মার্কেটিং

মার্কেটিং কি? মার্কেটিং-এর প্রকারভেদ এবং প্রয়োজনীয়তা

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ তার নিজের চাহিদা মেটানোর জন্য ছিল সচেষ্ট। পশু-পাখি শিকার, মৎস্য শিকার, কৃষিকাজ করলেও পণ্য বিনিময়, উৎপাদনসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও নিয়োজিত ছিল। তবে এসবের মূলে ছিল অভাববোধ। এই অভাববোধ থেকেই বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও অর্থের ধারনা আসে। সামগ্রিক এসব বিষয়কে ঘিরেই ব্যবসার উৎপত্তি। আর ব্যবসায়ের একটা বড় অংশ হলো মার্কেটিং বা বিপণন। পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে সংরক্ষণসহ গ্রাহকের নিকট পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সমস্ত কার্যক্রমের সাথে মার্কেটিং জড়িত।

বর্তমান সময়ে মার্কেটিং কিন্তু খুবই প্রচলিত ও জনপ্রিয় একটি নাম। শব্দটির সাথে আমরা সবাই কম-বেশি পরিচিত। তবে অনেকেই জানেন না মার্কেটিং সম্পর্কে। বর্তমান সময়ে এসে মার্কেটিং ছাড়া কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা হতে পারে না। কারণ যেকোনো বিজনেসে টিকে থাকা থেকে শুরু করে পণ্যটি ভোক্তার হাত পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া নির্ভর করে মার্কেটিং এর উপর। 

তাই বলা যায়, ব্যবসায়ে সফল হবার মূলমন্ত্র হলো মার্কেটিং। 

সূচিপত্রঃ

মার্কেটিং কি?

ইংরেজি Marketing এর বাংলা প্রতিশব্দ হলো ‘বিপণন’ বা ‘বাজারজাতকরণ’। ল্যাটিন শব্দ Marcatus থেকে ইংরেজি Market শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। আর Market শব্দ থেকে পরবর্তীতে Marketing শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।

নির্দিষ্ট পরিমাণ মুনাফা বা লাভ অর্জনের উদ্দেশ্যে কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের পণ্যদ্রব্য বা সেবা সামগ্রী উৎপাদন থেকে শুধু করে ভোক্তা বা কাস্টমারের নিকট পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সকল কাজকেই মার্কেটিং বলে।

Philip Kotler & Gary Armstrong এর মতে-

“Marketing is a social and managerial process whereby individuals and groups obtain what they need and want through creating and exchanging products and value with others.”

American Marketing Association (AMA)-এর মতে –

“Marketing is the activity, set of institutions, and processes for creating, communicating, delivering, and exchanging offerings that have value for customers, clients, partners, and society at large.”

বর্তমান সময়ে কর্পোরেট জগতে মার্কেটিং এর চাহিদা বেড়েই চলছে। তাই মার্কেটিং নিয়ে জনসাধারণের আগ্রহ নেহাৎ কম নয়। কোম্পানিগুলো তাদের মার্কেটিং পলিসি এপ্লাই করে প্রোডাক্ট সেল করছে৷ এক্ষেত্রে তারা নতুন নতুন কৌশল ও পদ্ধতির প্রয়োগ করছে। কর্পোরেট জগতের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে মার্কেটিং। তাই যতই দিন যাচ্ছে মার্কেটিং এর ব্যাপকতা বাড়ছে। কিন্তু আমরা অনেকেই ঠিকমতো জানি না, মার্কেটিং আসলে কি? চলুন আজ না হয় জেনে নেওয়া যাক মার্কেটিং কাকে বলে এই সম্পর্কে। মার্কেটিং মূলত একটি পরিবর্তনশীল ও জটিল বিষয়। যেখানে ভোক্তার সন্তুষ্টি ও প্রয়োজনকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং সে উদ্দেশ্যেই পণ্যের প্রচার-প্রসার। কাস্টমারের সন্তুষ্টির বিষয়টি মাথায় রেখে ক্রেতা সংখ্যা বৃদ্ধি করা মার্কেটিং এর অন্যতম উদ্দেশ্য। প্রতিটি কোম্পানি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে তাই মার্কেটিং সম্পৃক্ত। আমরা টিভি, নিউজ পেপার, সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্ন প্রোডাক্টের যে বিজ্ঞাপন দেখি তা মূলত প্রোডাক্টের মার্কেটিং। অর্থাৎ বলা যায় যে, মার্কেটিং হচ্ছে কোনো পণ্য, ব্যবসা, সার্ভিস, ব্র্যান্ডের প্রচার ও প্রসার এর কাজে ব্যবহার করা একটি প্রক্রিয়া, যেখানে কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য থাকে নিজেদের পণ্য গ্রাহকের কাছে বিক্রির মাধ্যমে ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি করা।

