টেকনোলজিভার্চুয়াল রিয়েলিটি

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি? ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সম্পর্কে বিস্তারিত

ধরা যাক আপনি একজন ভ্রমণ পিপাসু। আপনার হটাৎ ইচ্ছে হলো আলাস্কার আর্কটিক ভ্যালিতে স্কি করবেন। অথবা আপনি একজন মধ্যবয়সী ব্যবসায়ী যার পরিবারের জন্য একটি আরামদায়ক গাড়ি দরকার। সেজন্য গাড়িটি কেনার আগে তার ভেতরে খুটিয়ে দেখা চাই। এ সকল ক্ষেত্রে স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী আপনার হয় বিশল পথ ভ্রমণ করে পাড়ি জমাতে হবে আলাস্কাতে। অথবা সেই গাড়িটির প্রদর্শন কেন্দ্রে যেয়ে চড়ে দেখতে হবে গাড়িটিতে। কিন্তু প্রকৃতির এই স্বাভাবিক নিয়মকে মনুষ্য জাতি অনেকটাই উপেক্ষা করছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সাহায্যে। বর্তমানে এর ব্যবহারের পরিসর স্বল্প হলেও দিনে দিনে বেড়ে চলছে এর পরিধি। বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রযুক্তির নাম যদি নিতে হয়, তবে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বা অপ্রকৃত বাস্তবতা অবশ্যই হবে তার মধ্যে একটি। আজকের এই লেখায় আলোচনা করা হয়েছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির আদ্যপান্ত। 

সূচিপত্রঃ

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (Virtual Reality) কি?

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হলো এমন এক প্রযুক্তি যাতে কম্পিউটার মডেলিং এবং স্টিমুলেশনের সহায়তায় কোনো ব্যক্তি সম্পূর্ণ পরাবাস্তব ও ত্রিমাত্রিক এক জগতের সন্ধান পায় এবং তাতে দৈনন্দিন সাধারণ কাজের পাশাপাশি কোনো বিশেষ কাজের অনুভূতিও গ্রহণ করতে পারে। 

ভার্চুয়াল রিয়েলিটিকে বর্তমানে বলা যায় কম্পিউটার গ্রাফিক্সের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এ প্রযুক্তিতে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সংক্রান্ত জটিল প্রোগ্রাম ব্যবহার করে তৈরি করা হয় একটি কৃত্রিম জগত। ইংরেজিতে এই কৃত্রিম জগতের নাম ‘ভার্চুয়াল রিয়েলিটি’ (Virtual Reality)। আর বাংলায় এর নাম অপ্রকৃত বাস্তবতা বা পরাবাস্তব জগত। মূলত এই জগতের সব কিছুই কৃত্রিম কিন্তু ব্যবহারকারী যখন এই জগতে প্রবেশ করবেন তখন তিনি বাস্তবের কাছাকাছি অনুভূতি পেয়ে থাকেন। সময়ের সাথে সাথে এই অনুভূতির সূক্ষ্ণতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই কৃত্রিম জগত তৈরি করা হতে পারে কোনো বাস্তব জগতের সাথে মিল রেখে। আবার এটি হতে পারে সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মূলত যন্ত্রের সাহায্যে একটি কাল্পনিক জগত তৈরির মাধ্যমে মানুষকে বাস্তবের কাছাকাছি অভিজ্ঞতা প্রদান করার প্রযুক্তির নামই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি। 

ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি খুব নতুন কোনো প্রযুক্তি নয়। পরাবস্তব জগতের প্রথম ডিজাইন করেন লিংক ট্রেইলার (Link Trainer) নামের এক ব্যক্তি। তার ভিআর (VR) টি ছিল মূলত একটি ফ্লাইট সিমুলেটর। এর সাহায্যে তিনি পাইলটদের ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। পরবর্তীতে সিমুলেশন ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বার বার এসেছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির নাম।

