বর্তমানে অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় জমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রক্ষার্থে সম্পদের মালিক হিসেবে জমির দাগ, খতিয়ান নম্বর ও দাগ সূচি এর মতো প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি জানা আবশ্যক। প্রযুক্তির অগ্রগামী সাফল্যে এখন বর্তমান সময়ে ভূমি অফিসে দৌঁড়ঝাপ না করেই অত্যন্ত সহজেই সাধারণ মানের ডিভাইসের সাহায্যে ঘরে বসেই যেকোনো জমির দাগ নাম্বার থেকে খতিয়ান নাম্বারের পাশাপাশি দাগ সূচি’র তথ্য জানা যায়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের এই আধুনিকায়ন দেশের বহুল জটিল এবং সময়সাপেক্ষ একটা প্রক্রিয়া কে খুবই সহজ ও দ্রুততর করেছে। আজকের আর্টিকেলে আমরা দাগ নাম্বার থেকে খতিয়ান নাম্বার বের করার প্রক্রিয়ার বিস্তারিত জানবো।
সূচিপত্রঃ
জমির দাগ নাম্বার কী?
জমির দাগ নাম্বার থেকে খতিয়ান নাম্বার জানার প্রক্রিয়ার প্রারম্ভে জমির দাগ নাম্বার সম্বন্ধে বিস্তারিত ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক।
জমির দাগ অর্থ হচ্ছে “ভূমিখণ্ড”। জমির দাগ নম্বর দিয়ে মূলত জমির ভাগ অংশের পরিমাপ সম্পর্কিত নাম্বার কে বোঝানো হয়। আরও সহজে বিশদভাবে বলতে গেলে, একটি নির্দিষ্ট এলাকার জমির ম্যাপ যখন প্রস্তুত করা হয়, তখন ওই এলাকার মৌজা ভিত্তিক নকশায় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জমির সীমানা চিহ্নিত করার জন্য প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ভূখণ্ড কে সরকার প্রদত্ত যে নাম্বার দেওয়া হয়েছে, তাকেই জমির দাগ নাম্বার বলা হয়। এই দাগ বিভিন্ন অঞ্চলে “কিত্তা” নামেও পরিচিত।
দাগ নাম্বারের ভিন্নতায় জমির পরিমাণও ভিন্ন হতে পারে। দাগ নাম্বার অনুসারে জমির মালিক সূক্ষ্মভাবে সীমানা নির্ধারণ করতে এবং তার সীমানা চিহ্নিত করে রাখতে পারেন।
জমির খতিয়ান নাম্বার কী?
কোনো মৌজা বা এলাকার এক বা একাধিক জমির মালিকের জমির বিস্তারিত তথ্যসহ ভূমি রেকর্ডের যেই নথি প্রস্তুত করা হয়, তাকেই মূলত খতিয়ান নাম্বার বলে।
জমির মালিকের নাম, আগের দিনের প্রজার নাম, জমির দাগ ও পরিমাপ সহ বিস্তারিত তথ্য থাকে খতিয়ানে। খতিয়ানের সাধারণত চারটি প্রকারভেদ রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে,
- সি এস খতিয়ান
- আর এস খতিয়ান
- এস এ খতিয়ান
- বি এস খতিয়ান
সি এস খতিয়ান
১৯১০-১৯২০ সালের দিকে একটি মৌজার প্রত্যকটি জমির পরিমাণ ও তার অবস্থান নিয়ে যে নকশা ও জমির মালিকের বিস্তারিত তথ্যাবলী দিয়ে যে খতিয়ান তৈরি করেছে, তাকেই সি এস খতিয়ান বলা হয়।
এস এ খতিয়ান
১৯৫০ সালের জমি অধিগ্রহণ আইনানুসারে জমিতে না গিয়ে সরকারি কর্মচারী গণ খতিয়ানে যে সংশোধন করেন, তাকে এস এ খতিয়ান বলে।
আর এস খতিয়ান
এস এ খতিয়ানে জমিতে না গিয়ে যেই জরিপ করা হয়েছিল, তারপর সরেজমিনে গিয়ে যে সংশোধিত খতিয়ান পূণরায় প্রস্তুত করা হয়েছিল, সেটাই আর এস খতিয়ান। এটা এখনো সব জেলায় সম্পুর্ণ রূপে প্রকাশিত হয়নি। প্রক্রিয়া টি চলমান রয়েছে।
