বাংলাদেশ বিশ্বক্রিকেটে এমন একটি নাম যার উজ্জ্বলতা ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ ১৯৭৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে খেলার সুযোগ পায় কিন্তু এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি বাংলাদেশ। সেই বার বাংলাদেশ বাছাই পর্বের গন্ডিও অতিক্রম করতে পারেনি। দীর্ঘ ১৯ বছর অপেক্ষার পর ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জিতে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। পূরণ হয় বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন। এখানেই বংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলার অপেক্ষার অবসান ঘটে। এরপরের সবকটি বিশ্বকাপ আসরেই অংশগ্রহণ করেছে বাংলাদেশ।
তবে চলুন জেনে নেয়া যাক বিশ্বক্রিকেটে বাংলাদেশের কিছু অর্জন সম্পর্কে।
সূচিপত্রঃ
১। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি অর্জন
১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ প্রথম আইসিসি ট্রফি খেলার সুযোগ পায় কিন্তু সে আসরে সে রকম কোন ভালো ফলাফল করতে পারেনি বাংলাদেশ। সময়ের সাথে বদলে যেতে থাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের হাল-চাল। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আইসিসি ট্রফি জিতে শুভ সূচনা করে। সে আসরে বাংলাদেশসহ ১২টি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল। ওই আসরে বাংলাদেশ ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে দুর্দান্ত এক জয় এনেছিলো। তখন সে জয়ের আনন্দ দেশবাসীর কাছে বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দের মতোই ছিলো, কেন না সেই জয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করার যোগ্যতা অর্জন করে।
২। ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশগ্রহন
বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ বাংলাদেশের কাছে যেন স্বপ্নের মতোই ছিলো। কিন্তু এ স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয় ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের মাধ্যমে। বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জিতে ১৯৯৯ বিশ্বকাপের মূলপর্ব নিশ্চিত করেছিলো। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে অধীনায়ক করে বাংলাদেশ দল সাজানো হয়। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ শুধুমাএ স্কটল্যান্ডকে হারানোর লক্ষ্যে গেলেও বাংলাদেশ স্কটল্যান্ডের পাশাপাশি হারিয়ে দেয় সে সময়ের শক্তিশালী সাবেক ১৯৯২ এর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানকেও। বাংলাদেশ চমকে দেয় বিশ্ববাসীকে। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ ছড়িয়ে দেয় তাদের আগমনী বার্তা। সে আসরে বাংলাদেশ পাঁচটি ম্যাচ খেলে দুটিতে জয় লাভ করে। বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ খেলা হিসেবে এ অর্জন কম কিছু ছিলোনা। বাংলাদেশ ক্রিকেটের নতুন পথ চলা শুরু হয় ১৯৯৯ সাল থেকেই।
৩। ২০০০ সালে বিশ্বে দশম দেশ হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদা লাভ
২০০০ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদা লাভ করে। ৯টি টেস্ট খেলুড়ে দেশের ভোটের মাধ্যমে বিশ্বক্রিকেটে দশম দেশ হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদা পায় বাংলাদেশ। তবে এর পেছনে তৎকালীন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীর ভূমিকা রয়েছে। তাঁর দায়িত্বে বসার পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ টেস্টের মর্যাদা লাভ করে। এটিই তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিলো। বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা লাভের ক্ষেত্রে ক্রিকেটারদের ভূমিকাও ছিলো অপরিসীম। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ শক্তিশালী পাকিস্তান এবং স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জয়লাভ করে যা টেস্ট মর্যাদা লাভে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আইসিসি সভার ভোটে জয় নিশ্চিত করার জন্য তৎকালীন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি জগমোহন ডালমিয়ার কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। জগমোহন ডালমিয়া বাংলাদেশের সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীকে এশিয়ার মধ্যে ভারত, শ্রীলংকা এবং পাকিস্তানের ভোটের ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন।
৪। ২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ আসরে সুপার আটে স্থান দখল
১৯৯৯ সালের পর থেকেই বাংলাদেশ বিশ্বক্রিকেটে উন্নতি করতে শুরু করে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পা রাখার পর তখনও শিশু বয়সই অতিক্রম করেনি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পা রেখেছে, তখন সবে মাত্র আট বছর। কিন্তু আট বছরে সেই শিশু বাংলাদেশ ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং বার্মুডাকে হারিয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। সে আসরে নয় ম্যাচে তিন জয় নিয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ আসরে সুপার আট নিশ্চিত করে। ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো শক্তিশালী দলকে হারানো সে সময়ে বাংলাদেশের কাছে কোনো সহজ কাজ ছিলোনা। কিন্তু সে কঠিন কাজ সহজ করে ফেলেছিলো বাংলাদেশ এবং অনেক গৌরব অর্জন করেছিলো।
