চাকরিসরকারি চাকরি

সরকারি চাকরি ছাড়ার নিয়ম ও আইন

বাংলাদেশের বিশাল সংখ্যক চাকরিপ্রার্থীদের কাছে সরকারি চাকরি এক আরাধ্য বিষয়। তা সেটি ক্যাডার অথবা নন-ক্যাডার চাকরি, যেটাই হোক না কেন। কিন্তু অনেক সরকারি চাকরিজীবীই ব্যক্তিগত কারণে অথবা আরো ভাল সুযোগের বদৌলতে সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। তবে সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে সকল চাকরি ছাড়ার ক্ষেত্রেই কিছু বিধি-বিধান ও শিষ্টাচার মেনে চলতে হয়। সে সকল বিধি-বিধান আর শিষ্টাচার নিয়েই আলোচনা করা হলো আজকের লেখাটিতে। 

অবসর গ্রহণ ও চাকরিতে ইস্তফা এর মধ্যে পার্থক্য

সরকারি চাকরি ছাড়ার ক্ষেত্রে অনেকেই দুটি বিষয়কে গুলিয়ে ফেলেন। সেই দুইটি হলো সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ ও চাকরিতে ইস্তফা। সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে সকল চাকরির ক্ষেত্রেই এই দুটি পন্থা প্রযোজ্য। আসুন এ দুটির পার্থক্য সম্পর্কে জানা যাক।

অবসর গ্রহণ হলো সেই প্রক্রিয়া যেখানে একজন চাকরিজীবী নির্দিষ্ট সময় চাকরি করার পর স্বাভাবিক নিয়মে চাকরি শেষ করেন। উল্লেখ্য যে, সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর সকল চাকরিজীবীই অবসর সুবিধা পান। অপর দিকে চাকরিতে ইস্তফা দেওয়া কোনো ধরা-বাঁধা সময় নেই। একজন চাকরিজীবী যেকোনো সময় ইস্তফা দিতে পারেন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের আগে চাকরিতে ইস্তফা দিলে তিনি অবসর সুবিধাগুলো নাও পেতে পারেন। 

নিচে একজন সরকারি চাকরিজীবীকে অবসর গ্রহণ বা চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার ক্ষেত্রে যে সকল নিয়মাবলী অনুসরণ করতে হয় তা বিস্তারিত উল্লেখ করা হলো।

সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ

সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ একটি স্বাভাবিক ও আবশ্যক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াটি বেশ কয়েকটি উপায়ে সম্পাদিত হয়ে থাকে। সেগুলো হলোঃ

  • বয়সজনিত অবসর
  • ঐচ্ছিক অবসর
  • বাধ্যতামূলক অবসর
  • অক্ষমতাজনিত অবসর

বয়সজনিত অবসর

সরকারি চাকরি ছাড়ার সবচেয়ে স্বাভাবিক নিয়ম হলো বয়সজনিত অবসর। একজন সরকারি চাকরিজীবী সর্বোচ্চ ৫৯ বছর পর্যন্ত সরকারি চাকরি করতে পারেন। অবশ্য তিনি মুক্তিযোদ্ধা হলে এই বয়সসীমা ৬০ বছর৷ চাকরিজীবী মুক্তিযোদ্ধা কি না এটি যাচাই এর দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের৷ তবে ওই ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই সরকারি চাকরিতে যোগদান করলে আর যাচাই এর প্রয়োজন হয় না।

ঐচ্ছিক অবসর

সরকারি চাকরির মেয়াদ অন্তত ২৫ বছর হলে একজন সরকারি চাকরিজীবী ঐচ্ছিক অবসর গ্রহণ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে চাকরি ছাড়ার নূন্যতম ৩০ দিন আগে এ ব্যাপারে দরখাস্ত দাখিল করতে হবে। উল্লেখ্য যে, একবার চাকরি ছাড়ার দরখাস্ত দিলে তা অপরিবর্তনীয় হিসেবে গণ্য হবে৷ 

বাধ্যতামূলক অবসর

বাধ্যতামূলক অবসরের অপর নাম সরকার কর্তৃক অবসর প্রদান। মূলত সরকার যদি কোনো সরকারি চাকরিজীবির চাকরিকে জনস্বার্থের বিপরীতে মনে করে তাহলে ঐ চাকরিজীবিকে কোনো কারণ না দর্শিয়েই অবসরে প্রেরণ করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট চাকরিজীবীর চাকরির বয়স নূন্যতম ২৫ হতে হবে। এছাড়াও ঐ চাকরিজীবী যদি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন, তাহলে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। 

অক্ষমতাজনিত অবসর

কোনো সরকারি চাকরিজীবী শারীরিক বা মানসিক ভাবে অক্ষম হয়ে পড়লে তিনি অক্ষমতাজনিত অবসরের জন্য আবেদন করতে পারেন। এক্ষেত্রে তার শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা নির্ণয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হবে৷ যদি মেডিকেল বোর্ড তাকে শারীরিক বা মানসিক ভাবে স্থায়ী অক্ষম ঘোষণা করে তবে কর্তৃপক্ষ তাকে অবসর প্রদান করতে পারবে৷ বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে, কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি শারীরিক বা মানসিক অক্ষমতার শিকার হন, তাহলে তাকে সরকার কর্তৃক আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও বিশেষ সুবিধা প্রদানের বিধান রয়েছে। 

চাকরি থেকে ইস্তফা

যেকোনো সরকারি চাকরিজীবী যেকোনো সময়েই চাকরিতে ইস্তফার আবেদন করতে পারেন। এক্ষেত্রে সরকারের শর্ত সাপেক্ষে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ইস্তফার ব্যাপারে নিষ্পত্তি করবেন। 