  • ১৯৬১ সালে থমাস ফারনেস নামে একজন সামরিক প্রকৌশলী মার্কিন বিমানবাহিনীর প্রথম ফ্লাইট সিমুলেটরটি তৈরি করেন।
  • ১৯৬৮ সালে প্রথম তৈরি হয় মাথায় পরিধানযোগ্য ভিআর ডিসপ্লে (Display)।
  • ১৯৮৭ সালে প্রথম ‘ভার্চুয়াল রিয়েলিটি’ শব্দ দুইটি ব্যবহৃত হয়।
  • ১৯৯৭ সালে পরাবস্তব জগতের প্রযুক্তিতে ব্যবহার করা হয় চিকিৎসার কাজে।
  • ২০০৭ সালে বহুল পরিচিত ভার্চুয়াল রিয়েলিটিঃ গুগল স্ট্রিট ভিউ (Google Street View) এর যাত্রা শুরু হয়।
  • ২০১৪ সালে সনি এর ‘প্লেস্টেশন’ তাদের কনসোল গেমিং এর পাশাপাশি উন্মুক্ত করে ভার্চুয়াল গেমিং এর দরজাও। বাজারে আসে ‘প্লেস্টেশন ভিআর’ (Playstation VR)।
  • ২০১৬ সালে গুগল আর্থ এর ভিআর ভার্সন শুরু হয়। 
  • ২০২২ সালে এসে মার্ক জুকারবার্গের কোম্পানি মেটা তাদের নতুন ভিআর হেডসেট ‘মেটা কোয়েস্ট প্রো’ (Meta Quest Pro) তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এর আগের নাম ছিল ‘প্রজেক্ট ক্যাম্ব্রিয়া’। মার্ক জুকারবার্গের মতে এই ভিআর হেডসেট গুলো আমাদের সাধারণ কাজের ডেস্কটপ ল্যাপটপের স্থান দখল করে নিতে পারবে।

ভার্চুয়াল রিয়েলিটির উপাদান

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সৃষ্টি করতে হলে চাই বেশ কিছু উপদান। এ সকল উপাদানকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়।

  • হার্ডওয়্যার
  • সফটওয়্যার

এই দুই ধরনের উপাদানের সম্বনিত প্রচেষ্টার ফলেই তৈরি হয় একটি পরাবস্তব জগত। প্রথমে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির হার্ডওয়্যার বা যান্ত্রিক উপাদান গুলো  নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে।

ভিআর হেডসেট (VR Headset)

ভিআর হেডসেট হলো এমন এক বিশেষ হেডসেট যা মাথায় পড়ার মাধ্যমে আপনি প্রবেশ করবেন পরাবস্তব জগতে। সাধারণত একজন ব্যক্তি তার চোখে যা দেখে থাকেন তাকে বলে ‘ফিল্ড অফ ভিউ’ (Field of View)। ভিআর হেডসেট পড়ার মাধ্যমে আপনি বাস্তব দৃশ্যের বদলে পরাবস্তব দৃশ্য দেখতে থাকবেন। বিষয়টি অনেকটা মনিটর স্ক্রিনে ভিডিও দেখার মতো। কিন্তু পার্থক্য হলো ভিআর হেডসেটে পরাবাস্তব বা কৃত্রিম সব কিছুকেই মনে হয় বাস্তব বা আসল।

ভিআর হেডসেটের রয়েছে অসংখ্য ধরন। মূলত প্রসেসিং ইউনিট (Processing Unit) ও এর সাথে যোগাযোগের মাধ্যমের উপর নির্ভর করে এদের চার ভাগে ভাগ করা যায়।

    • কম্পিউটার নির্ভর ভিআর হেডসেট – এই ধরনের হেডসেটের প্রসেসিং ইউনিট হিসেবে কাজ করে একটি শক্তিশালী কম্পিউটার। 
    • কনসোল নির্ভল ভিআর হেডসেট – এই ধরনের হেডসেটের প্রসেসিং ইউনিট হিসেবে কাজ করে একটি কনসোল। যেমন প্লেস্টেশন একটি গেমিং কনসোল। তেমনি আরও সূক্ষ্ণ কাজের জন্য রয়েছে আরও নানা ধরনের কনসোল। 
    • তারবিহীন ভিআর হেডসেট। 
    • তারযুক্ত ভিআর হেডসেট।

