আজকের আবহাওয়াআবহাওয়াবজ্রপাত

বজ্রপাত থেকে বাঁচার উপায় কি?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশে বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বর্ষাকালেই বজ্রপাতে অনেক মানুষ মারা যায় যার মধ্যে বেশিরভাগই কৃষক, জেলে ও দিনমজুর, যারা খোলা স্থানে কাজ করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেবল বজ্রপাতেই মারা গেছে ৩০০-৩৫০ জন মানুষ।

সূচিপত্রঃ

বজ্রপাতের কি?

বজ্রপাত

বজ্রপাত বলতে সাধারণত আকাশে মেঘে মেঘে সংঘর্ষের ফলে যে আলোর ঝলকানি সৃষ্টি হয় তাকে আমরা বজ্রপাত বলে থাকি।
উইকিপিডিয়াতে বর্ণিত বৈজ্ঞানীক ব্যাখ্যা অনুযায়ী বায়ুমন্ডলে বাতাসের চাপ কমে যাওয়ার ফলে কিছু কিছু সময় মেঘ নিচের দিক থেকে উপরের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। এবং ধিরে ধিরে পানির পরিমান যখন ৫ মিঃমিঃ অতিক্রম করে তখন পানির অণুগুলো পারস্পারিক বন্ধন টিকিয়ে রাখতে না পারার কারনে বিভক্ত হয়ে যায় এবং সেখান থেকে যেই বৈদ্যুতিক আলোড়ন এর সৃষ্টি হয়ে থাকে একেই বজ্রপাত বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।

বজ্রপাত কেন হয়?

বিজ্ঞানীদের মতে এরকম অস্বাভাবিকভাবে বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি। আর জলবায়ু পরিবর্তনই এই বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। চলুন জেনে নেওয়া যাক এর পেছনের কারণগুলো।

  • পরিবেশ দূষণ।
  • গাছপালা কেটে বনাঞ্চল উজাড় করা।
  • জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়া
  • শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রসহ আরও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়ে যাওয়া।
  • মোবাইল ফোন টাওয়ারের সংখ্যাবৃদ্ধি।
  • গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ।
  • এছাড়াও বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানও এরকম অধিক বজ্রপাতের অন্যতম কারণ।

বজ্রপাতের আগ মুহূর্তের কিছু লক্ষণ

যদিও বজ্রপাত একবার শুরু হয়ে গেলে তেমন কিছু করার থাকে না। তবুও বজ্রপাত হওয়ার আগে কিছু লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। যদি আপনি নিচের পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেন তাহলে সতর্ক হোন এবং দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করুন। যেমন-

  • বিদ্যুতের প্রভাবে আপনার চুল দাঁড়িয়ে যাবে
  • আপনার ত্বক শিরশির করবে।
  • আশপাশের ধাতব পদার্থ কাঁপতে পারে।
  • অনেক ক্ষেত্রে ‘ক্রি ক্রি’ শব্দ পাওয়া যায়।

বজ্রপাতের সময় করণীয়

বজ্রপাতের সময় করণীয়

কিছু সাবধানতা অবলম্বন করে আপনি বজ্রপাত থেকে বাঁচতে পারবেন, এবং সবাই এই সাবধানতাগুলো অবলম্বন করলে অনেক মানুষের জীবন বেঁচে যাবে। বজ্রপাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার কিছু উপায় এখানে আলোচনা করা হলো-

১) দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিন

আকাশে কালো মেঘ দেখলেই সাবধান হোন এবং নিরাপদ জায়গায় চলে যান। এ সময় অন্তত ৩০ মিনিটের মতো সময় পাওয়া যায় নিরাপদ জায়গায় যেতে। আর বৃষ্টি বা ঝড় শুরু না হলে বজ্রপাত হয় না এই ভুল ধারণাতে থাকবেন না। কারণ অনেক ক্ষেত্রে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই বজ্রপাত হয়ে অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তাই ঝড়-বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিন।

২) খোলাস্থান থেকে দূরে থাকা

খোলাস্থানে সবসময় বজ্রপাতের ঝুঁকি বেশি থাকে। গত বছরগুলোতে বজ্রপাতে মারা যাওয়া মানুষগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল কৃষক। কারণ তাদের চাষাবাদ করার জন্য খোলা মাঠে থাকতে হয়। আর সেখানেই আচমকা বজ্রপাতে মারা যান। তাই ঝড়-বৃষ্টির সময় অতিদ্রুত খোলা স্থান ত্যাগ করতে হবে।

