ব্যাংকিং

ক্ষুদ্র ঋণ কি? ক্ষুদ্র ঋণ কিভাবে পাওয়া যায়?

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, ‍ঋণ শব্দটির অর্থ বিশ্বাস; এক পক্ষ যখন অপর পক্ষকে বিশ্বাস করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরত দেয়ার শর্তে অর্থ বা সম্পদ প্রদান করে তাই ঋণ হিসেবে গন্য হয়। আজকাল ব্যাংকের কল্যাণে ঋণ ব্যাপারটা রীতিমত সহজবোধ্যই হয়ে পড়েছে। আমরা এখন প্রাত্যাহিক কাজকর্মেও ঋণ নিতে অভ্যস্থ হয়ে পরছি। যেমন গাড়ি কেনার জন্য ঋণ, বাড়ি কেনার জন্য ঋণ অথবা ক্রেডিট কার্ড। 

যদিও এধরনের ঋণ এর শর্তাবলী মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চ-মধ্যবিত্তদের টার্গেট করেই সাজানো। তাহলে নিম্নবিত্তরা প্রয়োজনে কোথা থেকে ঋণ নিতে পারে এমন প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক। নিম্নবিত্তদের জন্য স্বল্প পরিমাণে যে ঋণ দেয়া হয় তাই ক্ষুদ্র ঋণ বলে পরিচিত। তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক ক্ষুদ্র ঋণ ও তা কিভাবে পাওয়া যায় সে সম্পর্কে।

সূচিপত্রঃ

ক্ষুদ্র ঋণ

ক্ষুদ্র ঋণ বা মাইক্রো-ক্রেডিট হলো স্বল্প পরিমাণ ধার যা শুধু নিম্ন আয়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকেই প্রদান করা হয়। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বেকার বা দরিদ্র উদ্যোক্তাদের নিজেদের আর্থিক অবস্থা ভারসাম্যযোগ্য করার জন্যই সহজ শর্তে এ ধরনের ঋণ দেয়া হয়। এ ধরনের ঋন বিনা জামানতেই দেয়া হয়। 

বিভিন্ন ধরণের বেসরকাকারী সংস্থাগুলো ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প শুরু করেছে। যেহেতু বাংলাদেশের দরিদ্র সীমা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০%, তাই স্বাভাবিকভাবেই দরিদ্র বিমোচন প্রকল্প গুলো ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে। 

ক্ষুদ্র ঋণের বৈশিষ্ট্য

ক্ষুদ্র ঋণ নাম থেকেই বোঝা যায় এতে টাকার পরিমাণ থাকে তুলনামূলক কম এবং নিম্নবিত্তদের কথা মাথায় রেখে এ ধরনের ঋণের সুবিধাও বেশী। ক্ষুদ্র ঋণের কিছু বৈশিষ্ট্য হলো:

১। স্বল্প পরিমাণে ঋণ।

২। জামানত মুক্ত ঋণ।

৩। বেকার, দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য ঋণ।

৪। প্রধানত আত্ন-কর্মসংস্থান বা আর্থিক উন্নয়নের জন্য প্রদত্ত ঋণ।

ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান

দেশে দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে বাংলাদেশে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান গুলো ঋণ প্রদান করে থাকে। জনপ্রিয় কিছু ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান গুলো হলো:

১। গ্রামীন ব্যাংক

২। কর্মসংস্থান ব্যাংক

৩৷ ব্রাক ব্যাংক

৪। এনডিপি

৫। কৃষি ব্যাংক

গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণের উপায়

আমাদের দেশে অন্যতম জনপ্রিয় ক্ষুদ্র ঋণ দানকারী ব্যাংক, গ্রামীণ ব্যাংক। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যই ছিল দরিদ্র বিমোচন। মূলত ভূমিহীন ও হতদরিদ্র কৃষকরাই গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণের ভোক্তা। শুধু তাই না, যেকোনো নতুন ব্যাবসায়ীও ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে সাবলম্বী হতে পারে। ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণের জন্য বেশ কিছু নিয়ম কানুন রয়েছে, যেমন

১। ব্যাংকের শর্তাবলী মেনে চলতে হবে।

২। গ্রামীন ব্যাংক শুধুমাত্র নারী সদস্যদেরই ঋণ প্রাদান করে থাকে।

৩। হতদরিদ্র নারীদের নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়, যেখানে সর্বনিম্ন পাচজন নারী সদস্য থাকা বাধ্যতামূলক।

বাংলাদেশে প্রতিটি ইউনিয়নেই একটি করে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা রয়েছে। আপনার ইউনিয়নের গ্রামীন ব্যাংকের শাখাটি কোথায় রয়েছে তা জেনে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। তবে হ্যা, আপনাকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট জমা দিতে হবে। 

