খেলাধুলাখেলার খবরদাবা

দাবা খেলার উপকারিতা

দাবা আমাদের এই উপমহাদেশ সহ পুরো বিশ্বেই অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খেলা। এই খেলাটিতে ভালো একজন খেলোয়াড় হতে চাইলে গভীর মনোযোগ এবং দূরদর্শী চিন্তাশক্তির প্রয়োজন হয়। যা এই খেলাটিকে অন্যান্য অনেক খেলার থেকেই আলাদা করে রেখেছে। ফলে শারীরিক দক্ষতার জন্য অন্যান্য অনেক খেলার পাশাপাশি মানসিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার জন্য দাবা খেলার জুড়ি নেই। এমনকি অনেকে তার বিভিন্ন মানসিক বিষয়ে দক্ষতা বাড়ানোর জন্যও দাবা খেলা শিখে থাকেন এবং অনেকেই নিয়মিত দাবা খেলেন। তাই দাবা খেলতে জানেন না অথবা দাবা খেলা শিখছেন বা শিখতে আগ্রহী এরকম অনেকের মনেই দাবা খেলার উপকারিতা সম্পর্কে প্রশ্ন জাগতে পারে। এখানে তাই দাবা খেলার বেশকিছু  উপকারিতা বর্ণনার চেষ্টা করছি।

দাবা খেলার ১৫ টি উপকারিতা

যুক্তিসঙ্গতভাবে চিন্তা করতে শেখায়

দাবা খেলাতে প্রতিটি চাল দেওয়ার জন্যই একজন খেলোয়াড়কে যুক্তিসঙ্গতভাবে চিন্তা করতে হয়।কখনো কখনো খেলার সময় কোন একটি ভুল চাল দেওয়ার কারণে পুরো একটি ম্যাচও হেরে যেতে হতে পারে। ফলে প্রতিটি চাল দেওয়ার আগে, “এই চালটি কেন দিতে হবে?”, “এর ফলে কি হতে পারে?” এধরণের প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা করতে হয়। এতে করে নিয়মিত দাবা খেলায় যুক্তিসঙ্গতভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা তৈরী হয়ে যায় একজন দাবাড়ুর।

স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি

দাবা খেলা তাৎক্ষণিক স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করতে অনেক সাহায্য করে। দাবা খেলায় পারদর্শী হতে হলে অন্ততপক্ষে পূর্ববর্তী বেশ কতগুলো নিজের ও বিপক্ষ খেলোয়ারের চাল কি ছিল তা মনে রাখতে হয়। এবং এই তথ্য বিশ্লেষণ করে খেলা এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। দাবা খেলার হারজিতের অনেকাংশই এর উপরে নির্ভর করে। তাই নিয়মিত দাবা খেললে একজন দাবাড়ুর তাৎক্ষণিক স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়।

ধৈর্যশক্তি বাড়ায়

দাবা খেলার অন্যতম একটি প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে ধৈর্যশক্তি থাকা। সাধারণভাবে একটি দাবার ম্যাচ ২০ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তবে আবার কিছু কিছু সময় ৬ ঘণ্টার বেশিও খেলা চলতে পারে। এই পুরোটা সময়ই একজন দাবাড়ুকে প্রতিটি চাল, পরবর্তী কি চাল দিতে হবে, খেলার অবস্থা নিয়ে চিন্তা করতে থাকতে হয়। ফলে নিয়মিত দাবা খেললে খেলোয়াড়দের ধৈর্যশক্তি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। 

সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ায়

দাবা খেলায় প্রায়ই ম্যাচের অবস্থা পরিকল্পনার বাইরে চলে যেতে পারে। একজন সুচিন্তিত দাবড়ুর বিপক্ষে প্রায়সময়ই গতবাধা কৌশল কাজে লাগে না। তাই যারা নিয়মিত দাবা খেলে তাদের প্রায়ই সম্পূর্ণ নতুন ধরনের পরিস্থিতিতে, নতুন ধরনের সমস্যায় পরতে হয়। এধরণের পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে একটি ম্যাচ জেতাই একজন খেলোয়াড়ের যোগ্যতা নিরুপণ করে। ফলে নিয়মিত দাবা খেললে এবং খেলায় দক্ষ হতে পারলে একজন দাবা খেলোয়াড়ের সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।

মনোযোগ বাড়ায়

দাবা খেলা একটি গভীর মনোযোগের খেলা। দাবা খেলার একটি ম্যাচের পুরোটা সময়ই একজন খেলোয়াড়কে দাবার বোর্ডে কোথায় কি হচ্ছে তা খেয়াল করতে হয়। কখনো কখনো সামান্য কিছুক্ষণের জন্য মনোযোগ সরে গেলেই একটি ম্যাচ হেরে যেতে হতে পারে। ফলে একজন ভালো দাবাড়ুকে অবশ্যই খেলার সময় তার সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হয়। ফলে নিয়মিত দাবা খেলার ফলে খেলোয়াড়দের মনোযোগ অন্যান্য প্রায় সকল ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়।

