারবেন। ভাতার অপশনগুলো থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা নির্বাচন করুন। এবার, একটি বিস্তারিত অনলাইন আবেদন ফরম দেখতে পাবেন।
ধাপ ২: জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই ও ব্যক্তিগত তথ্য পূরণ
প্রতিবন্ধী ভাতা আবেদন করার জন্য আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম নিবন্ধন সনদ যাচাই করতে হবে। আপনার কাছে যেই ডকুমেন্ট (Document) আছে, সেটি নির্বাচন করুন। জাতীয় পরিচয়পত্র নির্বাচন করলে আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর লিখুন। (জাতীয় পরিচয়পত্র নাম্বার অবশ্যই ১০ বা ১৭ সংখ্যার হতে হবে)
পাশের জন্ম তারিখের ঘরে ক্যালেন্ডার অপশনে ক্লিক করে, সঠিক তারিখটি নির্বাচন করুন।
এবার যাচাই করুন লেখাতে ক্লিক করুন। আপনার এনআইডি কার্ড (NID Card)/জন্ম নিবন্ধনের পরিচয় সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য দেখতে পাবেন। এনআইডি কার্ডের নাম্বার দেয়া হয়ে গেলে ছবিসহ আবেদনকারীর সকল তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূরণ হয়ে যাবে। তবে অধিকাংশ তথ্যের ঘর অপূর্ণ থাকতে পারে। সেগুলো ম্যানুয়ালি (Manually) টাইপ (Type) করে পূরণ করতে হবে।
ধাপ ৩: প্রতিবন্ধী ভাতা অনুযায়ী বিস্তারিত তথ্য পূরণ
এই ধাপে, ভাতার জন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রয়োজনীয় তথ্যাদি দিয়ে ফাঁকা ঘর পূরণ করতে হবে। ভাতা আবেদন অনুমোদনের জন্য এই তথ্যসমূহ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো হলোঃ
- আবেদনকারীর প্রতিবন্ধিতার পরিচয়পত্র নাম্বার বা “ডি আই এস” (DIS) নাম্বার পূরণ করুন। (এর আগে প্রতিবন্ধিতার পরিচয়পত্র বা সুবর্ণ নাগরিক কার্ড সংগ্রহ করতে হবে)।
- প্রতিবন্ধীর ধরন অনুযায়ী কোড নাম্বার (Code Number) নির্বাচন করুন। (বিভিন্নধরনের প্রতিবন্ধিতার কোড ভিন্ন ভিন্ন হয়)
এই দুটি তথ্য দিয়ে ‘যাচাই’ বাটনে ক্লিক করুন। ‘ডি আই এস’ নাম্বার সঠিকভাবে দেয়ার পর নিম্নোক্ত তথ্যগুলো দিয়ে ফরমটি পূরণ করতে হবে।
- বৈবাহিক অবস্থা (বিবাহিত, অবিবাহিত, তালাকপ্রাপ্ত, বিধবা, বহুবিবাহ ইত্যাদি)
- শিক্ষাগত যোগ্যতা
- পরিবারের সদস্য সংখ্যা (পুরুষ, মহিলা ও হিজড়া)
- আবেদনকারীর পেশা
- বার্ষিক আয়ের পরিমাণ
- স্বাস্থ্যগত বা কর্মক্ষমতা সম্পর্কিত তথ্য
- সরকারি বা বেসরকারি অন্য কোন আর্থিক সুবিধা প্রাপ্তির তথ্যাবলী।
- বাসস্থানের তথ্য (নিজস্ব, ভাড়া, গৃহহীন বা অন্যান্য)
- ভূমির মালিকানা
- ডি আই এস অনুযায়ী প্রতিবন্ধীর ধরন
- ডি আই এস অনুযায়ী প্রতিবন্ধিতার মাত্রা
ধাপ ৪: আবেদনকারীর যোগাযোগ সংক্রান্ত তথ্য
প্রতিবন্ধী ভাতা আবেদনকারীর বর্তমান ঠিকানা ও স্থায়ী ঠিকানার তথ্য সঠিকভাবে দিন। প্রথমে বর্তমান ঠিকানার-
- বিভাগ, জেলা, উপজেলা নির্ধারণ করুন।
- অবস্থান ঘরে, আপনি যেই এলাকার আওতাধীন (ইউনিয়ন পরিষদ/সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভা) তা সিলেক্ট করুন।
- পোস্ট কোড (Post code) লিখুন।
- গ্রাম/বাড়ির হোল্ডিং (Holding) ঠিকানার তথ্য দিন।
একইভাবে স্থায়ী ঠিকানার তথ্য পূরণ করুন। বর্তমান ঠিকানা ও স্থায়ী ঠিকানা একই স্থানে হলে, ‘একই ঠিকানা’ লেখার পার্শ্ববর্তী ঘরে ক্লিক করুন।