ভিআর হেডসেটের উপাদান

একজন ব্যক্তির সাথে পরাবস্তব জগতের সংযোগের প্রধান দায়িত্বটিই পালন করে ভিআর হেডসেট। তাই ভার্চুয়াল রিয়েলেটিকে বুঝতে চাইলে অবশ্যই এ ধরনের হেডসেটের উপাদান বা যন্ত্রাংশ সম্পর্কে ধারনা থাকা আবশ্যক।

  • লেন্স এবং স্ক্রিন (Lense & Screen) 
  • প্রজেক্টর (Projector) 
  • আরজিবি ক্যামেরা (RGB Camera) 
  • ডেপথ ক্যামেরা (Depth Camera) 
  • নয়েজ ক্যান্সেলিং মাইক্রোফোন (Noise Cancelling Microphone) 
  • টিল্ট মেকানিজম (Tilt Mechanism)
  • নোজপ্যাড (Nosepad) 
  • হেডফোন পোর্ট (Headphone Port) 
  • টাইটনেস এডজাস্টার (Tightness Adjuster) 
  • স্পিকার (Speaker) 

মোশন সেন্সর (Motion Sensor)

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি তৈরির ক্ষেত্রে হেডসেট এবং কম্পিউটার / কনসোলের পরে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে এই মোশন সেন্সর। একে মোশন কন্ট্রোলারও বলে। Motion শব্দের অর্থ গতি। আর Sensor শব্দের বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘যা অনুভব করে’। তার মানে মোশন সেন্সর স্বভাবতই এমন সেন্সর যা গতিকে অনুভব করে বা উদ্দীপনা গ্রহণ করে। মোশন সেন্সর গুলো  আলাদা ভাবে অথবা একটি স্যুটের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে লাগানো থাকে।

মূলত ভার্চুয়াল রিয়েলিটি একটি পূর্ণাঙ্গ অভিজ্ঞতা প্রদানের লক্ষ্যেই কাজ করে। এ জগতকে আপনি শুধু দেখবেনই না বরং অনুভব করবেন। প্রয়োজনে চলাফেরা করতে পারবেন, কোনো বস্তুকে ধরার অনুভূতি পেতে পারবেন, কোনো কাজ করতে পারবেন। আর আপনি যে কাজটি করতে চাচ্ছেন তা কম্পিউটার বুঝতে পারে এই মোশন সেন্সরের মাধ্যমে। আপনি যখন হাত বাড়িয়ে কিছু ধরতে চাইবেন তখন আপনার আঙ্গুল থেকে প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করে মোশন সেন্সর কম্পিউটার অথবা কনসোলে পাঠাবে। আর সে প্রতিক্রিয়া অনুযায়ীই কম্পিউটার পরাবস্তব জগত তৈরি করবে। অথবা আপনার প্রতিক্রিয়া অনুযায়ী সে জগতের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনবে। যেমন আপনি হাত দিয়ে একটি বই তুলে নিতে চাইলে আপনার হাতের প্রতিক্রিয়া চলে যাবে কম্পিউটারে। আর কম্পিউটার আপনাকে এমন দৃশ্য দেখাবে যে আপনি বইটি হাতে তুলে নিচ্ছেন। 

সফটওয়্যার (Software)

ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ক্ষেত্রে এর হার্ডওয়্যার গুলো ছোয়া যায় বিধায় এগুলোর কথাই বেশি আলোচনায় থাকে। কিন্তু বাস্তবে মূল কাজটা করে সফটওয়্যার। হার্ডওয়্যার গুলো মাধ্যম হিসেবে শরীরের উদ্দীপক কম্পিউটার / কনসোলে পৌছে দেয়। আর সফটওয়্যারের কাজ হচ্ছে সেই উদ্দীপনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে পরাবাস্তব জগতটিকে তৈরি বা পরিবর্তন করা। আর প্রতিটি ভার্চুয়াল জগতের জন্য ভালো মানের সফটওয়্যার কোম্পানি গুলো বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার তৈরি করে  থাকে বিশেষ কিছু সফটওয়্যারের মাধ্যমে। এদের বলা হয় ডেভেলপমেন্ট সফটওয়্যার। যেমনঃ

