খাবারলাইফ স্টাইলস্বাস্থ্য

মেথির উপকারিতা, ব্যবহার এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

মেথি হল একটি ভেজষ ঔষধি যা দীর্ঘকালীন ধরে ঔষুধের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি দৈনন্দিন খাবারের একটি সাধারণ উপাদান এবং প্রায়শই পরিপূরক হিসাবে গ্রহণ করা হয়। মেথির অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। আমাদের আজকের এই প্রবন্ধে আপনারা মেথি উপকারিতা সহ প্রয়োজনীয় সকল তথ্য জানতে পারবেন।

মেথি কি?

মেথি

মেথি (ট্রাইগোনেলা ফেনিয়াম-গ্রিকাম) এমন একটি উদ্ভিদ যা প্রায় ২-৩ ফুট (৬০-৯০ সেমি) লম্বা হয়। এটিতে সবুজ পাতা, ছোট সাদা ফুল এবং ছোট ছোট সোনালী-বাদামী বীজযুক্ত শাঁস রয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে মেথি ঔষুধের বিকল্পস্বরুপ এবং চীনা ঔষুধে ত্বকের অবস্থা এবং অন্যান্য অনেক রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার হয়ে আসছে। বর্তমানে এটি সাধারণ পরিবারের মশলা এবং বিভিন্ন কাজের সঙ্গী হয়ে উঠছে। তাছাড়া এখন মেথি সাবান এবং শ্যাম্পুর মতো পণ্য তৈরিতেও ব্যাবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়া অনেকে তাদের খাবারে পুষ্টি বাড়াতে এবং সামান্য মাত্রায় মিষ্টি ও বাদামের স্বাদ পাওয়ার ক্ষেত্রেও মেথির বীজ ও গুঁড়ো ব্যবহার করে।

মেথির পুষ্টি উপাদান

পুরো মেথি বীজের এক চামচ (১১.১ গ্রাম) এ ৩৫ ক্যালরি সহ বেশ কয়েকটি পুষ্টি থাকে। যেমনঃ

  • ফাইবারঃ ৩ গ্রাম
  • প্রোটিনঃ ৩ গ্রাম
  • কার্বসঃ ৬ গ্রাম
  • ফ্যাটঃ ১ গ্রাম
  • আয়রনঃ দৈনিক মানের  ভিত্তিতে ৭ শতাংশ
  • ম্যাঙ্গানিজঃ দৈনিক মানের ভিত্তিতে ৭ শতাংশ
  • ম্যাগনেসিয়ামঃ দৈনিক মানের ভিত্তিতে ৫ শতাংশ

গর্ভবতী মায়ের বুকের দুধ উৎপাদনে মেথি উপকারি

শিশুর বিকাশ লাভের জন্য বুকের দুধই পুষ্টির সেরা উৎস। তবে কিছু মায়েরা পর্যাপ্ত পরিমাণে দুধ উৎপাদন করতে অনেক লড়াই-সংগ্রাম করে থাকেন। এজন্য অধিকাংশ মায়েরা বুকের দুধের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রেসক্রিপশনের ঔষুধ নিয়ে থাকেন। তবে ঔষুধের বিকল্প হিসেবে মেথি উপকারী। নতুন ৭৭ জন মায়েদের ১৪ দিনের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, মেথি বীজের সাথে ভেষজ চা পান করায় বুকের দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, যা বাচ্চাদের আরও বেশি ওজন বাড়াতে সহায়তা করে। আরেকটি গবেষণায় ৬৬ জন মায়েদেরকে তিনটি দলে ভাগ করা হয় এবং যাদের একজনকে মেথি চা, দ্বিতীয়জনকে প্লেসিবো এবং তৃতীয়জনকে কিছুই দেওয়া হয় নি। পরিক্ষার পর পাম্পকরা স্তনের দুধের পরিমাণ এবং প্লেসিবো গ্রুপের ৩৪ মিলি এবং মেথির  দলে ৭৩ মিলি বেড়ে যায়। এই গবেষণাগুলোতে পরিপূরকের পরিবর্তে মেথির ভেষজ চা ব্যবহার করা হয়েছিল তবে পরিপূরকগুলোর একইরকম প্রভাব থাকতে পারে। যাই হোক এই গবেষণাটি উৎসাহদায়ক, তবে আপনার বুকের দুধের উৎপাদন সম্পর্কে কোনো উদ্বেগ থাকলে ধাত্রী বা চিকিৎসকের কাছ থেকে পরামর্শ নিবেন।