- নিচে আপনার একটি ই-মেইল ঠিকানা লিখুন। (ঐচ্ছিক)
- বিকাশ/নগদ একাউন্টসহ একটি সচল মোবাইল নাম্বার লিখুন। (যে নাম্বারে ভাতার টাকা পেতে ইচ্ছুক)
- মোবাইল নাম্বারের মালিকানা সিলেক্ট করুন।
বি: দ্র: (ভাতা প্রাপ্তির জন্য অনুমোদিত হলে, এই নাম্বারেই আপনার ভাতার অর্থ প্রদান করা হবে। তাই বিকাশ একাউন্টসহ নির্দিষ্ট মালিকানাধীন একটি সচল মোবাইল নাম্বার দেওয়াই নিরাপদ।)
ধাপ ৫: অন্যান্য যোগ্যতা সম্পর্কিত তথ্য
এই ধাপে, প্রতিবন্ধী ভাতা আবেদনের জন্য আপনি যোগ্য কিনা সে সম্পর্কিত তথ্য দিতে হবে। এক্ষেত্রে আবেদনকারীর-
- বাসগৃহের তথ্য।
- খানা প্রধানের বিস্তারিত তথ্য।
- খানায় বিভিন্ন সরকারি ও অন্যান্য সুবিধা প্রাপ্তির তথ্য।
- গত ১ বছরে আবেদনকারীর খানায় বিদেশে অবস্থানকারী কারো নিকট থেকে অর্থ পেয়েছে কিনা, সেই তথ্য।
- পরিবারের কেউ গত ১ বছরে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় সহায়তা পেয়েছে কিনা ইত্যাদি তথ্য দিতে হবে।
সব তথ্য দেয়া হয়ে গেলে, বিস্তারিত তথ্য পূনরায় দেখে নিন। কারণ তথ্যসমূহ আবার সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই। এরপর নিচের ‘সংরক্ষণ’ বাটনে ক্লিক করে অনলাইনে আবেদন জমা দিন।
ধাপ ৬: আবেদন ফরম ডাউনলোড
আবেদন সাবমিট করার পর “আপনার আবেদনটি সফলভাবে গৃহীত হয়েছে” লেখা একটি স্বয়ংক্রিয় পেজ আসবে। সেখান থেকে প্রিন্ট অপশনে ক্লিক করে আবেদন ফরমটির প্রিন্ট নিন। কম্পিউটারে প্রিন্টার (Printer) সংযুক্ত না থাকলে ফরমটি ডাউনলোড (Download) করে নিন।
এক্ষেত্রে অনলাইন আবেদন ফরমের পিডিএফ (PDF) কপি ডাউনলোড হবে। ফরমটি প্রিন্ট করে স্থানীয় চেয়ারম্যান/পৌরসভার কাউন্সিলরের স্বাক্ষর নিয়ে সেটি সংরক্ষণ করুন।
ধাপ ৭: স্থানীয় জনপ্রশাসন কার্যালয়ে প্রতিবন্ধী ভাতা আবেদন জমা
প্রতিবন্ধী ভাতা পেতে উপজেলা সমাজসেবা অফিসে অনলাইন আবেদনের কপিসহ অন্যান্য কাগজপত্র জমা দিতে হয়। এক্ষেত্রে আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র/জন্ম নিবন্ধন সনদ, সুবর্ণ নাগরিক কার্ডের কপি ও ছবি প্রয়োজন হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নিকট এসকল কাগজপত্র জমা দিলে তা কমিটি কর্তৃক যাচাই-বাছাই করা হবে। তারপর যোগ্য প্রার্থীরা ভাতার জন্য অনুমোদন পাবেন।
প্রার্থী নির্বাচনের মানদন্ড
জনপ্রশাসন কার্যালয়ে আবেদন জমা দেওয়ার পর একটি অনুমোদিত কমিটি কর্তৃক যোগ্য প্রার্থীদের বাছাই করা হয়। প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত মানদণ্ডগুলো বিবেচনা করা হয়ঃ
- প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে, আবেদনকারীকে অবশ্যই “প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩” – এর সংজ্ঞানুযায়ী প্রতিবন্ধী হতে হবে।
- প্রার্থীর আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করা হবে।
- বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অগ্রাধিকার পাবে।
- ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে বয়স্ক প্রতিবন্ধী নারী-পুরুষরা অগ্রাধিকার পাবেন।
- ভূমিহীন, গৃহহীন ও অসহায় প্রতিবন্ধীরা ভাতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন।
- নারী প্রতিবন্ধীরা অগ্রাধিকার পাবেন।
- গরীব মানসিক রোগী/প্রতিবন্ধী শিশুরা অগ্রাধিকার পাবে।