সাধারণত কাগজপত্র জমা দেয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই ঋণ পাওয়া যায়। প্রথম পর্যায়ে একজন ৫,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারেন। আর ঋণ গ্রহণকারীকে প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট পরিমাণ কিস্তি প্রদান করতে হয়। অর্থাৎ প্রতি মাসে চারটি কিস্তি।

গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

নিচে বর্ণিত কাগজপত্র গুলো নিয়ে নিকটস্থ গ্রামীণ ব্যাংকের শাখায় জমা দিলেই ঋণ গ্রহনকারীকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ঋণ প্রদান করা হয়। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুলো হলো:

১। আবেনকারীর ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি।

২৷ আবেনকারীর ৪ কপি রঙিন ছবি (পাসপোর্ট সাইজ)।

৩। নমিনির ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি এবং পাসপোর্ট সাইজের ছবি (যদি লাগে)।

৪। আবেদনকারীর চারিত্রিক সনদ।

ডিজিটাল ক্ষুদ্র ঋণ

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নতুন একটি ঋণদান প্রকল্প আয়োজন করা হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংক স্বল্প সময়ের জন্য, স্বল্প পরিমাণে, সম্পূর্ণ ডিজিটালি যে ঋণ প্রদান করছে তাই “ডিজিটাল ক্ষুদ্র ঋণ”। ঋণদান, প্রসেসিং, ঋন আদায়; এক কথায় বলতে গেলে ঋণের সমস্ত কার্যক্রমই করা হবে ডিজিটাল মাধ্যমে। ডিজিটাল মাধ্যম বলতে বোঝানো হচ্ছে

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ক্ষুদ্রঋণের জন্য ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে। যার মধ্যে ৫০ কোটি টাকা প্রথম পর্যায়ে বিতরণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। প্রথম পর্যায়ে প্রদানকৃত ৫০ কোটি টাকার যথাযথ ব্যবহার দেখতে পেলে পুনরায় আরো ৫০ কোটি টাকা পুনঃঅর্থায়ন করবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ডিজিটাল ক্ষুদ্র ঋণের বৈশিষ্ট্য

মূলত সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আর্থিকভাবে সাবলম্বী করে তোলার জন্যই ডিজিটাল ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডিজিটাল ক্ষুদ্র ঋণের প্রধান কিছু বৈশিষ্ট্য হলো:

১। ডিজিটাল ক্ষুদ্রঋণের সমস্ত প্রক্রিয়া মোবাইল অ্যাপ বা ইন্টারনেট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়।

২। আবেদনকারী যে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিতে চান সেই ব্যাংকে তার একাউন্ট থাকতে হবে।
৩। এই ঋণে ৫০০ থেকে ৫০,০০০ টাকা পর্যান্ত ঋণ নেয়া যাবে।

৪। ডিজিটাল ঋণের মেয়াদ ছয় মাস।

৫। এতে সুদের হার ৯ শতাংশ।

৬। ঋণের ঝুকি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃক বহন করা হবে। 

৭। ঋণের দলিল পত্র, ঋণ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য কিছুদিন পর পর ব্যাংক কর্তৃক যাচাই বাছাইয়ের জন্য চাইতে পারে। 

এস.এম.ই. (SME) ক্ষুদ্র ঋণ

সাধারণত নতুন উদ্যোগ বা ব্যবসায়ের জন্য নির্দিষ্ট শর্তের বিনিময়ে যে ঋণ প্রদান করা হয় তাই ক্ষুদ্র ঋণ। বাংলাদেশের প্রায় সব ব্যাংকই বিভিন্ন মেয়াদে এবং বিভিন্ন শর্তে এই ঋণ দিয়ে থাকে। সাধারণ ঋণের মতোই এই ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রেও অনেক প্রসেসিং করার প্রয়োজন হয়। সাধারণত ঋণগ্রহীতা তার চাহিদা অনুযায়ী কোন ঋণ তার জন্য অধিক সুবিধা দিতে পারবে তা ঠিক করে থাকেন। 

এস.এম.ই. (SME) ক্ষুদ্র ঋণ সংগ্রহের উপায়

অধিকাংশ মানুষ ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহনের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক গুলোকেই অগ্রাধিকার দেয় কারণ এই ব্যাংক গুলো বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ঋণ প্রদানের জন্য অনুমোদনপ্রাপ্ত। ঋণগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় ধাপগুলো দেয়া হলো:

১। আবেদনকরীকে প্রথমেই ঠিক করতে হবে ঠিক কতো বছরের জন্য এবং কতো পরিমাণ ঋণ তিনি নিতে চান। 

২। কোন ব্যাংক কি পরিমাণ এবং কোন কোন শর্তে ঋণ দিবে, সেই ব্যাংকে আপনার একাউন্ট আছে কিনা।