৩) দ্রুত উঁচু স্থান ত্যাগ করা

বজ্রপাতের সময় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে যেকোনো উঁচু স্থান।  যেমন- বাড়ির ছাদ, পাহাড় বা টিলা, গাছের উপরে ইত্যাদি। কারণ যে স্থান যত উঁচু, সে স্থান মেঘের তত কাছে তাই বজ্রপাতের সম্ভাবনা তত বেশি। তাই কোনোভাবেই বজ্রপাতের সময় এসব উঁচু স্থানে থাকা যাবে না আর থাকলে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করতে হবে এবং নিরাপদ স্থানে যেতে হবে।

৪) নিচু হয়ে বসে পরা

বজ্রপাতের সময় ফাঁকা বা উঁচু স্থানে থাকলে কানে আঙুল দিয়ে চোখ বন্ধ করে যতটা সম্ভব কম জায়গা নিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে পরতে হবে। কিন্তু এইরকম সময়ে আমরা অনেকেই ভুল করি মাটিতে শুয়ে পড়ে। ভেজা মাটি বিদ্যুৎ পরিবাহী তাই বৃষ্টি এবং সাথে বজ্রপাতের সময় মাটিতে শুয়ে পড়লে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যাবে।

৫) উঁচু গাছপালা ও বৈদ্যুতিক লাইন থেকে দূরে থাকা

বজ্রপাতের সময় উঁচু গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, টাওয়ার বা অনেক উঁচু এমন কোন কিছুতে বজ্রপাত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই কোন উঁচু কিছুর নিচে বা আশেপাশে আশ্রয় নেয়া যাবে না।

৬) টিনের ঘর ও জানালা থেকে দূরে থাকা

বজ্রপাতের সময় টিনের ঘরে না থাকাটাই ভাল। কারণ টিনের ঘর খুব সহজেই বিদ্যুতায়িত হয়। এমন অবস্থায় টিনের ঘরে থাকলেও ধাতব বস্তু স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং ঘরের জানালা বন্ধ করে জানালা থেকে দূরে সরে থাকতে হবে।

৭) ধাতব বস্তু এবং বিদ্যুৎ পরিবাহী যেকোনো বস্তু স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকা

ঝড়-বৃষ্টির সময় ধাতব কোনো বস্তু বা বিদ্যুৎ পরিবাহী যেকোনো কিছু স্পর্শ করা যাবে না। তাই ওই সময়গুলোতে সিঁড়ি বা বারান্দার ধাতব রেলিং, পানির কল, পাইপ, বৈদ্যুতিক তার ইত্যাদি স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

৮) বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রের ব্যবহার থেকে বিরত থাকা

ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে আমরা বড় একটি ভুল করি বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত সব যন্ত্রপাতি চালিয়ে রেখে। বজ্রপাতের সময় টিভি, ফ্রিজ, কম্পিউটার ইত্যাদি বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। এমন কি এই সময় আপনার মোবাইল ফোনটিও চার্জ দেয়া যাবে না।

৯) যাত্রাপথে থাকলে গাড়ির ভেতরেই থাকা

যাত্রাপথে বজ্রপাত শুরু হলে গাড়ির ভেতরেই থাকুন। এমন অবস্থায় গাড়ির ভেতরে থাকাটাই সবচেয়ে নিরাপদ। কারণ গাড়ির উপরে বজ্রপাত হলে সেটা গাড়ির ভিতরে মানুষের ক্ষতি করতে পারে না। বিদ্যুৎ গাড়ির শরীর বেয়ে মাটিতে চলে যায়। তবে গাড়ির ভেতরে কোন ধাতব বস্তুর সংস্পর্শে থাকবেন না।

১০) জলাশয় ও পানি থেকে দূরে থাকা

প্রতিবছর বজ্রপাতে মারা যাওয়া মানুষের মধ্যে বেশিরভাগই কৃষক আর এরপরেই রয়েছেন জেলেরা। এর কারণ নদী বা অন্যান্য জলাশয় একেতো খোলাস্থান তার উপরে পানি বিদ্যুৎ পরিবাহী। তাই বজ্রপাতের সময় পানি থেকে  দূরে থাকুন। কারণ পানিতে বজ্রপাত হলে আপনিও বিদ্যুতায়িত হবেন। তাই এসময় যেকোনো রকম জলাশয় যেমন নদী, খাল, বিল, দিঘী বা পুকুরে থাকলে দ্রুত পানি থেকে উঠে যান।