- সম্পূর্ণ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অগ্রাধিকার পাবেন।
- অধিক দারিদ্রপীড়িত ও অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে যাওয়া বা দূরবর্তী এলাকার প্রতিবন্ধী প্রার্থীরা অগ্রাধিকার পাবেন।
প্রতিবন্ধী ভাতা কত টাকা দেওয়া হয়
রাষ্ট্রের দায়িত্বের অংশ হিসেবে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে প্রতিবন্ধী ভাতা কর্মসূচি প্রবর্তন করা হয়। প্রাথমিকভাবে ১,০৪,১৬৬ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে জনপ্রতি মাসিক ২০০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হতো। বর্তমানে প্রায় দেড় যুগ পরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা এবং ভাতার পরিমাণ দুটোই অনেক বেড়েছে। প্রতি ৩ মাস পর পর একসাথে প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীদের বিকাশ/নগদ/রকেট মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে জিটুপি পদ্ধতিতে ২,৫৫০ টাকা প্রদান করা হয়।
প্রতিবন্ধী ভাতা আবেদনের জন্য প্রতিবন্ধী নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র গ্রহণ
ভাতার আবেদন করার জন্য আবেদনকারীর প্রতিবন্ধিতার পরিচয়পত্র প্রয়োজন হয়। এটিকে সুবর্ণ নাগরিক কার্ড বলা হয়। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়ন ও সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনের ৩১(১) ধারা অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিবন্ধন ও তাদের পরিচয়পত্র প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিবন্ধন
বর্তমানে সরকারিভাবে প্রতিবন্ধিতার ধরন চিহ্নিতকরণ, মাত্রা নিরূপণ ও কারণ নির্দিষ্ট করে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সঠিক পরিসংখ্যান নির্ণয় করা হয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহের জন্য ওয়েব-বেইজড এ্যাপ্লিকেশন (Web-based application) সহ ডিজেবিলিটি ইনফরমেশন সিস্টেম (Disability Information System) রয়েছে। সেখানে আবেদন করে সুবর্ণ নাগরিক কার্ড সংগ্রহ করতে হয়।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যে জেলার স্থায়ী বাসিন্দা সেই জেলাতেই এই নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়। এই কার্ড ব্যতীত প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য আবেদন করা যায় না। প্রতিবন্ধিতার পরিচয়পত্রের জন্য আবেদন করতে-
- আবেদনকারীকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে।
- শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আবেদন করতে পারবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পক্ষে তার অভিভাবক অথবা কোনো সংস্থা এই কর্মসূচির সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে না।
- আবেদনকারীর জন্ম নিবন্ধন সনদ অথবা জাতীয় পরিচয়পত্র থাকতে হবে।
প্রতিবন্ধী পরিচয়পত্রের আবেদন প্রক্রিয়া
সুবর্ণ নাগরিক কার্ড প্রাপ্তির জন্য নিচের কার্যক্রমগুলো ধাপে ধাপে সম্পন্ন করতে হবেঃ
- প্রথমে সমাজসেবা অধিদপ্তরের- www.dis.gov.bd এই লিংকে ভিজিট করুন।
- অনলাইন আবেদন ফরমের সকল তথ্য সঠিকভাবে পূরণ করুন।
- আবেদনকারীর স্বাক্ষরের স্থানে স্বাক্ষরের স্ক্যান (Scan) করে, সেই ছবি বসাতে হবে।