মার্কেটিং এর ধারণা

মার্কেটিং করতে হলে আপনাকে অবশ্যই এটি সম্পর্কে মৌলিক ধারণা রাখতে হবে। জেনে নেওয়া যাক মার্কেটিং এর মৌলিক ধারণাগুলো সম্পর্কে-

  • সামাজিক ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা রাখা জরুরি। সমাজে আপনার পণ্যের চাহিদা অনুসারে প্রোডাক্ট প্রোসেসিং ও ম্যানেজমেন্টের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। 
  • মার্কেটিং এর অন্যতম কাজ হলো প্রোডাক্টের মার্কেট রিসার্স ও এনালাইসিস করা।
  • উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা বাজারে কতটুকু তার ধারণা একজন মার্কেটার রাখে। কাস্টমারের অভাব ও প্রয়োজন পূরণে পণ্যটি কতটা উপযোগী এ বিষয়েও ধারণা পাওয়া যায়।
  • মার্কেটিং এর আরও একটি কাজ হলো পণ্যের প্রচার ও প্রসার। এতে বাজারে পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়। আর চাহিদা সৃষ্টি হলে পণ্যের বিক্রয়ও বৃদ্ধি পায়।
  • মার্কেটিং এর মাধ্যমে পণ্যের ক্রেতা বৃদ্ধি করা হয় যা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

মার্কেটিং এর ধরণ

মার্কেটিং প্রোডাক্টের সেল বাড়াতে সহায়তা করে। মার্কেটিং বিষয়টি তাই উৎপাদিত পণ্য থেকে শুরু করে কাস্টমারকে পণ্য পৌঁছে দেওয়া অব্দি সম্পৃক্ত। বর্তমান সময়ে তাই মার্কেটিং এর ধরণও আলাদা। যেমন-

B2B মার্কেটিং

B2B মার্কেটিং

B2B মার্কেটিং হলো Business to Business।  অর্থাৎ যা ব্যবসায় থেকে ব্যবসায়কে বোঝায়। যখন একটি কোম্পানি অন্য কোনো কোম্পানির কাছে পণ্য বা পরিষেবা বিক্রি করে তখন B2B মার্কেটিং কৌশল ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে কোম্পানি কিন্তু সাধারণ গ্রাহকদের সাথে কোনো লেনদেন, প্রচার বা মার্কেটিং করে না। এভাবে একটি বিজনেসের সাথে অন্য একটি বিজনেসের মার্কেটিং করার প্রক্রিয়াকে B2B মার্কেটিং বলে। B2B মার্কেটিং এর এই প্রক্রিয়ায় ৮০ শতাংশ ই-কমার্সের অন্তর্ভুক্ত। যেমন- আলিবাবা ডটকম

B2C মার্কেটিং

B2C মার্কেটিং

B2C মার্কেটিং হলো Business to Consumer/Customer মার্কেটিং। অর্থাৎ ব্যবসা থেকে ভোক্তা, কোনো ব্যবসা থেকে শেষ ভোক্তার কাছে বিপণন। কোম্পানি গ্রাহকের কাছে পণ্য বা পরিষেবা বিক্রি করে এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ব্যবসার প্রচার করা হয়। এর দ্বারা গ্রাহকদের কাছে পণ্য বিক্রয় করার প্রক্রিয়াটিকে বোঝায়। কাস্টমার যখন সরাসরি পণ্য কেনাকাটা করে সেটা B2C মার্কেটিং। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- দারাজ ডটকম

