
সাইবার ক্রাইমে অভিযোগ করার নিয়ম
বর্তমানে সামাজিকতা রক্ষার বড় জায়গা দখল করে রেখেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। অবসর কাটানোর অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার, টিকটক; এমনকি প্রত্যেকটি সাইটেই রয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের আনাগোনা। আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন অপরাধ।
আপনার শেয়ারকৃত যেকোনো তথ্য বা ছবি দ্বারাই বিভিন্ন ভাবে হয়রানি বা ক্ষতিগ্রস্থ করা হলে সেটাই আধুনিক ভাষায় সাইবার ক্রাইম বলে পরিচিত। তবে লোকলজ্জার ভয়ে অনেকেই তা জনসম্মুখে আনতে ভয় পান। কোনো অপরাধ লুকিয়ে রাখাটা কিন্তু সঠিক প্রতিকার নয়। তাই আজকে আমার আলোচনা করবো, সাইবার ক্রাইম অভিযোগ করার নিয়ম এবং সহজে তা থেকে বেঁচে থাকার বিভিন্ন কৌশল নিয়ে।
সূচিপত্রঃ
সাইবার ক্রাইমের ধরন
ব্যাক্তিগত বা পেশাদার যেকোনো তথ্য অবৈধ ভাবে ব্যবহার করে ভুক্তভোগীকে বিপদে ফেলাটাই সাইবার ক্রাইমের মূল লক্ষ্য। এছাড়াও আপত্তিকর কোন ছবি বা ভিডিও ফেক আইডি থেকে পোস্ট করে অর্থ আদায় করাটাও এক ধরনের ক্রাইম। হ্যাকিং, সাইবার বুলিং, আইডি হ্যাক, স্ক্যামিং, মানহানি ইত্যাদি নানান পদ্ধতিতে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে হ্যাকাররা। সাইবার ক্রাইম থেকে বেঁচে থাকতে হলে অবশ্যই এর ধরন গুলো সম্পর্কে জানা থাকা চাই।
রোমান্স স্ক্যান্ডাল
বর্তমানে বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালগুলোতে অহরহ যে মামলা টি দেখা যায় তা হলো রোমান্স স্ক্যান্ডাল। প্রায় ৩০% মামলাই এ সম্পর্কিত। কোনো নারীর ব্যাক্তিগত ছবি তার সম্মতি বা অসম্মতিতে ধারন করা হয় এবং পরবর্তীতে তা ভাইরাল করে দেয়া হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। টাকা আদায় বা অহেতুক সেই মেয়েটিকে অসম্মান করার জন্যই এমনটা করা হয়।
বাকি ৭০% মামলা যে সকল বিষয়ে হয়ঃ-
- মিথ্যা তথ্য,
- হুমকি,
- হ্যাকিং,
- উষ্কানি,
- ধর্ম অবমাননা,
- প্রতারণা,
- জালিয়াতি ইত্যাদি।
নারীরা যে কারণে বেশি সাইবার অপরাধের শিকার
সম্প্রতি সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস বা (CCAF) এর প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখা যায়, পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশী সাইবার ক্রাইমের স্বীকার হয়। যেখানে পুরুষ ভুক্তভোগী হলো প্রায় ৪৩% সেখানে নারী ভিকটিম প্রায় ৫৭%। নারীদের বিপদে পড়ার হার বেশী হবার কারণ হলোঃ
- স্বভাবতই নারীরা বেশী বিশ্বাসপ্রবণ সেই তুলনায় খুব অসচেতনও বটে। বিয়ের প্রলোভন বা নানান ভাবে মানসিক চাপ তৈরী করে নারীদের কাছ থেকে অনেক কিছুই আদায় করে নিতে পারে যে-কেউ।
- আমাদের সমাজে নারীরা ভিকটিম হলেও তথাকথিত সামাজিক মানুষদের বাকা চোখ পড়ে নারীদের ওপরেই। এটিকে সামাজিক ট্যাবুও বলা যায়, যার সুবিধা নেয় অপরাধীরা।
সাইবার ট্রাইব্যুনাল
সাইবার ক্রাইম অভিযোগ জানানোর জন্য এবং এর বিচার নিশ্চিত করার জন্য দেশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সাইবার ট্রাইব্যুনাল। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বা ডিজিটাল উপায়ে সংগঠিত যেকোনো অপরাধের মামলা করা যায় সাইবার ট্রাইব্যুনালে।