বি এস খতিয়ান
১৯৯০ সাল থেকে সংশোধিত হয়ে বর্তমান পর্যন্ত চলমান খতিয়ান কে বিএস খতিয়ান বলা হয়।
জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে জমির প্রকার, মালিকের অংশ, জমি ব্যবহারের অধিকার, জমির উন্নয়ন করের পরিসংখ্যানের নথিপত্র ইত্যাদি পূঙ্খানুপুঙ্খ রূপে পরীক্ষা করে ডাক ও খতিয়ান নাম্বার যাচাই করার পরে জমি ক্রয় করা হয়। জমির জন্য নির্ধারিত আইন ১৮৮৫ সালে বেঙ্গল প্রজাতন্ত্র আইন হিসেবে শুরু করা হয়। প্রজাতন্ত্র আইন চালু হওয়ার পূর্বে জমির জন্য অধিকার দাবি করার যথেষ্ট সমস্যার সৃষ্টি হতো এবং সেই সমস্যা থেকে জমির আসল মালিকদের পরিত্রাণ পাওয়ানোর জন্যই টাইটেল রেকর্ড বা খতিয়ান নামে এই ভূমির পূর্বের সব রেকর্ড রাখা শুরু হয়।
জমির দাগ নাম্বার থেকে খতিয়ান বের করার পদ্ধতি
ধাপ-১ঃ ওয়েবসাইটে প্রবেশ
জমির দাগ নাম্বার থেকে খতিয়ান নাম্বার বের করতে হলে প্রথমত জমির খতিয়ানের প্রকারভেদ জানা জরুরি, যে জমি কোন প্রকার খতিয়ান নাম্বারে আছে। এই কাজ করার জন্য আপনার অবশ্যই ডিজিটাল একটি ডিভাইস থাকা আবশ্যক, যেখানে ইন্টারনেট সংযোগ আছে। অতঃপর আপনাকে ইন্টারনেট সংযোগ থাকা অবস্থায় eporcha.gov.bd লিংকে ক্লিক করে eporcha ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে হবে। ওয়েবসাইটে প্রবেশ করার পর স্ক্রল করে একটু নিচের দিকে গেলে নিম্নের ছবির মতো দেখতে পাবেন এবং সেখানে সার্ভে খতিয়ানে ক্লিক করে তা নির্ধারণ করতে হবে।
ধাপ-২ঃ বিভাগ নির্ধারণ
এই ধাপে আপনার নিজস্ব বিভাগের নাম অপশন অনুযায়ী নির্ধারণ করতে হবে।
ধাপ-৩ঃ জেলা নির্ধারণ
বিভাগ নির্ধারণের পর ওই বিভাগের অন্তর্ভুক্ত জেলার নাম থেকে জেলা নির্ধারণ করতে হবে।
ধাপ-৪ঃ উপজেলা নির্বাচন
আপনি জেলার নাম নির্ধারণ করে দিলেই, সে জেলার অন্তর্ভুক্ত উপজেলা চলে আসবে এবং সেখান থেকে আপনার উপজেলা নির্বাচন করুন।
ধাপ-৫ঃ খতিয়ানের প্রকারভেদ নির্বাচন
আপনি যে ধরনের খতিয়ান বের করতে চান, যেমন আর এস, সি এস, বি আর এস, বি এস ইত্যাদির যেকোনো একটি নির্বাচন করতে হবে।
ধাপ-৬ঃ মৌজা নির্বাচন
আপনি জেলার যে মৌজার অন্তর্ভুক্ত তা নির্ধারণ করুন। মৌজা সম্বন্ধে না জানলেও বিভাগ,জেলা, উপজেলা সম্বন্ধে তথ্য দিলে ওই স্থানীয় সকল মৌজার অপশন পাওয়া যাবে এবং সেখান থেকেই নির্ধারণ করে নিতে পারবেন।
ধাপ-৭ঃ মালিকানার নাম প্রদান
মালিকানার নাম উল্লেখ করতে হবে। অর্থাৎ জমির মালিক যে ছিল বা যার নামে জমি খারিজ কৃত আছে তার নাম নিম্নে’র ছবির ন্যায় খুঁজুন বক্সে খতিয়ান নাম্বার ও মালিকানার নাম লিখে। অতঃপর খতিয়ানের তালিকায় নাম খতিয়ান পেয়ে ডাবল ক্লিক করলেই পেয়ে যাবে খতিয়ান নম্বর সহ খতিয়ানের বিস্তারিত।
ধাপ-৮ঃ দাগ নম্বর দেখুন
মালিকের নামের উপর ক্লিক করলে আপনি খতিয়ান নং এবং দাগ নম্বর দেখতে পারবেন।
ধাপ-৯ঃ বিস্তারিত তথ্য দেখুন