হেরে গেলে মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরী করে

দাবা খেলা সবসময়ই শুধুমাত্র ২ জনের মাঝে হয়। ফলে দক্ষতার দিকটি বাদ দিলে একটি ম্যাচ জেতার বা হারার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ হয়ে থাকে। অর্থাৎ দাবা খেলায় একটি ম্যাচ হেরে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। এমনকি একজন খুবই দক্ষ দাবাড়ুও হেরে যেতে পারেন একটি ম্যাচ কোন ছোট ভুলের কারণে। তাই দাবা খেলা হেরে গেলে তা মেনে নেওয়ার শিক্ষা দেয়। যা বাস্তবজীবনেও একই ভাবে প্রভাব ফেলে।

ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া শেখায়

দাবা খেলায় একজন দক্ষ দাবাড়ুকে আরেকজন দক্ষ খেলোয়াড়ের বিপক্ষে খেলতে হলে নির্ভুলভাবে খেলে যেতে হতে পারে ঘন্টার পর ঘন্টা। কিন্তু এধরণের একটি ম্যাচে ছোট্ট একটি ভুল বা ছোট্ট একটি সময়ের জন্য মনোযোগ বিচ্যুতির কারণেই ম্যাচ হেরে যেতে হয়। ফলে স্বভাবতই একজন দাবাড়ুর মনে সেই ভুলটি হওয়ার কারণ গেঁথে যায়। এবং একজন দক্ষ দাবাড়ু সবসময়ই পরবর্তীতে এধরণের ভুল না করার চেষ্টা করে থাকেন। তাই নিয়মিত দাবা খেললে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া শেখা যায়।

সৃজনশীল চিন্তাশীলতা বৃদ্ধি করে

দাবা খেলার ফলে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই সৃজনশীল চিন্তাশীলতা বৃদ্ধি পায়। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েরা দাবা খেলার ফলে সৃজনশীল কর্মকান্ডে অন্যান্যদের তুলনায় ভালো ফলাফল করতে পারে।

চাপের মাঝেও চিন্তা করার দক্ষতা বৃদ্ধি করে

অধিকাংশ দাবার ম্যাচ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই প্রত্যেক খেলোয়াড়ের মাঝে খেলায় জেতার জন্য এক প্রকার চাপ কাজ করে। এসময় প্রতিটি চালই ম্যাচের ভাগ্য চিন্তা করে দিতে হয়। কিন্তু একইসাথে প্রতিটি চাল দেওয়ার জন্যই তার পরবর্তীতে কি কি হতে পারে তা নিয়ে চিন্তা করতে হয়। এর ফলে দাবাড়ুদের অত্যান্ত চাপের মাঝে কাজ করেও বিষদভাবে চিন্তা করার একটি দক্ষতা তৈরী হয়ে যায়। 

ভিন্ন ভিন্ন প্যাটার্ন চেনার ও মনে রাখা শেখা যায়

দাবা খেলায় বহুবছর ধরে বহু দক্ষ দাবাড়ু ভিন্ন ভিন্ন ভাবে জিতে এসেছেন। এদের মাঝে অসংখ্য নিয়ম ও কৌশল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি ম্যাচ জিততে সাহায্য করায়, সেসব নিয়ম ও কৌশল বেশ প্রচলিত হয়ে উঠেছে। যেমনঃ কুইন’স গ্যামবিট, সিসিলিয়ান ডিফেন্স ইত্যাদি। এধরণের অসংখ্য প্যাটার্ন বিভিন্ন ভাবে প্রয়োগ হতে পারে একটি ম্যাচে। সেই প্যাটার্নটি না চিনতে পারলে এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে একটি ম্যাচ হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। ফলে একজন দাবাড়ুকে একটি ম্যাচে বিভিন্ন নতুন নতুন প্যাটার্ন চিনতে পারতে হয়। এটি বাস্তব জীবনেও তার ভিন্ন ভিন্ন প্যাটার্ন চেনার ও মনে রাখার দক্ষতা বৃদ্ধি করে।