পুলিশের লিখিত রিপোর্ট পাওয়ার পরই ট্রাইব্যুনাল বিচার শুরু করে। রিপোর্টটি পরীক্ষা করার পর ট্রাইব্যুনাল যদি মনে করে এই মামলাটি নিয়ে আগানো যায় তবেই চার্জগঠন করার পর বিচার শুরু হয়। এরপর কিছু ধাপে বিচার শেষ হয়।
১: সাক্ষ্যগ্রহণ।
২: আসামী পরীক্ষা।
৩: যুক্তিতর্ক।
৪: আসামীর দোষ প্রমাণিত হলে শাস্তি প্রদান অথবা আসামী নির্দোষ হলে বেকসুর খালাস পায়।
সাইবার ক্রাইমের প্রতিকার
অপরাধের মাত্রার ভিত্তিতে সাধারনভাবে দুইভাবে সাইবার ক্রাইমের প্রতিকার করা যেতে পারে।
বড় অপরাধ
বড় অপরাধকে আইনের ভাষায় বলে কগনিসেবল (Cognisable)। এধরনের অপরাধে পুলিশ সরাসরি তদন্ত করতে পারে। এর জন্য থানায় FIR/এজাহার দায়ের করা যায়। অর্থাৎ মামলা দায়ের করা যায়। আর থানায় অভিযোগ আমলে নাও নিতে পারে, সেক্ষেত্রে আইনজীবির সহায়তায় সাইবার ট্রাইব্যুনালে সরাসরি মামলা করা যায়।
ছোট অপরাধ
ছোট অপরাধকে আইনের ভাষায় বলে (Non-cognisable)। এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশের কাছে জিডি করা যায়। উল্লেখ্য যে, জিডি বা এজাহার যাই করা হোক না কেন তদন্তের ফলাফল ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।
সাইবার ক্রাইমে মামলা করার নিয়ম
আপনি যদি ভুক্তভোগী হন এবং পরিচয় গোপন রেখে সাইবার ক্রাইম মামলা করতে চান তবে সেটাও সম্ভব।
- সাইবার অপরাধের স্বীকার হবার পর আপনাকে প্রথমেই কাছাকাছি কোন থানায় অভিযোগ দায়ের করতে হবে।
- সরাসরি যেতে না চাইলে ই-মেইলের মাধ্যমেও জানাতে পারেন আপনার অভিযোগ; সেক্ষেত্রে উপযুক্ত তথ্যাদি মেইলের সাথে এটাচ করে পাঠিয়ে দিতে হবে সাইবার ইউনিটের ঠিকানায়।
মেইল এড্রেস: (cyberhelp@dmp.gov.bd) অথবা (cybersupport.women@police.gov.bd)
- ডিএমপি তাদের ফেসবুক পেইজেও অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা রেখেছে; আপনি সরাসরি তাদের পেইজে মেসেজ করে আপনার অভিযোগটি জানাতে পারেন। তাদের পেইজের নাম ‘Police Cyber Support for Women PCSW’ এবং লিংক (https://www.facebook.com/PCSW.PHQ)
- অনলাইনে বা নিকটস্থ থানায় অভিযোগ দায়ের করতে না চাইলে আপনি যেতে পারেন ডিএমপির সাইবার ক্রাইম অফিসে। তাদের ঠিকানা (ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ৩৬ শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী স্মরণী, রমনা, ঢাকা।)
- পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ফোন করেও জানাতে পারেন আপনার অভিযোগ। সাইবার ক্রাইম হেল্পলাইন নম্বর (০১৩২০০০০৮৮৮) অথবা সাইবার ক্রাইম ইউনিট ফোন নম্বর/ হটলাইন নম্বার (৯৯৯)।
- অপরাধী যদি টাকা দাবি করে, তবে যে মাধ্যমে (বিকাশ বা রকেট) টাকা নিতে চায় থানায় সেই নম্বরটি জানিয়ে দিন। থানা পুলিশ সাহায্য না করলে পুলিশ হেডকোয়ার্টার এর সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ কতে পারেন।
- অভিযোগ দাখিল হবার পর সাথে সাথেই আপনার সমস্যা সমাধান হবে এমন ধারণা রাখা ভূল। তবে আপনাকে অবশ্যই খোজ খবর রাখতে হবে, নিয়মিত ফলোআপ রাখাটাও জরুরি।
অভিযোগ দাখিল করতে যা লাগবে
আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সাহায্য নিতে হলে আপনাকে বেশ সতর্ক থাকতে হবে, এবং আপনাকে অভিযোগ ও অভিযোগ সংক্রান্ত সব তথ্যের ব্যাপারে পরিষ্কার জ্ঞান রাখতে হবে। অভিযোগ সংক্রান্ত সকল তথ্যাদি একত্রিত করে রাখতে হবে।
