ব্যাডমিন্টন খেলার ইতিহাস
ব্যাডমিন্টন, শীতকাল এলেই যে খেলায় বাংলাদেশে মেতে উঠে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বয়স্করাও। শীতের রাতে বাতি জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলা হয়ে উঠে একপ্রকার উৎসবের মতো৷ তবে এ খেলার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। প্রায় ২০০০ হাজার বছর ধরে নানান রূপে নানান অঞ্চলে খেলাটি পরিবর্তিত হতে হতে আজকের এই রূপে এসেছে। ব্যাপক জনপ্রিয় খেলাটির ইতিহাস নিয়েই আজকের এই লেখাটি।
সূচিপত্রঃ
প্রাচীনকালে ব্যাডমিন্টনের স্বরূপ
ব্যাডমিন্টন খেলাটির আধুনিক রূপের শুরু মাত্র কয়েক শতাব্দী হলেও এর ইতিহাস আরো অনেক পুরনো। চলুন জেনে নেওয়া যাক ব্যাডমিন্টন খেলার ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত।
ব্যবলনীয় সভ্যতায় ব্যাডমিন্টন
আজকের যেই অঞ্চলটি ইরাক-ইরান হিসেবে পরিচিত, এই অঞ্চলটিতেই প্রাচীনকালে গড়ে উঠেছিলো ব্যবলনীয় সভ্যতা। ব্যাডমিন্টন খেলার এই ধারনাটি অর্থাৎ একটি ব্যাটের মতো কিছু থাকবে যা দিয়ে সাঁটলের মতো কিছুকে আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় রাখার চেষ্টা করা হবে, তা সর্বপ্রথম শুরু হয়েছিলো এই ব্যবলনীয় সভ্যতাতেই। তবে এ সভ্যতাতে এটি কোন খেলা ছিলো না, বরং ছিলো পুরোহিতদের দ্বারা ভবিষ্যৎ বলার কৌশল।
ব্যবলনীয় সভ্যতার সে যুগে ঢাক ঢোল বাজিয়ে, বিশাল এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো পুরোহিতের নির্দেশে। এরপর একটি কাঠের প্যাডেল বা ছোট বৈঠা দিয়ে তুলোর তৈরি সুতোর গোলাকৃতির বলকে আঘাত করে হাওয়ায় ভাসিয়ে রাখতে হতো৷ যে যত বেশি সময় সেই তুলার সুতার বলটিকে বাতাসে রাখতে পারতো, তার আয়ু তত বেশি এমনটাই বিশ্বাস করা হতো ব্যাবলনীয় সভ্যতায়। তবে এই রীতিটিই সাধারণ জনগণের কাছে একসময় বেশ মজার মনে হয়। ফলে এটি আর কোন ভবিষ্যৎ জানার রীতি নয়, বরং হয়ে যায় একটি বিনোদনের মাধ্যম। এই খেলার ধারনাটি ছড়িয়ে যায় গ্রিস, ভারত, মিশর সহ নানান অঞ্চলে।
জাপানে ব্যাডমিন্টনের ঐতিহ্য
জাপানেও মধ্যযুগে ব্যাডমিন্টনের মতন একটি খেলা বেশ জনপ্রিয় ছিলো। যার নাম “হানেটসুকি”। সে খেলায় “হাগোইটা” নামক চওড়া কাঠের তক্তার মতো র্যাকেট ও “হেন” নামের শাটলকক ব্যবহৃত হতো। জাপানি নববর্ষের উৎসব উদযাপনে এ খেলার বেশ কদর ছিলো। হানেটসুকি এর সাথে আজকের দিনের ব্যাডমিন্টনের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো হানেটসুকি খেলাতে খেলোয়াড়দের মধ্যে কোনরকম প্রতিবন্ধকতা অর্থাৎ নেট থাকতো না।
ব্রিটেনে ব্যাডমিন্টনের পূর্বসুরী
এছাড়াও মধ্যযুগে পুরো ইউরোপ, বিশেষত ব্রিটেনের গ্রামাঞ্চল এ শিশু-কিশোরদের মধ্যে “ব্যাটলডোর অ্যান্ড শাটলকক” নামক একটি খেলা বেশ জনপ্রিয় ছিলো। ব্যাটলডোর হচ্ছে কাঠের প্যাডল৷ শাটলকক নামকরণের কারণ হিসেবে যা জানা যায়, এটি তৈরি করতে মোরগের পালক ব্যবহৃত হতো। শাটলের উপর মোরগের পালক বসানো হতো বিধায় এর এরূপ নাম। বর্তমান ব্যাডমিন্টনে ব্যাটলডোর কে সরিয়ে র্যাকেট ব্যবহৃত হচ্ছে। ইংল্যান্ডের শিশু কিশোররা প্রধানত খ্রিস্টানদের শ্রোভ টুজ’ডে (Shrove Tuesday) নামক এক উৎসবে এই খেলাটি খেলতো। একসময় খেলাটি এতই জনপ্রিয় হয় যে, ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে “শাটলকক ডে” ঘোষণা করে উৎযাপন করা শুরু হয়। সব বয়সের মানুষজন রাস্তায় জড়ো হয়ে একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করে এই খেলা খেলতো৷ আজকের আধুনিক ব্যাডমিন্টন খেলাকে আমরা এই “ব্যাটলডোর অ্যান্ড শাটলকক” এরই উত্তরসূরী বলতে পারি।