  • ভার্চুয়াল রিয়েলিটি অন স্টিম (Virtual Reality on Steam)
  • গুগল কার্ডবোর্ড (Google Cardboard)
  • গুগল স্কেল (Google Scale)
  • ফোর্জ (Forge)
  • লিপ মোশন (Leap Motion)

আবার ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সফটওয়্যার গুলো চালানোর জন্যও প্রয়োজন হয়ে থাকে কিছু বিশেষ সফটওয়্যারের। এদের বলা হয় ‘ইঞ্জিন’ (Engine)। গেমের ক্ষেত্রে কিছু বিখ্যাত ইঞ্জিন হলোঃ

  • ইউনিটি (Unity)
  • থ্রিডি ম্যাক্স ডিজাইন (3d Max Design) 
  • আনরিয়েল ইঞ্জিন (Unreal Engine)
  • মায়া (Maya)
  • আমাজন লাম্পইয়ার্ড (Amazon Lumpyard)

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কিভাবে কাজ করে?

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কিভাবে কাজ করে তার সাধারণ ধারনা হয়তো ইতোমধ্যে পেয়ে গেছেন। তবে বিস্তারিত ধারনা পেতে চাইলে যেতে হবে আরেকটু গভীরে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সৃষ্টি হয় মূলত কয়েকটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আর এসব প্রক্রিয়ার‍ সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে এর ভিআর হেডসেটের যন্ত্রাংশ গুলো।

দৃশ্যের অবতারণা

পরাবাস্তব জগত বা দৃশ্যের অবতারণা মূলত হয়ে থাকে এর হেডসেটের সাহায্যেই। আর হেডসেটের লেন্স এবং স্ক্রিনকে বলা যায় এর প্রধান যন্ত্রাংশ। কারণ এর মাধ্যমেই মূলত ব্যবহারকারী পরাবাস্তব জগতটিকে দেখেন। এই হেডসেটে থাকে লেড স্ক্রিন। আর সেই লেড স্ক্রিন এবং চোখের মধ্যে থাকে দুইটি স্টেরিওস্কোপিক লেন্স (Stereoscopic Lense)। স্টেরিওস্কোপিক লেন্সের অর্থ হলো দুইটি লেন্স যারা একই বস্তুর দুইটি চিত্র একই সাথে দেখায়। এর ফলে দূরত্ব, গভীরতা এসবের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। একই সাথে অবলাল বা ইনফ্রারেড ক্যামেরাও প্রয়োজন অনুসারে আলোর সামঞ্জস্য ঘটায়। আবার ব্যবহারকারী ঘাড় ঘুরালে তার সাথে সাথে স্ক্রিনের দৃশ্যও পরিবর্তিত হয়। সব মিলিয়ে তৈরি হয় প্রায় বাস্তবের কাছাকাছি দৃশ্য দেখার অনুভূতি।

মাথা এবং শরীরের অবস্থান নির্ণয়

পরাবাস্তব জগতের দৃশ্য গুলো  আপনার শারিরীক নড়াচড়ার সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হয়। এর জন্য ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সিস্টেমকে অবশ্যই আপনার শরীরের অবস্থা নির্ণয় করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে হেডসেটের টিল্ট মেকানিজম এবং শরীরে লাগানো মোশন সেন্সর। এই প্রক্রিয়াকে বলে ‘হেড অ্যান্ড পজিশন ট্র্যাকিং’ (Head and Position Tracking)। একে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়।