- সঠিক মোবাইল নাম্বার ও ই-মেইল এড্রেস দিতে হবে।
- অনলাইন আবেদন ফরমটির প্রিন্ট কপি আবেদনকারীর বর্তমান ঠিকানায় সংশ্লিষ্ট উপজেলা/পৌরসভা/সমাজসেবা কার্যালয়ে জমা দিতে হবে।
- পরবর্তীতে উপজেলা/পৌরসভা/সমাজসেবা কার্যালয়ে প্রদত্ত সময় অনুযায়ী ডাক্তারী পরীক্ষার জন্য হাজির হতে হবে। এসময় অনলাইনে সাবমিট করা আবেদন ফরমের প্রিন্টেড (Printed) কপি সাথে নিতে হবে।
- এ সকল কার্যক্রম ঠিকঠাক সম্পন্ন হলে পরিচয়পত্র দেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সমাজসেবা কার্যালয় থেকে এসএমএস (SMS) পাওয়ার পর পরিচয়পত্র (Identity Card) বা সুবর্ণ নাগরিক কার্ড সংগ্রহ করা যাবে।
প্রতিবন্ধী ভাতা কর্মসূচির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে বিধবা ভাতা কর্মসূচি প্রণয়নের মূল লক্ষ্যগুলো নিচে তুলে ধরা হলোঃ
- প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন করা।
- প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি বিভিন্ন সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ করা।
- অসহায় প্রতিবন্ধীদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা।
- প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনযাপন উন্নয়নের বিষয়টি জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা।
- সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করে, বাছাই কমিটি কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য মাসিক ভাতা প্রদান করা।
প্রতিবন্ধী ভাতা কর্মসূচির ধারাবাহিকতা ও উন্নয়ন
বর্তমান সময়ে প্রতিবন্ধীদের ভাতা কার্যক্রমে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং সর্বমহলে এই কার্যক্রমকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা হচ্ছে। এই লক্ষ্যে প্রতিবন্ধী ভাতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন নীতিমালা সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ভাতা আবেদনের পর উপকারভোগী নির্বাচনে স্থানীয় মাননীয় সংসদ সদস্যসহ অন্যান্য জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্তকরণ এবং ডাটাবেইজ প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
বর্তমানে সকল উপকারভোগীকে মোবাইল ব্যাংকিং (নগদ ও বিকাশ) এবং এজেন্ট ব্যাংকিং (Agent Banking)-এর মাধ্যমে জিটুপি (G2P) বা গভর্নমেন্ট টু পারসন (Government to Person) পদ্ধতিতে ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিবিড় তদারকি এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের নিরলস পরিশ্রমের ফলে এই কার্যক্রমে প্রায় শতভাগ সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে বর্তমান ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিবন্ধী ভাতা কর্মসূচির সাফল্যের কয়েকটি ধাপ নিচে তালিকাভুক্ত করা হলোঃ
অর্থবছর | উপকারভোগীর সংখ্যা | ভাতার হার (টাকায়) | বার্ষিক বাজেট |
২০০৫-০৬ | ১,০৪,১৬৬ জন | জনপ্রতি মাসিক ২০০ টাকা | ২৪.৯৯ কোটি টাকা |
২০১০-২০১১ | ২ লক্ষ ৮৬ হাজার জন | জনপ্রতি মাসিক ৩০০ টাকা | ১০২.৯৬ কোটি টাকা |
২০১৫-২০১৬ | ৬ লক্ষ ৫০ হাজার জন | জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা | ৩৬০ কোটি টাকা |