আধুনিক ব্যাডমিন্টনের যাত্রা
আধুনিক ব্যাডমিন্টনের যাত্রা শুরু হয় আমাদের এই ভারতবর্ষ থেকেই। বেটি উবার রচিত “A Brief History of Badminton from 1870 to 1949” বই এর তথ্যানুসারে, আধুনিক ব্যাডমিন্টন খেলার জন্ম হয়েছে ব্রিটিশ ভারতের সামরিক কর্মকর্তাদের দ্বারা। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ ভারতের পুনে শহরে এই খেলাটি ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলো। গ্যারিসন নগরী হিসেবে পরিচিত এই পুনে নগরীর নামে এই খেলাটির নামও হয়ে যায় “পুনাহ”। ১৮৬০ এর দশকে গ্যারিসনে ব্রিটিশ সেনা অফিসাররা এই খেলাটি খেলতেন। তারাই আধুনিক ব্যাডমিন্টনের যাত্রা শুরু করেন৷ দুইজনের বদলে চারজন মিলে ব্যাডমিন্টন খেলা শুরু করা, নেট, কোর্টের খুটিনাটি সহ আধুনিক ব্যাডমিন্টনের অনেক নিয়মই এখানে তৈরি করা হয়েছিলো। পুনেতে স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন রাবার দিয়ে তৈরি করা হয় শাটল। তবে যখন আবহাওয়া অনুকূল থাকতো না অর্থাৎ বাতাসের বেগ বেশি থাকতো তখন শাটলককের বদলে ছোট ও হালকা কাঠের বল ব্যবহার করা হতো। এভাবেই যাত্রা শুরু হয় “বল ব্যাডমিন্টন” এর। পুনেতে এই খেলাটি ছিলো ব্যাটলডোর এন্ড শাটলককেরই একটি আধুনিক রুপ। খেলার এই রুপে নেট লাগানোর কারণে ও অন্যান্য নিয়মাবলির উপস্থিতিতে খেলাটি বেশ প্রতিযোগীতাপূর্ণ ও আনন্দদায়ক হয়ে উঠে। ভারত থেকে এই খেলার ধারনাটি ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তারা ব্রিটেনে নিয়ে যান ও সেখানেও এই খেলাটি খুব দ্রুতই জনপ্রিয়তা পায়।
ব্যাডমিন্টন খেলার নামকরণ
আধুনিক ব্যাডমিন্টনের যাত্রায় বেশ বড় ধরনের অবদান রয়েছে ডিউক অফ বিউফোর্টের। দক্ষিণ-পশ্চিম ব্রিটেনের একটি প্রদেশ হলো গ্লোচেস্টারশায়ার। আর তার শাসক ছিলেন এই ডিউক অফ বিউফোর্ট। এ প্রদেশের একটি গ্রামের নাম ব্যাডমিন্টন এবং এখানে ডিউক অফ বিউফোর্টের বিখ্যাত প্রাসাদ রয়েছে যার নাম ব্যাডমিন্টন হাউস। এখানেই ডিউক অফ বিউফোর্ট একটি লন পার্টিতে তার অতিথিদের নিয়ে একটু নতুন ধরনের খেলার আয়োজন করেন। আধুনিক নিয়মের এ খেলাটি ব্যাডমিন্টন হাউজেই প্রথম খেলা হয়েছিলো ১৮৭৩ সালে এবং এরপর থেকে এ খেলাটি দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ব্রিটেনে ছড়িয়ে পড়ে৷ এই ব্যাডমিন্টন গ্রাম এর নাম থেকেই এই খেলাটির নামকরণ করা হয় “দ্যা গেম অফ ব্যাডমিন্টন”। যা পরবর্তীতে পাল্টে গিয়ে হয় শুধুই ব্যাডমিন্টন।
ব্যাডমিন্টন খেলার নিয়মাবলী গঠন
১৮৭৩ সালে ডিউক অফ বিউফোর্ট কর্তৃক ব্যাডমিন্টন হাউজে এ খেলাটিকে পরিচিত করানোর ২ বছরের মাথায় ব্রিটিশ ভারত থেকে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তারা দক্ষিণ-পশ্চিম ব্রিটেনের একটি শহর ফোকেস্টোন এ প্রথম একটি ব্যাডমিন্টন ক্লাব গঠন করেন। ১৮৮৭ সাল অবধি, ব্রিটিশ ভারতের পুনেতে বানানো নিয়মেই ব্যাডমিন্টন খেলাটি খেলা হতো। “বাথ ব্যাডমিন্টন ক্লাব” কর্তৃক সর্বপ্রথম ১৮৮৭ সালে এই খেলার নিয়মগুলোকে আধুনিক রূপদান করে ব্রিটিশদের কাছে আরো গ্রহণযোগ্য করে তোলা হয়।