কোন কাজ করার ফলাফল কি হতে পারে তা চিন্তা করতে শেখায়

দাবা খেলায় প্রতিটি চালের পরবর্তীতে বিপক্ষ দলকে একটি যুক্তিযুক্ত চাল দিতে হয়। ভালো দাবাড়ুদের মধ্যকার ম্যাচের মাঝে প্রতিটি চালই এর পরবর্তীতে বিপক্ষ দল কি করতে পারে, ঐ চালটির ফলাফল কি হতে পারে এগুলো চিন্তা করে দেওয়া হয়। এই বিষয়টি একজন মানুষের কোন কাজ করার ফলাফল কি হতে পারে, তা ধারণা করে নিতে শেখায়। ফলে কোন ভালো কাজের ফলাফল ভালো হবে, খারাপ কাজের ফলাফল খারাপ হবে এগুলো একজনের মাথায় গেঁথে যায়। এই বিষয়টি সাধারণত শিশুদের ক্ষেত্রে বেশী যৌক্তিকভাবে কাজ করে। এতে করে তারা তাদের কাজের ফলাফল ধারণা করে নিয়ে কাজ করতে পারে।

অন্যের অবস্থায় নিজেকে চিন্তা করতে শেখায়

দক্ষ একজন দাবাড়ুকে তার প্রতিপক্ষের পরবর্তী চালগুলো আগে থেকেই ধারণা করে নিতে হয়। একজনের পরবর্তী চালটি কি হতে পারে তা ধারণা করতে হলে একজনকে ঐ খেলোয়াড়ের  অবস্থানে নিজেকে রেখে চিন্তা করতে হয়। এবং সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে সে পরবর্তীতে কি করতে পারে। এই বিষয়টি একজনকে অন্যের অবস্থায় নিজেকে রেখে চিন্তা করতে শেখায়। 

পরিকল্পনার দক্ষতা বাড়ায়

দাবা খেলার জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয় একটি দক্ষতা হলো পরিকল্পনা করার ক্ষমতা থাকা। দাবা খেলায় একজন দাবাড়ুকে একটি ম্যাচে কোন পরিস্থিতিতে কি করতে হবে তা আগে থেকেই চিন্তা করে নিতে হয়। এমনকি দক্ষ দাবড়ুদের মধ্যকার ম্যাচে কোন পরিকল্পনা ভেস্তে গেলেও তৎক্ষনাৎ পরবর্তী করণীয় কি তা চিন্তা করে ফেলতে হয়। এছাড়াও প্রতিটি দাবা খেলার ম্যাচেই জেতার জন্য একাধিক রকমের পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখতে হয়। এর ফলে একজন দাবাড়ুর পরিকল্পনা করার দক্ষতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়।

দূরদৃষ্টি বৃদ্ধি করে

দাবা খেলায় একটি ম্যাচ জেতার অন্যতম শর্ত হলো সঠিকভাবে ম্যাচে কি হতে পারে তা ধারণা করতে পারা। খেলা শুরুর পর অল্প কয়েকটি চালের মাঝেই ম্যাচটিতে কি কি ঘটতে পারে তা ধারণা করে নিতে জানতে হয়। এর জন্য প্রতিপক্ষ কি কি করতে পারে। নিজের কোন চালের ফলে প্রতিপক্ষের কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা ধারণা করে নিতে হয়। এর ফলে বাস্তবজীবনেও কোন কোন ঘটনার ফলে কি কি ঘটতে পারে তা ধারণা করার ক্ষমতা তৈরী হয় একজন দাবাড়ুর। যা তার দূরদর্শিতা অনেকাংশেই বৃদ্ধি করে।

মস্তিষ্কের উভয় পাশেরই সমানভাবে ব্যায়াম হয়

মানুষের মস্তিকের দুইটি ভাগ থাকে। সাধারণত একজন সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের ডান পাশ অথবা বাম পাশের যেকোন একটি অপরটির তুলনায় বেশী কার্যকর হয়। কিন্তু, জার্মানির কিছু গবেষকের গবেষণা দেখা গিয়েছে যে, একজন দক্ষ দাবড়ুর মস্তিষ্কের উভয় পাশই একইসাথে কাজ করতে পারে। এছাড়াও তারা উভয়ই একই রকমের শক্তিশালী হয়ে থাকে। 

শেষকথা

দাবা খেলা অন্যান্য গতানুগতিক খেলার চাইতে কিছু দিক থেকে ব্যতিক্রমধর্মী বলে অনেকেই এই খেলায় আগ্রহী না। কিন্তু এই প্রাচীন খেলাটি অন্যান্য সকল খেলাধুলার মতোই একজনের মানসিক স্বাস্থ্যের বিপুল উন্নতি করতে পারে। এই লেখাটিতে তাই দাবা খেলায় কি কি উপকার হতে পারে তা বর্ণনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। যা কাউকে দাবা খেলায় আগ্রহী করতে চেষ্টা করবে।

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button