১: সর্বপ্রথম সংশ্লিষ্ট সব স্ক্রিনশট, লিংক, ছবি, ভিডিও বা যেকোনো ডকুমেন্টস সংগ্রহ করুন। এমন ভাবে স্ক্রিনশট নিন যেন এড্রেস বারে URL ঠিকভাবে বুঝা যায়। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টগুলো বাছাই করুন এবং ক্রমানুসারে প্রিন্ট করে রাখুন।
২: ইমেইলে অভিযোগ জানাতে হলে উপরে উল্লেখিত সকল ডকুমেন্টস মেইলে এটাচ করে পাঠিয়ে দিন।
৩: সর্বোপরি সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কাছে পরামর্শ গ্রহন।
সাইবার ক্রাইম আইন
সাইবার অপরাধের জন্য দুই ধরনের আইন রয়েছে।
১. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬ এবং
২. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- ২০১৮ (এই আইনের টার্মগুলো টেকনিক্যাল তাই সাধারণ মানুষের জন্য সহজবোধ্য নয়)
এছাড়াও প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। সারা দেশে মোট ৮টি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে।
সাইবার ক্রাইমের প্রভাব
সাইবার ক্রাইমের মাত্রা ও প্রভাব দিনকে দিন ভয়াবহ আকার ধারন করছে। কারণঃ
১: সাইবার ক্রাইম ডিজিটালি হয় বলে খুব কম সময়ে এটি ছড়িয়ে পড়ে। আর ভিকটিম তা সম্পর্কে জানার আগেই বন্ধু-বান্ধব বা নিকটাত্মীয়রা তা জেনে যায়। সত্য বা মিথ্যা খোজ নেয়ার আগেই মানুষ তা দেখে এবং আপনার পদক্ষেপ নেয়ার পূর্বেই তা ভাইরাল হয়ে যেতে পারে।
২: সাইবার অপরাধীরা সাইবার এক্সপার্ট হয় তাই সহজেই তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয় না।
সাইবার ক্রাইম এড়িয়ে চলার পদ্ধতি
ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সবাইকেই সাইবার ক্রাইম থেকে বাচতে বেশ কিছু পদ্ধতি মেনে চলতে হয়। সােইবার ক্রাইমের ব্যাপকতা তেকে নিজেকে বাচাতে এগুলো জানা মেনে চলা এবং আশেপাশের সবাইকে জানানোটা আপনার দায়িত্ব এবং কর্তব্য।
১: বিশ্বস্ত সিকিউরিটি সফটওয়্যার ব্যবহার করা যা আপনার ডিভাইসে একের মধ্যে সব সাইবার সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
২: পাসওয়ার্ড ভিন্ন এবং আনকমন রাখা।
৩: সব ধরনের সফটওয়্যার আপডেটেড রাখা।
৪: পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহার না করা।
৫: সোশাল মিডিয়া সাইটে আপনার ব্যাক্তিগত তথ্য সমূহ লক করে রাখা।
শেষ কথা
প্রযুক্তির ব্যবহার যতোই বাড়বে তেমনি বাড়বে সাইবার সংক্রান্ত অপরাধও। সেক্ষেত্রে আমার আপনার সবার উচিত সচেতন থাকা। সচেতন থাকার চেয়ে বড় প্রতিকার আর কিছুই হতে পারে না।
অনবরত জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
১: সাইবার ক্রাইম হেল্পলাইন নম্বর ২০২৩ বাংলাদেশ?
বাংলাদেশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট ফোন নম্বর হলো (০১৩২০০০০৮৮৮)
২: সাইবার ক্রাইম মামলার শাস্তি কি?
বাংলাদেশে সাইবার ক্রাইম মামলার শাস্তি ৭-১৪ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড অথবা ১০ লাখ টাকা জরিমানা।
৩: সাইবার ক্রাইম মামলার ধারা কোনটি?
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ১৪ ধারা অনুসারে সাইবার ক্রাইম অপরাধের শাস্তি প্রদান করা হয়।
৪: সাইবার ক্রাইম কত প্রকার
উদ্দেশ্য অনুসারে সাইবার ক্রাইম তিন প্রকার। যথা: ব্যক্তি সংক্রান্ত, সম্পত্তি সংক্রান্ত এবং সরকার সংক্রান্ত।