ব্যাডমিন্টন খেলাটির পূর্নাঙ্গরূপে যাত্রা শুরু হয় ১৮৯৩ সালে। ইংল্যান্ডের পোর্টসমাউথ নামক শহরে “ডানবার” নামক একটি ঘরে ১৮৯৩ সালের ১৭ ই সেপ্টেম্বর ব্যাডমিন্টন অ্যাসোসিয়েশন অফ ইংল্যান্ড ব্যাডমিন্টন খেলার নিয়মাবলী প্রকাশ করে। যে নিয়মের অনেকগুলোই এখনো ব্যাডমিন্টন খেলায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এই অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক আয়োজিত হয় “অল ইংল্যান্ড ব্যাডমিন্টন ওপেন ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপ”। যা ইতিহাসের প্রথমবারের মতো আয়োজিত কোন ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগীতা ছিলো।
আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টনের যাত্রা
ব্যাডমিন্টনের নানান রূপ ইতিহাসে নানান দেশে খেলা হয়ে থাকলেও আধুনিক নিয়মের এই ব্যাডমিন্টন খেলাটি প্রথমে ইংল্যান্ডেই সীমাবদ্ধ ছিলো। তবে ধীরে ধীরে তা আন্তজার্তিকভাবেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ১৯০০ সালে নতুন নিয়ম হিসেবে সিঙ্গেল বা একক সদস্য নিয়ে ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগীতা শুরু হয়। এর আগে অল ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়নশিপে জেন্টলম্যানস ডাবল, লেডিস ডাবল, মিক্সড ডাবল থাকলেও সিঙ্গেল গেম ছিলো না। ১৯০৪ সালে একটি ইংল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচ আয়োজিত হয় যা ছিলো আন্তর্জাতিক ভাবে আয়োজিত প্রথম প্রতিযোগিতা।
আন্তর্জাতিক ভাবে খেলাটির নিয়ন্ত্রণ এর জন্য কমিটি গঠন করা হয় ১৯৩৪ সালে। যার প্রাথমিক নাম ছিলো ” ইন্টারন্যাশনাল ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন (আইবিএফ) “। এর গঠনকালীন সদস্যসংখ্যা ছিলো নয়টি। দেশগুলো হলো কানাডা, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং ওয়েলস৷ ১৯৮১ সালে IBF একীভূত হয় ওয়ার্ল্ড ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন (BWF) এর সাথে। ২০০৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর স্পেনের মাদ্রিদে একটি বৈঠকে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ” ব্যাডমিন্টন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন (বিডাব্লিউএফ) “। বর্তমানেও এই নামটিই ব্যবহৃত হচ্ছে । এই সংস্থাটিই বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাডমিন্টনের সকল প্রতিযোগীতা ও নিয়মাবলী প্রনয়ণ এবং অন্যান্য বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এছাড়াও পাঁচটি আঞ্চলিক ব্যাডমিন্টন নিয়ন্ত্রণ সংস্থাও রয়েছে, যারা ব্যাডমিন্টন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন এর সাথে যুক্ত। এগুলো হচ্ছে :
- ব্যাডমিন্টন এশিয়া কনফেডারেশন ( BAC )
- ব্যাডমিন্টন কনফেডারেশন অফ আফ্রিকা ( BCA )