  • থ্রি ডিগ্রি অফ ফ্রিডম (Three Degree of Freedom – 3FoD): এ ব্যবস্থায় ব্যবহারকারী শুধু ডানে বামে এবং উপরে নিচে তাকানোর অনুভূতি পেতে পারেন। 
  • সিক্স ডিগ্রি অফ ফ্রিডম (Six Degree of Freedom – 6Fod): এ ব্যবস্থায় ব্যবহারকারী ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে তাকাতে পারেন। অর্থাৎ ডানে, বামে, উপরে, নিচে, কোণাকুণি সব ভাবেই।

সিক্স ডিগ্রি অফ ফ্রিডম সম্বলিত হেডসেট গুলো র মাধ্যমে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির প্রকৃষ্ট রুপের সন্ধান পাওয়া যায়। এই প্রক্রিয়া মূলত ইয়, (Yaw) পিচ (Pitch) এবং রোল (Role) মূলনীতিকে ব্যবহার করে কাজ করে। 

  • ইয় (Yaw): এর সাহায্যে মাথা ডানে বামে কতটুকু ঘুরছে তা নির্ণয় করা হয়। 
  • পিচ (Pitch): এর সাহায্যে মাথা উপরে নিচে কতটুকু ঘুরছে তা নির্ণয় করা হয়। 
  • রোল (Role): এর সাহায্যে মাথা কোণাকুণি কতটুকু বাকছে তা নির্ণয় করা হয়। 

এই তিনের সাহায্যে মাথা কতটুকু কোনদিকে ঘুরছে তা সম্পূর্ণ নির্ণয় করা যায়। ফলে সৃষ্টি করা যায় পূর্ণাঙ্গ পরাবাস্তব অভিজ্ঞতা।

ফ্রেমরেট (Framerate)

ফ্রেমরেট হলো এমন একটি টার্ম (Term) যার সাহায্যে বোঝায় প্রতি সেকেন্ডে কতটি ছবি দেখানো হচ্ছে। বর্তমানে গেমিং মনিটর হিসেবে ১৪৪ হার্টজ থেকে শুরু করে ২৬৫ হার্টজ এমনকি ৩৬০ হার্টজ এর মনিটরও পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে এসব মনিটরে ১৪৪, ২৬৫ বা ৩৬০টি ছবি দেখা যায়। মজার ব্যাপার হলো মানুষের চোখ প্রতি সেকেন্ডে ১০০০টি ছবি দেখতে পারলেও অপটিকাল নার্ভ (Optical Nerve) তা মস্তিষ্কে বহন করতে পারে না। অপটিকাল নার্ভের ধারন ক্ষমতা অনুযায়ী মানুষ প্রতি সেকেন্ডে ১৫০টি ছবির আশেপাশে দেখতে পারে। আর ভার্চুয়াল রিয়েলিটির হেডসেট গুলো বর্তমানে আমাদের সেকেন্ডে ৯০টি ছবি দেখিয়ে থাকে। তবে অদূর ভবিষ্যতেই ১২০ হার্টজ এর হেডসেটও বাজারে আসবে।

শব্দ সৃষ্টি

শব্দ বা ধ্বনি। যেকোনো অভিজ্ঞতাকেই আরও অনেক বেশি জীবন্ত এবং বাস্তব করে তোলে শব্দ। আর তাই ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে দৃশ্যের অবতারণার পাশাপাশি শব্দ বা ধ্বনি সৃষ্টিও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বর্তমানের হেডসেট গুলোতে প্রায় বাস্তব অনুভূতির সাথে মিল রেখেই শব্দের সৃষ্টি হয়। শুধু শব্দই নয়, এসবে রয়েছে প্রতিধ্বনি এবং কম্পন সৃষ্টির ব্যবস্থাও। 

এই সকল কিছুর পাশাপাশি মোশন সেন্সর এবং সফটওয়্যার ঠিক কিভাবে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি তৈরিতে ভূমিকা রাখে তা ইতোমধ্যেই আলোচনা করেছি। 