১১) জনসমাগমে না থাকা এবং একে অপরের থেকে দূরে থাকা

বজ্রপাতের সময় জনসমাগমে থাকা যাবে না। এসময় একে অপরের থেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে সরে থাকতে হবে। এমনকি বাড়ির ভিতরে থাকলেও সবাই এক ঘরে না থেকে আলাদা আলাদা ঘরে থাকাটা বেশি নিরাপদ।

১২) ভেজা জুতা পরে বা খালি পায়ে না থাকা

ভেজা জুতা বিদ্যুৎ পরিবাহী তাই বজ্রপাতের সময় ভেজা জুতা পরে থাকা বিপজ্জনক আর খালি পায়ে থাকা তো আরও বেশি বিপজ্জনক। আশেপাশে কোথাও বজ্রপাত হলে তখন সেখানের মাটি ভেজা থাকলে তা সহজেই আশেপাশের সবকিছু বিদ্যুতায়িত করে ফেলে। তাই ঝড়-বৃষ্টির সময় ভেজা জুতা পরে বা খালি পায়ে থাকা যাবে না।

১৩) বাড়ি সুরক্ষিত করা

বজ্রপাত থেকে বাঁচতে আপনার বাড়িকেও নিরাপদ করতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনার বাড়িতে বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন করতে হবে। সাথে বাড়িতে সকল আর্থিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

বজ্রপাতে আহত হলে করনীয়

কোন ব্যক্তি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে একটুও সময় নষ্ট না করে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এই সময় কিছু কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা জরুরি। বজ্রপাত ও বৈদ্যুতিক শকে আহত ব্যক্তির চিকিৎসা একই। কিন্তু বিদ্যুৎস্পৃষ্ট কাউকে খালি হাতে স্পর্শ করা যাবে না তাতে স্পর্শ করা ব্যক্তিরও শক লাগতে পারে। তাই প্রথমেই বজ্রাঘাতে আহত ব্যাক্তির শরীর থেকে দ্রুত বৈদ্যুতিক চার্জ অপসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, এবং শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন ফিরিয়ে আনার জন্য অনবরত মালিশ করে যেতে হবে।

বজ্রপাত প্রতিরোধক ও জানমালের ক্ষতি কমাতে করণীয়

  • যেহেতু এটা একরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং আগাম আভাস পাওয়া যায় তাই সচেতন থাকাটাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়। তাই যেসব এলাকায় বজ্রপাত বেশি হয় সেসব এলাকায় সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ আরও জোরদার করতে হবে। যেহেতু বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মারা যায় কৃষক, জেলে বা যারা খোলাস্থানে কাজ করে তার,  তাই তাদের সচেতন করতে মাঠ পর্যায়ের কাজ আরও জোরদার করতে হবে।
  • ফাঁকা মাঠে বজ্রপাত বেশি হয় তাই মাঠগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমান সুউচ্চ গাছ লাগাতে হবে। সেক্ষেত্রে তাল বা নারকেল গাছ ভাল কাজে দিবে।
  • গাছ আবহাওয়া ঠাণ্ডা রাখে তাই বনায়নের দিকে জোর দিতে হবে।

বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ

  • বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় নির্মাণ করছে সুউচ্চ টাওয়ার। এতে করে বজ্রপাত লোকালয়ে না হয়ে হবে ওই টাওয়ারে। এই একই কারণে সারাদেশে ১০ লাখ তালগাছ লাগানোর উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।
  • সারা দেশের ৮টি ভিন্ন ভিন্ন জেলাতে পরীক্ষামূলকভাবে স্থাপন করা হয়েছে আগাম সতর্কবার্তা দিতে সক্ষম বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ যন্ত্র বা লাইটনিং ডিটেকটর সেন্সর (Lightning Detector Sensor)
  • এছাড়াও সতর্কতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে শত শত মাঠ-কর্মী।

শেষ কথা

আমরা সবাই সবার নিজের জায়গা থেকে নিজেদের দায়িত্ব পালন করলে আমরা যেকোনো দুর্যোগই সহজেই প্রতিরোধ বা মোকাবেলা করতে পারব। তাই এক্ষেত্রেও আমাদের সবার সচেতন হতে হবে এবং আশেপাশের মানুষদেরকে সচেতন করতে হবে। আর আমরা প্রোগ্রেস বাংলাদেশ স্টাফরাও আশা করি আমাদের এই সচেতনতামুলক লেখাটি আমাদের দেশের মানুষের জানমালের ক্ষতি প্রতিরোধ করতে সহায়ক হবে। সবাই সচেতন থাকুন এবং সুরক্ষিত থাকুন।

 

সর্বশেষ আপডেটের তারিখঃ ১১/০৯/২০২০

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Back to top button