- ব্যাডমিন্টন প্যান আম ( দক্ষিণ আমেরিকা ও উত্তর আমেরিকা দুই মহাদেশের ব্যাডমিন্টন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে থাকে )
- ব্যাডমিন্টন ইউরোপ ( BE )
- ব্যাডমিন্টন ওশেনিয়া ( BO )
ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগীতা সমূহ
১৯৪৮ সালে তৎকালীন IBF বা ইন্টারন্যাশনাল ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন প্রথমবারের মতো একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে যার নাম ছিলো “থমাস কাপ“। এটি ছিলো পুরুষদের জন্য ব্যাডমিন্টনের বিশ্বকাপ এর মতো একটি ইভেন্ট। সেই থেকে শুরু করে এখন অবধি বেশ কয়েকটি নতুন অভিজাত ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময় পরপর তা নিয়মিত আয়োজিত হয়ে আসছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ
- থমাস কাপঃ পুরুষদের ব্যাডমিন্টন বিশ্বকাপ। শুরুতে এটি প্রতি তিনবছর পরপর আয়োজন করা হলেও ১৯৮২ এর পর থেকে এটি প্রতি ২ বছর পরপর আয়োজিত হয়ে আসছে। এতে মোট ১৬ টি টিম অংশগ্রহন করে থাকে। এতে সর্বোচ্চবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ইন্দোনেশিয়ান খেলোয়াড়রা, মোট ১৩ বার এই কাপ জিতেছেন তারা।
- উবার কাপঃ এটিকে মহিলা ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়দের বিশ্বকাপ বলা যেতে পারে। থমাস কাপ আয়োজনের পর নারী ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়দের জন্যও একটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজন করার প্রয়োজন হলে এই কাপের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৫৬-৫৭ সালে এটি প্রথম আয়োজিত হয়। বর্তমানে এতে সারাবিশ্ব থেকে ৫০টির বেশি দেশ অংশগ্রহন করে ও ফাইনাল টুর্নামেন্টে খেলে।
- BWF ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপঃ ১৯৭৭ সালে এটি প্রথমবারের মতো আয়োজিত হয়। সারাবিশ্ব থেকে ৬৪ জন খেলোয়াড় ( প্রত্যেক দেশ থেকে সর্বোচ্চ চারজন ) এই চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহন করে থাকে। এটি BWF স্বীকৃত ও আয়োজিত একটি লেভেল ওয়ান টুর্নামেন্ট।
- সুদিরমান কাপঃ এটি একটি মিক্সড ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপ যাতে নারী ও পুরুষ উভয় খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করে থাকে। প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর এই প্রতিযোগীতা আয়োজন করা হয়ে থাকে। ১২ টি টিম এর চূড়ান্ত পর্ব খেলে থাকে। এটি প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয়েছিলো ১৯৮৯ সালে।
- ওয়ার্ল্ড গ্রান্ড প্রিক্স ফাইনালঃ বছরশেষে সারাবিশ্বের সেরা আটজন ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার কে নিয়ে এই প্রতিযোগীটি আয়োজিত হয়। ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়দের জন্য এই প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহন বেশ সম্মানজনক একটি বিষয়।
অলিম্পিকে ব্যাডমিন্টন
সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিকে সর্বপ্রথম ব্যাডমিন্টন খেলাটিকে প্রদশর্নীর জন্য খেলা হয়েছিলো। ১৯৮৫ সালের জুন মাসে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ব্যাডমিন্টন খেলার গুরুত্ব ও এর জনপ্রিয়তা বুঝতে পারে। অতঃপর ব্যাডমিন্টন অলিম্পিকে একটি ফুল মেডেল ইভেন্ট হিসেবে যুক্ত হওয়া উচিত এই মর্মে ভোট প্রদান করে। তখন IBF এর সদস্যসংখ্যা ছিলো ১২৯ টি। নিঃসন্দেহে তাই এত বিস্তৃত ও জনপ্রিয় এ খেলাটি অলিম্পিকের ফুল মেডেল ইভেন্ট হওয়ার দাবীদার ছিলো। ১৮৮৮ সালের সিউল অলিম্পিকে এটি একটি এক্সিবিশন স্পোর্ট হিসেবে খেলা হলেও এটি সর্বপ্রথম অফিশিয়ালি ফুল মেডেল ইভেন্ট হিসেবে অলিম্পিকে ব্যাডমিন্টন খেলাটি জায়গা করে নেয় ১৯৯২ সালে এবং বর্তমানে এটি অলিম্পিকের অন্যতম জনপ্রিয় ইভেন্টগুলোর একটি৷ ব্যাডমিন্টন খেলাটির জনপ্রিয়তার ধারনা পাওয়া যায় এর প্রথম অলিম্পিক আসরেই। কারণ আটদিন ধরে চলা অলিম্পিকের এই ব্যাডমিন্টন ইভেন্টটি সারাবিশ্বের প্রায় ১.১ বিলিয়ন তথা ১১০ কোটি মানুষ টেলিভিশন পর্দায় দেখেছিলো। ১৯৯২ সালে শুধুমাত্র সিঙ্গেলস ও ডাবলস কেই যোগ করা হয়েছিলো।
১৯৯৬ সালের আটলান্টা অলিম্পিক গেমস এ মিক্সড ডাবলসকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে অলিম্পিকের একমাত্র খেলা ব্যাডমিন্টন, যেখানে মিক্সড ডাবল খেলা হচ্ছে অর্থাৎ নারী ও পুরুষ একই টিমের অধীনে হয়ে খেলছে। যদিও আধুনিক ব্যাডমিন্টনের যাত্রা শুরু হয়েছিলো ইউরোপে কিন্তু ইউরোপ আমেরিকাদের তুলনায় বর্তমানে এশিয়ানরাই এই খেলায় অধিক পারদর্শীতা দেখাচ্ছে আন্তর্জাতিক সকল ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগীতায়। ইন্দোনেশিয়া,চীন, মালয়েশিয়া এরা বর্তমানে ব্যাডমিন্টন জগতে রাজত্ব করছে ও ইউরোপীয় দেশগুলোকে হারিয়ে মেডেল নিয়ে যাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া যে আগে কখনো অলিম্পিকে সোনা জিতেনি, ব্যাডমিন্টনের কল্যাণেই প্রথমবারের মতো মেনস সিঙ্গেলস ও ওয়েমনস সিঙ্গেলস এ ইন্দোনেশিয়া অলিম্পিক স্বর্নপদক জয় করে। মালয়েশিয়াও প্রথমবারের মতো অলিম্পিকে পদক লাভ করে ব্যাডমিন্টনের কল্যাণেই, তারা মেনস ডাবল ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছিলো৷
১৯৯২ সাল থেকে ২০২০, এই ২৮ বছরের মধ্যে এখন অব্ধি ব্যাডমিন্টনে স্বর্নপদক জিতেছে মোট ৬ টি দেশ। এগুলো হলো যথাক্রমে ইন্দোনেশিয়া, ডেনমার্ক, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও স্পেন। তবে অলিম্পিকে ব্যাডমিন্টন ইভেন্টে সবচেয়ে সফল হচ্ছে চীন। যারা ২০২০ সাল অবধি ব্যাডমিন্টন খেলা থেকে ৪১ টি স্বর্ণপদক জিতে নিয়েছে। এরপরেই এই তালিকাতে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও সাউথ কোরিয়া। মজার বিষয় হচ্ছে এই খেলার জন্ম যেই দেশ থেকে তথা ইংল্যান্ড, তারা কোন স্বর্ণপদক এতদিনেও পায়নি। ব্যাডমিন্টনের নিয়ম প্রথম যেই দেশে শুরু হয়েছিলো অর্থাৎ ভারতও এখন অবধি কোন স্বর্ণপদক পায়নি। তবে ভারত ২০১২ সালের অলিম্পিকে একটি ব্রোঞ্জ ও ২০১৬ সালের অলিম্পিকে একটি সিলভার পদক পেয়েছে।
বাংলাদেশে ব্যাডমিন্টন