ভার্চুয়াল রিয়েলিটির প্রকারভেদ

ইতোমধ্যে আপনারা ভার্চুয়াল রিয়েলিটির উপাদান আর এটি কিভাবে কাজ করে তা সম্পর্কে বেশ অনেকটাই ধারনা পেয়েছেন। চলুন জানা যাক ভার্চুয়াল রিয়েলিটি আসলে কত প্রকার এবং তাদের বৈশিষ্ট্য কি কি।

নন-ইমার্সিভ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি

নন-ইমার্সিভ (Non-Immersive) ভার্চুয়াল রিয়েলিটিকে বলা যায় ভিআর এর সবচেয়ে সরল রুপ। এই ধরনের ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে ভিআর হেডসেটের ব্যবহারই থাকে না। বরং মনিটরের মাধ্যমেই এই অভিজ্ঞতা গ্রহণ করতে হয়। এক্ষেত্রে একে পুরোপুরি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বলা যায় না। 

এই ধরনের ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সাথে সাধারণ কম্পিউটার ব্যবহারের পার্থক্য হলো এতে ব্যবহারকারির মিথস্ক্রিয়তা অনেক বেশি। যাকে ইংরেজিতে বলে ইন্টারএকটিভিটি (Interactivity)। যেমন ফোরজা হরিজন (Forza Horizon) এর মতো গেম স্টিয়ারিং, ক্লাচ, গিয়ার, এক্সিলেটর, ব্রেকস ইত্যাদি ব্যবহার করে খেলা যায়। বিশেষ চেয়ার ব্যবহার করে ঝাকুনিরও অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। এগুলোকে বলে নন-ইমার্সিভ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি। 

সেমি-ইমার্সিভ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি

সেমি-ইমার্সিভ (Semi-Immersive) ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সাধারণত ব্যবহৃত হয়ে থাকে সত্যিকারের দৃশ্যের প্রেক্ষাপটে। এখানে কৃত্রিম জগত তৈরির বদলে বাস্তব জীবনের কোনো একটির দৃশ্যেরই পরিবর্তন আনা হয়। যেমন পাইলটেরা প্রাথমিক ভাবে সেমি-ইমার্সিভ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করে বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ নেন। 

ফুললি ইমার্সিভ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি

ফুললি ইমার্সিভ (Fully Immersive) ভার্চুয়াল রিয়েলিটিকে বলা যায় ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সর্বোৎকৃষ্ট রুপ। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই কৃত্রিম জগতের সাথে বাস্তব জগতকে আলাদা করা খুবই কঠিন। যাকে বলে সত্যিকারের পরাবাস্তবতা। এই ধরনের ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতেই ৩৬০ ডিগ্রি ফ্রিডম পাওয়া যায়। সাধারণত এসব ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বিনোদনমূলক কার্যক্রমেই বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। 

ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার

সময় যতো গড়াচ্ছে, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ততই মানুষের দৈনন্দিন প্রযুক্তি হিসেবে স্থান করে নিচ্ছে। এখনো এই প্রযুক্তিটি একটি নতুন প্রযুক্তি হিসেবেও বিবেচিত হলেও এর ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ছে সব ক্ষেত্রে।

গেমিং

গেমিংই হলো ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সবচেয়ে বড় ব্যবহার ক্ষেত্র। তবে একে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ গেমিং ইন্ডাস্ট্রি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ইন্ডাস্ট্রি গুলোর মধ্যে একটি। ট্রিলিয়ন ডলারের এই ইন্ডাস্ট্রিতে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির বাজার স্থান করে নেবে বিলিয়নের ঘরে। 

প্রশিক্ষণ

ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সবচেয়ে জরুরী এবং কার্যকরী ব্যবহার এই প্রশিক্ষণ। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির প্রথম ব্যবহারও ছিল এটি। বর্তমানে অসংখ্য খাতে প্রশিক্ষণের জন্য ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিমান চালনো থেকে শুরু করে ট্যাংক চালনা, ট্রেন চালানার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের আগেই ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রের অনুভূতি প্রদান করার জন্যেও বর্তমানে সৈনিকদের ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সাহায্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। 