পুরুষদের টেস্টোস্টেরন স্তর বৃদ্ধিতে মেথি উপকারী

পুরুষদের মেথি ব্যবহার করার অন্যতম সাধারণ কারণ হলো টেস্টোস্টেরন বৃদ্ধি করা। মেথির কামশক্তি বাড়ানো সহ অন্যান্য উপকারী প্রভাব রয়েছে। চার সপ্তাহের একটি গবেষণায়, ৩০ বয়সের পুরুষেরা প্রতি সপ্তাহে ৪টি ভারোত্তোলনের সেশন করেছিলেন, তাদের মধ্যে অর্ধেকজন প্রতিদিন ৫০০ মিলিগ্রাম মেথি গ্রহণ করে। যদিও মেথি না নেওয়া গ্রুপটির টেস্টোস্টেরনে কিছুটা হ্রাস পায় তবে মেথি নেওয়া গ্রুপটির টেস্টোস্টেরন বেড়েছে। তাছাড়া এই গ্রুপের শরীরের মেদও ২ শতাংশ কমে যায়। ৬ সপ্তাহের আরেক গবেষণায় ৩০জন পুরুষকে ৬০০ মিলিগ্রাম মেথি নিষ্কাশনের সাথে যৌন ক্রিয়াকলাপ এবং লিবিডো বা কামশক্তি পরিবর্তনের মূল্যায়ন করা হয়। এতে বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারীরা শক্তি বৃদ্ধি এবং যৌন কার্যকারিতা উন্নত বলে জানিয়েছেন। প্রাথমিক গবেষণায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে মেথি পুরুষদের মধ্যে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা এবং কামশক্তিকে বাড়িযে তুলতে পারে।

মেথি ডায়াবেটিস এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মেথি

মেথি বিপাকীয় পরিস্থিতিতে যেমন ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে সহায়তা করে। এছাড়াও লোকেদের মধ্যে সাধারণ কার্ব সহনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি টাইপ-১ এবং টাইপ-২ ডায়বেটিসের উপর প্রভাব ফেলে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ব্যক্তিরা মধ্যাহ্নভোজন এবং রাতের খাবারে ৫০ গ্রাম মেথির গুঁড়া বীজ নেয়।

১০ দিন পরে অংশগ্রহণকারীদের  রক্ত এবং শর্করার পরিমাণ আরও ভাল এবং রক্তে এলডিএল (খারাপ) কোলেস্টেরল হ্রাস পায়। ডায়াবেটিসবিহীন লোকেদের মেথি গ্রহণ করার ৪ ঘণ্টা পরে তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা ১৩.৪ শতাংশ কমে যায়। ইনসুলিনের কার্যকারিতা উন্নত করতে মেথির ভূমিকার কারণে এই সুবিধাগুলো হতে পারে।  এতে বলা হয়েছে, পুরো মেথির গুঁড়ো বা বীজ ব্যবহারে গবেষণায় যে প্রভাবগুলো দেখা গেছে তা আংশিক উচ্চ ফাইবারের কারণে হতে পারে।

মেথির অন্যান্য স্বাস্থ্য উপকারিতা

মেথি বিভিন্ন অবস্থার চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয়। তবে এর মধ্যে অনেকগুলো ব্যবহার শক্তিশালী সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য যথেষ্টভাবে গবেষণা করা হয় নি।

প্রাথমিক গবেষণা থেকে জানা যায় যে মেথি সাহায্য করেঃ  

  • ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণঃ

এখন অব্দি ৩ টি গবেষণা থেকে দেখা যায় মেথি চর্বি গ্রহণ এবং ক্ষুধা হ্রাস করে। এছাড়া  ১৪ দিনের একটি  সমীক্ষায় দেখা গেছে যে অংশগ্রহণকারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মোট ফ্যাট গ্রহণের ১৭ শতাংশ পরিমাণ কমায়।

  • কোলেস্টেরলের মাত্রাঃ 

কিছু প্রমাণের ভিত্ততে দেখা যায় যে মেথি কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা হ্রাস করতে উপকারী।

  • অম্বল বা বুকজ্বালাঃ

ঘন ঘন জ্বালা-পোড়া করা লোকদের মধ্যে ২ সপ্তাহের একটি পরীক্ষামূলক গবেষণায় দেখা গেছে যে মেথি তাদের লক্ষণগুলো হ্রাস করে। আসলে মেথির প্রভাবগুলো অ্যান্টাসিড ওষুধগুলোর সাথে মিলে যায়।

  • প্রদাহ বা জ্বলনঃ 

এই ভেষজ ঔষধি ইঁদুরের উপর অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি প্রভাব প্রদর্শন করে। তবে মানুষের মধ্যে এটি নিশ্চিত করার জন্য আরও গবেষণা করা দরকার। এছাড়াও ঐতিহ্যবাহী মেডিসিন ঔষুধের কিছু পর্যালোচনা এবং উপাখ্যানিত প্রতিবেদন প্রমাণ করে যে মেথি আলসারেটিভ কোলাইটিস, ত্বকের সমস্যা এবং অন্যান্য অনেক পরিস্থিতিতে সহায়তা করতে পারে।

কীভাবে মেথি ব্যবহার করবেন?