বাংলাদেশীদের নিকট ব্রিটিশ আমলেই ব্যাডমিন্টন খেলা পরিচিত হয়ে উঠলেও তা কেবলমাত্র শহর অঞ্চলের অভিজাত শ্রেনীর মানুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। তারা বিনোদনের উদ্দেশ্যে লন বা পার্কে এই খেলা খেলে থাকতো। তবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ এই খেলাটির জন্য একটি জাতীয় সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ও ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন তথা BBF গঠিত হয়। শুধু শহরাঞ্চলে নয় বরং সারাদেশেই বর্তমানে ব্যাডমিন্টন বেশ পরিচিত ও জনপ্রিয় একটি খেলা।
বাংলাদেশ ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন থেকে খেলোয়াড়রা এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, এশিয়ান স্যাটেলাইট চ্যাম্পিয়নশিপ, সার্ক চ্যাম্পিয়নশিপ এ অংশগ্রহণ করে থাকে। এছাড়াও এই সংস্থা কর্তৃক দেশের অভ্যন্তরে আয়োজন করা হয় সামার ওপেন টুর্নামেন্ট, ফার্স্ট ডিভিশন লীগ, ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ, সেকেন্ড ডিভিশন লীগ সহ আরো কয়েকটি প্রতিযোগীতা। যাতে ব্যাডমিন্টন খেলাতে সবাই আরো বেশি আগ্রহী হয় এবং খেলোয়াড়দের ও ক্রমান্বয়ে উন্নতি করে উঠতে পারে। ব্যাডমিন্টন খেলাতে আন্তজার্তিকভাবে এখন অবধি খুব উল্লেখযোগ্য তেমন কোন অর্জন নেই বাংলাদেশের।
ব্যাডমিন্টন মিউজিয়াম
যদি ব্যাডমিন্টন খেলার ইতিহাস নিয়ে আরো বেশি বিস্তারিত ও চাক্ষুষ প্রমাণসহ জানতে ইচ্ছা হয় তবে সেক্ষেত্রে যেতে হবে ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল ব্যাডমিন্টন সেন্টার এ অবস্থিত ব্যাডমিন্টন মিউজিয়াম এ। এ মিউজিয়ামে রয়েছে কিভাবে কিভাবে এই খেলা তৈরি হলো ও সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেলো তার বিস্তারিত ইতিহাস। পাশাপাশি আছে ব্যাডমিন্টন এর বিবর্তন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়াদি।
বর্তমান কালের যেই ধরনের র্যাকেট, যেই ধরনের শাটলকক, যেই ধরনের পোশাক পরে ব্যাডমিন্টন খেলা হয় তা শুরুর দিকের ব্যাডমিন্টনের চেয়ে অনেক ভিন্ন। ধীরে ধীরে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আজকের এই অবস্থানে এসেছে ব্যাডমিন্টন। এবং এই পরিবর্তনের ধাপ গুলোকে খুব সুন্দরভাবেই সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে এই জাদুঘরে। এতে পুরাতন যুগের ব্যাটলডোর এন্ড শাটলকক, আগের যুগে কিরকম র্যাকেট ব্যবহার করা হতো এ সবকিছুর অনেক নিদর্শন সংরক্ষিত আছে, যা দর্শনার্থী ও ব্যাডমিন্টন প্রেমিকদের মুগ্ধ করে।
শেষকথা
প্রাচীন যুগ থেকেই ব্যাডমিন্টনের বিভিন্ন রুপ মানুষের মনে আনন্দ দিয়ে আসছে৷ অভিজাত ও সুন্দর এ খেলাটি বাংলাদেশের শীতের আমেজের সাথে বর্তমানে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। তবে শহরে আর আগের মতো উঠান বা ফাঁকা খেলার মাঠ না থাকায় ব্যাডমিন্টন খেলা আগের মত আয়োজন করা শহরাঞ্চলে বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে। তবুও এটি সকলের ভালোবাসার একটি খেলা। আশা করি এটি ভবিষ্যতে আরো সারাবিশ্বে ফুটবল, ক্রিকেটের সমপর্যায়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে এবং বিশেষত বাংলাদেশী খেলোয়াড়রা এই খেলাতে আন্তজার্তিকভাবে নানান পদক অর্জনের মাধ্যমে দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনবে। সেদিনেরই প্রত্যাশায়।
তথ্যসূত্র
১) Olympics.com
২) Nationalbadmintonmuseum.co.uk