৫। ২০১২ এবং ২০১৮ সালে এশিয়া কাপ ফাইনাল খেলা
বাংলাদেশ ১৯৮৮ সালে প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপে অংশগ্রহণ করে। সেটি ছিলো এশিয়া কাপের তৃতীয় আসর। সে আসরে অংশগ্রহণ করাই ছিলো বাংলাদেশের কাছে বড় অর্জন। সে আসরে বাংলাদেশ দুটি ম্যাচ খেলে দুটিতেই পরাজিত হয়। ১৯৮৮ সালে এবং এর পরের সবগুলো আসরেই অংশগ্রহণ করেছে বাংলাদেশ এর মধ্যে কয়েকটি আসরের আয়োজকও ছিলো বাংলাদেশ। এশিয়া কাপে পা রাখার দীর্ঘ তের বছর পর বাংলাদেশের প্রথম অর্জন আসে ২০১২ সালে। প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপ আসরে ফাইনাল খেলেছিলো বাংলাদেশ। সে আসরে দুর্দান্ত খেলেছিলো বাংলাদেশ। ওই আসরে বাংলাদেশ, ভারত এবং শ্রীলংকাকে বড় ব্যবধানে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ফাইনালে জয়ের অনেক কাছে গিয়েও মাত্র ২ রানে হেরে এশিয়া কাপ জয়ের স্বপ্ন ভঙ্গ হয় বাংলাদেশের। রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় বাংলাদেশকে। সে আসরে বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের কাছে যা গৌরবেরই। বাংলাদেশ আবার ২০১৮ সালে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর এশিয়া কাপে স্বপ্নের ফাইনালে ওঠে। এবার হয়তো হতাশ হতে হবে না, এমনটাই আশা করেছিলো দেশবাসী। কারণ ২০১২ সালের বাংলাদেশের তুলনায় ২০১৮ সালের বাংলাদেশ যে অনেক শক্তিশালী। কিন্তু আবার স্বপ্ন ভঙ্গ হয় বাংলাদেশের এবং এবার প্রতিপক্ষ ভারত। আবারও বাংলাদেশকে রানার্সআপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
৬। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা
বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপ খেলেছিলো। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৬ বছরের মধ্যে অনেক গৌরবও অর্জন করে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশের বিশ্বক্রিকেটে সবচেয়ে বড় অর্জন আসে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে। সে বার বিশ্বকাপ আসরের আয়োজক ছিলো অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশ মোটামুটি শক্তিশালী দল নিয়ে ২০১৫ বিশ্বকাপ খেলতে যায়। সে আসরে বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা যাকে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অধিনায়ক বলা হয়। সে আসরের শুরটা অনেক ভালো হয় বাংলাদেশের। বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১০৫ রানের বড় ব্যবধানে জয়লাভ করে যা বাংলাদেশকে অনেক আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশ শক্তিশালী ইংল্যান্ডকে ১৫ রানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো স্বপ্নের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে। বাংলাদেশ এবং ইংল্যান্ডের মধ্যেকার ম্যাচটি ছিল শ্বাসরুদ্ধকর। সেই দিনটি দেশবাসীর কাছে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেমিফাইনালে ওঠার লড়ায়ে শক্তিশালী ভারতের মুখোমুখি হয়। কিন্তু সেবারও জয় অধরাই থেকে যায় বাংলাদেশের কাছে। ভারতের কাছে বড় ব্যবধানে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয় বাংলাদেশকে।
৭। ২০১৯ সালে প্রথম কোন টুর্নামেন্টের ফাইনালে জয় লাভ
ফাইনাল জেতা বাংলাদেশের কাছে যেন ছিলো এক সোনার হরিণ। ১৯৯৯ সালের পর থেকে বাংলাদেশ অনেক ছোট বড় টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলেছে, কিন্তু কোন টুর্নামেন্টের ফাইনালেই জয়ের দেখা পাচ্ছিলো না বাংলাদেশ। সবগুলো টুর্নামেন্টেই হতাশ হতে হয়েছিলো বাংলাদেশকে। অবশেষে, ২০১৯ সালে সাফল্য ধরা দেয় বাংলাদেশের কাছে। বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো কোন টুর্নামেন্টে
জয়লাভ করে, বাংলাদেশ ক্রিকেটকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বাংলাদেশ এবং আয়ারল্যান্ডকে নিয়ে আয়ারল্যান্ডে সেই ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়েছিলো। সে টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। সে টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ ফাইনালে শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পাঁচ উইকেটে জয়লাভ করে। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ মোট পাঁচটি ম্যাচ খেলেছিলো যার মধ্যে চারটিতেই জয় পেয়েছিলো বাংলাদেশ এবং বৃষ্টির কারণে একটি ম্যাচ ড্র হয়েছিলো।
শেষ কথা
বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বক্রিকেটে একটি শক্তিশালী দল। বর্তমানে বাংলাদেশ যেকোনো দলকে হারানোর ক্ষমতা রাখে, এর প্রমাণও আমরা পেয়েছি। বাংলাদেশ আর কোন দলের কাছে হাসি-খেলার পাএ নয়। তাই আমরা আশা করতে পারি ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আরো অনেক বড় বড় অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বক্রিকেটে নিজের অবস্থান আরো উন্নত করবে এবং দেশের সুনাম বৃদ্ধি করবে।