সমস্ত তথ্য সঠিক থাকলে সহজেই আপনি খতিয়ান নাম্বার সহ অন্যান্য তথ্যাদি পেয়ে যাবেন। জমির প্রকৃত মালিক সহ এতদিন পর্যন্ত জমির প্রত্যেকটি মালিক সম্বন্ধে তথ্য ও পাওয়া যাবে এই ওয়েবসাইটের সাহায্য। ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত হওয়ায় এই তথ্য ভূল হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
জমির খতিয়ান সংরক্ষণের জন্য আবেদন পদ্ধতি
জমি খতিয়ান নম্বর সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরী। এক্ষেত্রে অনলাইন এবং সার্টিফাইড দুই ধরনের কপি সংরক্ষণেরই সুব্যবস্থা আছে।
জমির খতিয়ানের অনলাইন কপি সংরক্ষণের জন্য আবেদন পদ্ধতি
জমির দাগ ও খতিয়ান নাম্বার সহ পর্চার যেই তথ্য অনলাইনে প্রদর্শিত হলো, তা খুব সহজেই নির্দিষ্ট ফি এর বিনিময়ে ডাউনলোড করে সংরক্ষণ করা যায় নিজ বাসা থেকেই। এই পর্চা সার্টিফিকেট না হলেও এটা কে যেকোনো সময় গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে আপনি ব্যবহার করতে পারবেন জমির মালিকানা সংক্রান্ত যেকোনো ব্যাপারে। তবে এই কপি কোর্টে বা মন্ত্রণালয়ের অফিশিয়াল কোনো কাজে সরাসরি ব্যবহার করা যাবে না। অনলাইনে কপির জন্য আবেদন করতেঃ
ধাপ১-ঃ খতিয়ান নং বের করুন
খতিয়ানের জন্য আবেদন করতে প্রথমেই খতিয়ান নং বের করতে হবে। এক্ষেত্রে উপর্যুক্ত উপায় অনুসরণ করুন। এরপর তাতে থাকা ‘খতিয়ান আবেদন’ বাটনে ক্লিক করুন।
ধাপ-২ঃ খতিয়ান আবেদন ফর্ম পূরণ করুন
এই পর্যায়ে খতিয়ান আবেদন ফর্ম পূরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে এই আবেদন আপনার খতিয়ানের সাথে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বরাবর হবে। যেমন এখানে উদাহরণস্বরুপ চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বরাবর আবেদন করা হচ্ছে। জমির খতিয়ানের আবেদন করতে যে সকল তথ্যের প্রয়োজনঃ
- জাতীয় পরিচয়পত্র নং
- জন্ম তারিখ
- মোবাইল নম্বর
- নাম (ইংরেজি)
- ইমেইল
- ঠিকানা
ধাপ-৩ঃ আবেদনের ধরন নির্ধারণ
যেহেতু আপনি অনলাইন কপি চাচ্ছেন সেক্ষেত্রে আবেদনের ধরন হিসেবে ‘অনলাইন কপি’ নির্ধারণ করুন।
ধাপ-৪ঃ ফি প্রদান করুন
এই ধাপে অনলাইনে খতিয়ান সংরক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট ফি প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথমেই ফি প্রদানের মাধ্যম নির্ধারণ করুন। ফি প্রদানের মাধ্যম সমূহ নিম্নোক্তঃ
এবার আপনি যে রোবোট নয় তা প্রমাণ করতে যোগফল প্রদান করুন। অতঃপর ‘পরবর্তী ধাপ’ এ ক্লিক করে ফি প্রদান করলেই পেয়ে যাবেন আপনার জমির খতিয়ানের অনলাইন কপি।
জমির খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি সংরক্ষণের জন্য আবেদন পদ্ধতি
জমির খতিয়ানের অনলাইন কপি সাধারণ কাজে ব্যবহার করা গেলেও কোর্টে ব্যবহার করা যায় না। সেজন্য প্রয়োজন সার্টিফাইড কপির। এক্ষেত্রে ভূমি অফিসে গিয়ে নির্দিষ্ট অর্থ খরচ করে সার্টিফাইড কপি তুলে আনতে হবে।