সরকারি চাকরির অবসর সুবিধা

সরকারি চাকরির অবসর সুবিধা সরকারি চাকরি ছাড়ার নিয়মের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিলেই প্রত্যেক চাকরিজীবীই অবসর সুবিধা পাওয়ার আবেদন করতে পারেন৷ তবে আবেদনের পরে তার অবসর সুবিধা পাওয়ার প্রাপ্যতা সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করা হয়৷ যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যাতীত পর্যাপ্ত সময়ের মধ্যে অবসর সুবিধার জন্য আবেদন ও তা নিষ্পত্তি না করলে, সেটা চাকরিজীবীর দায়িত্বে অবহেলা হিসবে গণ্য হবে৷ এছাড়াও সরকারি চাকরি থেকে কেউ অবসর নিলে বা তার অবসর হলে তিনি নিয়ম অনুসারে অবসর-উত্তর ছুটি ভোগ করতে পারেন। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১ বছর তিনি এ সুবিধা পেতে পারেন।

অবসর সুবিধা স্থগিত/বাতিল

অবসর সুবিধা স্থগিত অথবা বাতিল করারও বিধান রয়েছে। কোনো অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি আর্থিক বিষয়ে বিভাগীয় বিচার চলতে থাকে, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার অবসর সুবিধা স্থগিত করা হবে। তবে এক্ষেত্রে তিনি ভবিষ্য তহবিলের অর্থ এবং সুদ গ্রহণ করতে পারবেন। অপরদিকে কোনো সরকারি চাকরিজীবিকে যদি বরখাস্ত বা অপসারণ করা হয় তাহলে তিনি ভবিষ্য তহবিলের অর্থ ও সুদ ব্যাতীত আর কোনো সুবিধাই পাবেন না। তবে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন বোধ করলে অনুকম্পাস্বরুপ কিছু সহযোগিতা করতে পারে৷ 

সরকারি চাকরিতে পুর্নবহাল 

সরকারি চাকরি ছাড়ার নিয়ম অনুযায়ী একজন সরকারি চাকরিজীবী একবার চাকরি ছেড়ে দিলে তাকে প্রজাতন্ত্রের আর কোনো চাকরিতে পুর্নবহাল করা যাবে না। তবে এক্ষেত্রে দুটি ব্যতিক্রম আছে। 

  • প্রথমতঃ জনস্বার্থে রাষ্ট্রপতি কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিকে চাকরি ছাড়ার পরেও চুক্তিভিত্তিক পুনরায় নিয়োগ দিতে পারেন। তখন যদি ঐ কর্মকর্তা বা কর্মচারী অবসর-উত্তর ছুটিতে থাকেন, তাহলে ঐ ছুটি স্থগিত থাকবে
  • দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশের ১২টি সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগের ব্যাপারে কোনো বিধি-নিষেধ নেই। 

চাকরি ছাড়ার শিষ্টাচার

চাকরি গ্রহণের সময় একজন চাকরিজীবী যেমন শিষ্টাচার দেখিয়ে থাকেন, ঠিক তেমনই দেখানো উচিত চাকরি ছাড়ার সময়েও। প্রথম আলোর সূত্র অনুসারে, চাকরি ছাড়ার সময় ৬০% চাকরিজীবীই কিছু না কিছু অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। এমনটি করা একদমই উচিত নয়। বরং কর্মস্থল ত্যাগের আগে সকলের সাথেই সম্পর্ককে ভাল অবস্থান নিয়ে যাওয়া উচিত।

  • চাকরিতে ইস্তফা দিতে হলে অবশ্যই অন্তত ৩০ দিন পূর্বে আবেদন করুন। আবেদনটিতে আপনার চাকরি ছাড়ার একটি যৌক্তিক কারণ উপস্থাপন করুন। নিজের অবস্থান তুলে ধরুন।
  • আপনার নামে অফিস থেকে বরাদ্দ হওয়া যেকোনো ল্যাপটপ, ক্যামেরা, গাড়ি বা অন্যান্য জিনিস যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দিন। 
  • কম্পিউটার থেকে আপনার ব্যক্তিগত সমস্ত তথ্য মুছে ফেলুন৷ প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বুঝিয়ে দিন।
  • অফিসে ব্যবহৃত সকল ব্যক্তিগত জিনিস, যেমন কলমদানি, ছবির ফ্রেম, বই, মগ ইত্যাদি সরিয়ে ফেলুন।
  • অফিসের কোনো কাগজপত্র বা ডিজিটাল ডকুমেন্ট নিয়ে আসবেন না। অপরদিকে নিজের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট রেখে আসবেন না।
  • চাকরির ছাড়ার সময় অবশ্যই আপনার অভিজ্ঞতার সনদপত্র এবং ছাড়পত্র সংগ্রহ করুন। এগুলো আপনার পরবর্তী চাকরিতে বিশেষ কাজে দেবে৷
  • কর্মস্থল ত্যাগ করার আগে সকল কর্মকর্তা কর্মচারীকে সম্ভাষণ বা ধন্যবাদ জানিয়ে আসুন।

শেষকথা

চাকরি সরকারি হোক কিংবা বেসরকারি, সকলেরই উচিত চাকরির ছাড়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে চলা। এর ফলে যেমন নিজের অবসর সুবিধা পেতেও অসুবিধা হয় না, ঠিক তেমনি প্রাক্তন সহকর্মীদের সাথে সুন্দর সম্পর্ক বজায় থাকে। তাই সকলেরই উচিত, চাকরি ছাড়ার সিধান্তের আগে খুব ভাল ভাবে ভাবা, এরপর সিধান্তটি নেওয়া।

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button