৩। কোন কোন ক্ষেত্র বা কারণবশত ব্যাংক ঋণ প্রদান করবে।

৪। ঋণের মেয়াদকালের সাথে আপনার প্রয়োজনের সময়কালের সামঞ্জস্য রয়েছে কিনা।

৫। ঋণের সুদের পরিমাণ

এস.এম.ই. (SME) ক্ষুদ্র ঋণ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

ব্যাংক একাউন্ট খোলা থেকে শুরু করে ঋণ বা ক্ষুদ্র ঋণ নেয়া সবকিছুতেই কিছু ডকুমেন্ট বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হয়। সঠিক এবং নির্ভূল ডকুমেন্ট ছাড়া কোনো ব্যাংকই আপনাকে ঋণ প্রদান করবেনা। প্রায় সব ব্যাংকই যেসব কাগজপত্র দেখতে চায় সেগুলো হলো:

১। জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি।

২। পাসপোর্ট সাইজের ছবি (২টি)।

৩। আবেদনকারীর ড্রাইভিং লাইসেন্স বা পাসপোর্ট।

৪। আবেদনকারীর চাকরীর আইডি কার্ড এবং স্যালারী সার্টিফিকেট।

৫। চেকবুক।

৬। ইউটিলিটি বিলের ফটোকপি।

৭। ঋণের আবেদনপত্রের পূরণকৃত কপি।

এস.এম.ই.(SME) ক্ষুদ্র ঋণ আবেদন ফরম

SME ক্ষুদ্র ঋণের জন্য আবেদনকারীকে তার পছন্দের ব্যাংক থেকে আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে হবে। কম বা বেশী প্রায় সব ব্যংকেই একই ধরণের তথ্য চাওয়া হয়। যেমন:

১। ঋণের জন্য আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের বৃত্তান্ত।

২। আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের দায়।

৩। আবেদনকারীর বৃত্তান্ত।

৪। আবেদনকারীর দায়।

৫। ঋণ গ্রহাণের উদ্দেশ্য।

৬। জামানতের বিবরণ।

৭। জমিনদারের পরিচয়।

এস.এম.ই.(SME) ক্ষুদ্র ঋণ কিভাবে পাওয়া যায়?

আবেদন ফরম পূরণ করার পর অন্যান্য ডকুমেন্টস গুলোও ব্যাংকে জমা দিন। এরপর আপনার সব ডকুমেন্ট এবং প্রদানকৃত তথ্য ব্যাংক কর্তৃক যাচাই বাছাই করা হবে। ব্যাংকের ভ্যারিফিকেশন সম্পূর্ণ হলে ব্যাংক আবেদনকারীকে ইন্টাভিউ এর জন্য ডাকবে। ইন্টারভিউতে যেসব প্রশ্ন করা হতে পারে তা হলো:

১। আবেদনকারী কেনো টাকা নিবেন?

২। টাকাটা কোন কোন খাতে খরচ হবে?

ব্যাংক আপনার সব প্রশ্নের উত্তরে খুশি হলে তবেই আপনাকে ঋণ প্রদান করতে রাজি হবে। এরপর তাৎক্ষনিকভাবে আপনার ঋণের অর্থ আপনার একাউন্টে যোগ হয়ে যাবে এবং আপনি যখন ইচ্ছা তা উঠিয়ে ব্যবহার করতে পারবেন। 

শেষ কথা

ডিজিটাল ক্ষুদ্রঋণ বা ক্ষুদ্রঋণ, যেকোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্তৃক প্রদানকৃত ঋণের তদারকী করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক নিয়মিত তদারকের ফলে ক্ষুদ্রঋণের আদায়, বিতরণ এবং সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না বলেই ধরে নেয়া যায়।

অনবরত জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

১। ক্ষুদ্র ঋণ বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: সমাজের নিম্ন স্তরের জনগোষ্ঠীদের বিনা জামানতে যে ঋণ প্রদান করা হয় তাই ক্ষুদ্র ঋণ। কারণ তারা বাানজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে শর্ত মেনে ঋণ নিতে পারে না। 

২। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার কত?

উত্তর: গ্রামীন ব্যাংকের ক্রম হ্রাসমান পদ্ধতিতে ঋণের হার ১০% এবং সর্বোচ্চ ২০%।

৩। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কে?

উত্তর: বাংলাদেশ ব্যাংক, মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি, ক্রেডিট ডেভলপমেন্ট ফোরাম ও পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন এই চারটি প্রতিষ্ঠান মূলত ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

৪। মাইক্রো ক্রেডিট কোম্পানি কি?

উত্তর: যে কোম্পানীগুলো একটি দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে তাই মাইক্রো-ক্রেডিট কোম্পানি।

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Back to top button