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপনের এমন ধরন এখনো ততটা বহুল প্রচলিত না হলেও ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হতে যাচ্ছে এটি। চিন্তা করুন, আপনি একটি গাড়ি অথবা বিমান কিনতে চান। সেটি কেনার আগেই আপনি এর ভেতরকার সমস্ত খুটিনাটি নিজের চোখে দেখতে পাবেন। এটি চালানোর অনুভূতি নিতে পারবেন। 

শুধু গাড়ির মতো দামি বস্তুই নয়, সাধারণ জুতা, কাপড়ের মতো বস্তুও আপনি পড়লে কেমন লাগবে তা জানতে পারবেন ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সহোদর অগমেন্টেড রিয়েলিটির সাহায্যে। 

শিক্ষা

গবেষণা বলে মানুষ কোনো কিছু পড়ে যতটুকু মনে রাখতে পারে, দেখে মনে রাখতে পারে তার চেয়ে অনেক বেশি। চিন্তা করুন, পদার্থবিজ্ঞান ক্লাসে আপনি সরাসরি দেখছেন মহাবিশ্বে গ্রহ নক্ষত্রের ঝলকানি। অথবা জীববিজ্ঞান ক্লাসে আপনার আশেপাশে দেখছেন আফ্রিকার গহীন জঙ্গলে প্রাণিদের আচরণ। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রায়। 

চিকিৎসা

ভার্চুয়াল রিয়েলিটির বড় একটি ক্ষেত্র এখন চিকিৎসা খাত। যেসব অপারেশনে রোগীর জ্ঞান রাখতে হয় সেসব অপারেশনে রয়েছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার। উন্নত দেশে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সাহায্যে রোগীদের মনোযোগ সরিয়ে স্নায়ু স্বাভাবিক রাখা হয়। এছাড়াও মানসিক চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহারের নজির রয়েছে। 

ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ঝুঁকি

ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার গুলো সম্পর্কে জানার মাধ্যমেই এর উপকারিতা সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। কিন্তু অন্য সকল প্রযুক্তির মতই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এরও রয়েছে বেশ কিছু ঝুঁকি। 

পরিবেশের খেয়াল না থাকা

ইমার্সিভ ভার্চুয়াল এক্সপেরিয়েন্স এর ক্ষেত্রে মানুষের মস্তিষ্ক খুব দ্রুতই এটির সাথে মানিয়ে নিতে পারে। মাত্র ৩০ মিনিটেই মানব মস্তিষ্ক নিজেকে পরাবাস্তব জগতে অভ্যস্থ করে ফেললেও মানুষের শরীরের পক্ষে বাস্তব জগত ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে অবস্থানের খেয়াল না থাকায় অনেকেই পড়ে গিয়ে ব্যাথা পান। দাঁত পড়ে যাওয়া, হাড় ভাঙ্গা এর পাশাপাশি খাদ থেকে পড়ে যাওয়ার মতও ঘটনা ঘটেছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করতে গিয়ে।  

শারীরিক সমস্যা

যারা নিয়মিত ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করেন তাদের অনেকেই শারীরিক সমস্যার কথা রিপোর্ট করেছেন। বিশেষ করে গেমাররা অনেক বেশি সময় ভিআর হেডসেট পড়ে থাকেন। এক্ষেত্রে দেখা যায় চোখের বেশ সমস্যা হয়ে থাকে। এমনকি মাথা ঘোরানো, শরীর খারাপ লাগে এমনকি খিঁচুনি এর মতো মারাত্নক শারীরিক সমস্যাও অনেকের দেখা গেছে। 

বাস্তব জগতের প্রতি বিরক্তি

পরাবাস্তব জগত তেমনটাই হবে যেমনটা আপনি চান। আর ডিপ্রেশনে ভোগা অনেক ব্যক্তির কাছেই দুর্বিষহ জীবনের চাইতে পরাবাস্তব কৃত্রিম জগতটাই বেশি গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এতে করে সৃষ্টি হয় মারাত্নক সমস্যার। কারণ পরাবাস্তব জগত যতই সুন্দর হোক তা কৃত্রিম। বাস্তব জগতের স্থান এটি কখনই নিতে পারবে না। 