২০২০-২০২১ | ১৮ লক্ষ জন | জনপ্রতি মাসিক ৭৫০ টাকা | ১৬২০ কোটি টাকা |
২০২৩-২০২৪ | ২৯ লক্ষ জন | জনপ্রতি মাসিক ৮৫০ টাকা | ২৯৭৮.৭১ কোটি টাকা |
প্রতিবন্ধী ভাতা মোবাইল ব্যাংকিং
বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি ত্রান, অনুদান, ভাতার নির্ধারিত অর্থ মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে সুবিধাভোগীরা বিকাশ/নগদ মোবাইল ব্যাংকিং মাধ্যম ব্যবহার করতে পারেন।
পূর্বে ভাতার অর্থ বন্টনের সময় সকল ভাতাভোগীকে উপজেলা ভিত্তিক নির্দিষ্ট ব্যাংকে উপস্থিত থাকতে হতো। যা বেশ দুর্ভোগের ছিল এবং বন্টন প্রক্রিয়ায় নানারকম প্রতারণা ও দুর্নীতি হতো। করোনাকালীন সময় থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা আবেদন করার পর স্থানীয় সমাজসেবা অফিস থেকে তালিকা প্রণয়ন করা হয়। পরবর্তীতে সমাজসেবা কর্মকর্তা আবেদনকারীদের মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট খুলতে নির্দেশনা দেন।
এই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে সরকার থেকে সরাসরি ভোক্তার কাছে ভাতার টাকা প্রেরণ করা হয়। যার ফলে নাগরিকদের দুর্ভোগ এবং ভাতার অর্থ নিয়ে অন্যান্য দুর্নীতি অনেকাংশে কমেছে।
শেষকথা
প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিবন্ধী ভাতা আবেদন কার্যক্রম চালু থাকে। বিশেষ করে প্রতিবছর আগস্ট মাসের শুরু থেকে প্রতিবন্ধী ভাতার অনলাইন আবেদন করা যায়। আশা করি, নির্ধারিত সময়ে উপরোক্ত সকল দিকনির্দেশনা মেনে সঠিকভাবে আবেদন করলে, নির্দিষ্ট ভাতার আওতাভুক্ত হয়ে প্রতিবন্ধী সকল নাগরিকের ভাতার অধিকার নিশ্চিত হবে।
অনবরত জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
১) ২০২৩ সালে প্রতিবন্ধী ভাতা আবেদনের শেষ তারিখ কবে?
২০২৩ সালে প্রতিবন্ধী ভাতার আবেদন প্রক্রিয়া ১০ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলমান থাকবে।
২) কত টাকা প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হয়?
২০২৩-২৪ অর্থবছরে জনপ্রতি মাসিক ৮৫০ টাকা করে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হবে।
৩) প্রতিবন্ধী ভাতা কয় মাস পর পর দেওয়া হয়?
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতার অর্থ প্রতি তিন মাস পর পর একসাথে মোবাইল ব্যাংকিং মাধ্যমে দেওয়া হয়।
৪) সুবর্ণ নাগরিক কার্ড ছাড়া প্রতিবন্ধী ভাতার আবেদন করা যাবে কি?
সুবর্ণ নাগরিক কাজ ছাড়া অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায় না। তাছাড়া আপনার প্রতিবন্ধিতার প্রমাণপত্র হিসেবে সুবর্ণ নাগরিক কার্ড/প্রতিবন্ধী পরিচয়পত্র থাকাতেই হবে।
৫) প্রতিবন্ধী বলতে কি বুঝায়?
বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১ – অনুযায়ী, “প্রতিবন্ধী বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝানো হয়, যিনি জন্মগতভাবে/রোগাক্রান্ত হয়ে/দুর্ঘটনায় আহত হয়ে/অপচিকিৎসায় বা অন্যকোনো কারণে দৈহিকভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে/মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে/বৈকল্যের ফলে স্থায়ীভাবে আংশিক বা সম্পূর্ণ কর্মক্ষমতাহীন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে অক্ষম।”