ধাপ-১ঃ স্বাভাবিক আবেদন করুন
সার্টিফাইড কপির জন্য আবেদন করতে উপর্যুক্ত উপায়ের ধাপ সমূহ অনসরণ করে আবেদনের ধরনে ‘সার্টিফাইড কপি’ নির্ধারণ করুন।
ধাপ-২ঃ সেবা প্রধানের পদ্ধতি নির্ধারণ করুন
সেবা প্রধানের পদ্ধতি হিসেবে অফিস কাউন্টার বা ডাকযোগ নির্ধারণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে অফিস কাউন্টার নির্ধারণ করলে জেলা প্রশাসকের অফিস থেকেই নিতে হবে। আর ডাকযোগ নির্ধারণ করলে আপনার বাসায় খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি পৌছে দেওয়া হবে।
ধাপ-৩ঃ সেবা প্রদানের স্থান নির্ধারণ
সেবা প্রদানের স্থান দেশের ভেতরে হলে বাংলাদেশের ডাক যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে যাবে। কিন্তু দেশের বাইরে নির্ধারণ করলে দেশ নির্ধারণ করতে হবে।
জমির খতিয়ান সংরক্ষণের খরচ
জমির খতিয়ান সংরক্ষণের জন্য খরচের পরিমাণ নিম্নরুপ। উল্লেখ্য যে, খতিয়ান অফিস কাউন্টার বা ডাকযোগ যেভাবেই উঠানো হোক না কেন, সময়ের প্রয়োজন পড়বে ৭ দিন।
ধরন | খতিয়ান ফি | পোস্ট ফি | দেশের বাইরে পোস্ট ফি |
অনলাইন | ১০০ | ০০ | ০০ |
অফলাইন | ১০০ | ৪০ | পরিবর্তনযোগ্য |
শেষকথা
জমি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে ভূমি মন্ত্রণালয়ের এই আধুনিকায়নের ফলাফল হিসেবে ডিজিটাল ভূমি অফিসের সেবা প্রদানকারী মাধ্যম আমাদের দেশের নাগরিকদের জমি সংক্রান্ত বিষয়ে স্বচ্ছতা আনতে সক্ষম হচ্ছে, পাশাপাশি কোনো দালাল বা অন্য কোনো পক্ষের পক্ষপাতিত্ব না থাকায় অর্থনৈতিক ভাবে কোনো ধরনের অসাধু উপায়ের সম্ভাবনাও আর নেই। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নত করা, আর জমি সংক্রান্ত এত জটিল ও সময়সাপেক্ষ একটি ক্ষেত্রে আধুনিকায়ন স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখা কে বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়ারই নামান্তর।
অনবরত জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
১. Eporcha ওয়েব সাইট থেকে আরও কী কী সুবিধা পাওয়া যায়?
উত্তর : ডিসি অফিস কতৃক খতিয়ান প্রস্তুত, নামজারী খতিয়ান দেখা, মৌজা ম্যাপ,দাগ নম্বর সহ জমির বিস্তারিত জানা যায়।
২. ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধিনস্থ ভূমি অফিসে তাৎক্ষণিক কল করার উপায় কী?
উত্তর : ভূমি মন্ত্রণালয়ে তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগের জন্য নির্ধারিত হটলাইন নাম্বার ১৬১২২ বা 16122 নাম্বারে কল করে যেকোনো সহযোগিতা নেওয়া যাবে। প্রয়োজনে [email protected] ঠিকানায় ইমেইল করে সমস্যার কথা জানানো যায়।
৩. জমির দাগ নম্বর থেকে জমির মালিকের নাম জানা যায় কিভাবে?
উত্তর : দাগ ও খতিয়ান নাম্বারের পাশাপাশি নিজের ও জমি সংক্রান্ত অন্যান্য তথ্যাবলী চাহিদা অনুযায়ী উপরোক্ত নিয়মে অনলাইনের E-Porcha ওয়েবসাইটে প্রদান করলে জমির মালিকের নাম সহ আরও অন্যান্য তথ্যাদি ও জানা যায়।