মেথির ব্যবহার

মেথি অনেক পরিপূরক উপাদান। প্রস্তুতি বিভিন্নরকম হওয়ার কারণে সুপারিশকৃত ডোজ পরিপূরকের উপর নির্ভর করে। কোনও একক রিকমেন্ডেড ডোজ নেই। তাছাড়া ডোজটি আপনি যে উপকারে নিতে চান তার উপর নির্ভর করে পৃথক হতে পারে। বেশিরভাগ টেস্টোস্টেরন-ভিত্তিক গবেষণায় প্রায় ৫০০ মিলিগ্রাম মেথির নির্যাস ব্যবহার করা হয়, অন্যক্ষেত্রের  গবেষণায় প্রায় ১,০০০-২২,০০০ মিলিগ্রাম ব্যবহার করা হয়। যদি পুরো বীজটি ব্যবহার করা হয় তবে প্রায় ২-৫ গ্রাম ডোজ কার্যকর বলে মনে হয়, তবে এটি গবেষণা থেকে গবেষণার মধ্যে পরিবর্তিত হয়। পরিপূরকগুলো সাধারণত খাবারের আগে বা খাবারের সাথে নেওয়া উচিত। যেহেতু এই ভেষজ রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, তাই আপনার দিনের সবচেয়ে বেশি কার্ব খাবারের সাথে এটি গ্রহণ করা ভাল। সর্বদা ডোজ লেভেলের নির্দেশাবলী অনুসরণ করুন। যদি অনিশ্চিত হন  তবে  স্বাস্থ্যসেবাকারীদের সাথে পরামর্শ করুন।

মেথির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং সুরক্ষা

মেথি স্বাস্থ্যকর মানুষের জন্য তুলনামূলকভাবে নিরাপদ বলে মনে হয়। তবে বেশিরভাগ পরিপূরক হিসেবে, ডায়রিয়া এবং বদহজমের মতো কম মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। অনেক লোকেরা ঠিকমতো খায় না, ক্ষুধা হ্রাস করতে চায় তবে এটি যদি খাওয়ার ব্যাধি হয়ে থাকে বা ওজন বাড়ানোর চেষ্টা করে তবে তা ক্ষতিকারক হতে পারে।

তদুপরি, কিছু লোক পরিপূরক নেওয়ার সময় শরীরের একটি অদ্ভুত এবং খানিকটা  মিষ্টি গন্ধের কথা বলে তবে এটা পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। তাছাড়া রক্তে চিনির পরিমানের উপর মেথির প্রভাব থাকে। আপনি যদি ডায়াবেটিসের ঔষুধ এবং অন্যান্য পরিপূরক গ্রহণ করেন যা রক্তের শর্করার মাত্রা হ্রাস করে তাহলে সতর্কতার সাথে মেথি ব্যবহার করবেন।

প্রাণী সংক্রান্ত এক গবেষনায় বলা হয়েছে যে, খুব উচ্চ মাত্রায়  ডোজ ডিএনএ ক্ষতি, উর্বরতা হ্রাস, স্নায়বিক সমস্যা এবং গর্ভপাতের ঝুঁকি বৃদ্ধি সহ অসংখ্য বিরুপ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। যদিও এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুলোর বেশিরভাগ লোকের মধ্যে নিশ্চিত হওয়া যায়নি এবং ব্যবহৃত ডোজগুলো অস্বাভাবিকভাবে বেশি তাই কিছু বিজ্ঞানী মেথির পরিপূরকের ব্যবহার সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। তাই নতুন পরিপূরক শুরু করার আগে স্বাস্থ্যসেবা পরামর্শকের সাথে আলোচনা করা সর্বদা ভাল ধারণা। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আপনি নিরাপদ ডোজ নিচ্ছেন কিনা সেটা নিশ্চিত করুন। মোটকথা মানুষের মধ্যে মেথির ব্যবহারে  হালকা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যদিও এটি সঠিক মাত্রায় নিলে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ বলে মনে হয়।

শেষ কথা

মেথি হল একটি অনন্য ঔষধি যা দীর্ঘকাল ধরে শারীরিকভাবে সুস্থতা প্রদান করতে ঔষধ এর বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গ্রহণযোগ্য প্রমাণের ভিত্তিতে, মেথি রক্তে শর্করার মাত্রা কমানো, টেস্টোস্টেরন বাড়ানো এবং বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের দুধের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য মেথির উপকারিতার শেষ নেই। তবে মানুষের মধ্যে মেথির ব্যবহারে হালকা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে কিন্তু মেথির সঠিক মাত্রায় ব্যাবহার করলে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না বরং শারীরিক শুস্থতা এনে দেবে।

তথ্যসূত্রঃ Pubmed.gov 

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button