আসক্তি

যেকোনো মনোরঞ্জক জিনিসের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়া মানব জাতির পুরোনো স্বভাব। এর ব্যতিক্রম নয় ভার্চুয়াল রিয়েলিটি। এর প্রতি আসক্তি হতে পারে মাদকাসক্তি থেকেও ভয়ংকর। 

শেষকথা

আর সকল প্রযুক্তির মতই ভার্চুয়াল রিয়েলিটিও অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করছে। বর্তমানে এই প্রযুক্তি খুব বেশি ব্যবহৃত না হলেও সামনের পৃথিবীতে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি দখল করবে এক বিশাল স্থান। বিশেষ করে ইন্টারনেটের পরবর্তী ভার্সন যে হবে ভার্চুয়াল রিয়েলিটিকে ঘিরে এমনটাও মন্তব্য করেছেন অনেকে। তাই এখন থেকেই জেনে রাখা উচিত এই প্রযুক্তি সম্পর্কে। আশা করি এই লেখার মাধ্যমে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সম্পর্কে আপনার জ্ঞান পিপাসা অনেকটাই পূর্ণ হয়েছে। 

অনবরত জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

১। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এর খরচ কেমন?

উত্তরঃ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বেশ খরুচে প্রযুক্তি। একটি ভাল মানের হেডসেট কিনতে হলেই প্রয়োজন ৫০০ থেকে ১০০০ ডলার। বাংলাদেশে সরাসরি বিক্রি হয় না বলে হেডসেট প্রতি শিপিং চার্জ পড়তে পারে ১৫০ থেকে ২০০ ডলার। এছাড়া কম্পিউটার বা কনসোলের জন্য অবশ্যই আলাদা বড় বাজেট রাখতে হবে। 

২। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হেডসেট কিনলে কি সাধারণ গেমগুলোও ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে খেলা যাবে?

উত্তরঃ অবশ্যই না। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এর জন্য প্রয়োজন আলাদা ভাবে তৈরি গেম। তবে সাধারণ গেমের ভার্চুয়াল ভার্সন থাকলে তা খেলা যাবে। যেমন ফলআউট ৪ ভিআর। 

৩। অগমেন্টেড রিয়েলিটি এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি এক?

উত্তরঃ না, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি তে আলাদা করে একটি পরাবাস্তব জগত সৃষ্টি করা হয়। আর অগমেন্টেড রিয়েলিটি তে আপনার চেনা জগতেই একটি বস্তু বসিয়ে তা দেখতে কেমন লাগবে তা দেখানো হয়। যেমন আপনি একটি জুতা পড়লে তা আপনাকে কেমন মানাবে বা একটি সোফা কিনলে ঘরে কেমন ফিট হবে এসব দেখানোই অগমেন্টেড রিয়েলিটির বর্তমান কাজ। 

৪। বাংলাদেশে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অভিজ্ঞতা কোথায় পাওয়া যাবে?

উত্তরঃ নন-ইমার্সিভ এবং সেমি-ইমার্সিভ ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অভিজ্ঞতা নিতে পারবেন। নন-ইমার্সিভ রিয়েলিটি নিজেই সেটআপ কেনার মাধ্যমে বাসায় স্থাপন করতে পারেন। আবার বিভিন্ন ফান ওয়ার্ল্ড এ পাবেন নন-ইমার্সিভ ও সেমি-ইমার্সিভ অভিজ্ঞতা। এছাড়াও বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘরেও মেশিনগান ফায়ার করার জন্য একটি সেমি-ইমার্সিভ ভার্চুয়াল সিস্টেম আছে। কিন্তু ফুললি ইমার্সিভ অভিজ্ঞতা বর্তমানে কোথাও দেওয়া হচ্ছে না। এগুলো বিমান চালনা, ট্যাংক চালনা এসব সিমুলেশনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Back to top button