C2B মার্কেটিং

C2B মার্কেটিং

C2B মার্কেটিং হলো Consumer to Business মার্কেটিং। অর্থাৎ ভোক্তা-থেকে-ব্যবসা বিপণন। এটি B2C এর বিপরীত এবং এই ধরণের বিপণনে ভোক্তা কোম্পানিকে পণ্য বা পরিষেবা দেয়। C2B হলো এক ধরনের বাণিজ্য যেখানে একজন ভোক্তা বা শেষ ব্যবহারকারী একটি প্রতিষ্ঠানকে একটি পণ্য বা পরিষেবা প্রদান করে। C2B ব্যবসাগুলি তাদের গ্রাহক বেস থেকে ক্রাউডসোর্সিং আইডিয়া, ফিডব্যাক এবং আরও অনেক কিছুর মাধ্যমে ভ্যালু এড করার উপর ফোকাস করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- অ্যামাজনের এফিলিয়েট মার্কেটিং

C2C মার্কেটিং

C2C মার্কেটিং

C2C মার্কেটিং হলো consumer to consumer মার্কেটিং। অর্থাৎ ভোক্তা থেকে ভোক্তা বিপণন বোঝায়। গ্রাহক থেকে গ্রাহক, বা ভোক্তা থেকে ভোক্তা, একটি ব্যবসায়িক মডেল যা গ্রাহকদের মধ্যে পণ্য বা পরিষেবার লেনদেনের সুবিধা দেয়। ভোক্তা থেকে ভোক্তা বা C2C হলো ব্যবসায়িক মডেল যা ব্যক্তিগত ব্যক্তিদের মধ্যে বাণিজ্যকে সহজতর করে। এটি এক ধরনের ব্যবসায়িক মডেল যা ই-কমার্স প্রযুক্তি এবং শেয়ারিং অর্থনীতির মাধ্যমে উদ্ভূত হয়েছে। অনলাইন C2C কোম্পানির সাইটগুলির মধ্যে রয়েছে Craigslist, Etsy এবং eBay, যা একটি শ্রেণিবদ্ধ বা নিলাম পদ্ধতির মাধ্যমে পণ্য বা পরিষেবা বিক্রি করে।

মার্কেটিং এর প্রকারভেদ

বর্তমানে অনেক রকমের মার্কেটিং রয়েছে। আপনি যত বেশি পণ্যের প্রচার করতে পারবেন তত আপনার প্রোডাক্ট বিক্রি হবে। তবে দুই ধরনের মার্কেটিং এর প্রচলন রয়েছে। যেমন- 

  • ট্রেডিশনাল মার্কেটিং
  • ডিজিটাল মার্কেটিং

চলুন ট্রেডিশনাল ও ডিজিটাল মার্কেটিং সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জেনে নেই-

ট্রেডিশনাল মার্কেটিং

ট্রেডিশনাল মার্কেটিং

ট্রেডিশনাল মার্কেটিং কে গতানুগতিক মার্কেটিং বলা হয়। এই ধরণের মার্কেটিং তুলনামূলক সহজ ও সরল একটি প্রক্রিয়া। কারণ ট্রেডিশনাল মার্কেটিং যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আমারা কম বা বেশি সবাই ট্রেডিশনাল বা গতানুতিক মার্কেটিং এর সাথে পরিচিত। ট্রেডিশনাল মার্কেটিং এর মাধ্যমে আপনি সহজেই আপনার নিজের প্রোডাক্ট বা ব্র্যান্ডকে প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে বিক্রি বৃদ্ধি করতে পারেন।

ট্রেডিশনাল মার্কেটিং এর ধরন

  • টিভি এ্যাড।
  • ব্যানার এ্যাড।
  • রেডিও এ্যাড।
  • নিউজ পেপার এ্যাড।
  • ম্যাগাজিন এ্যাড।
  • ফ্লায়ার এ্যাড।
  • ব্রশিউর এ্যাড।
  • ক্যালেন্ডার এ্যাড।
  • সিনেমা এ্যাড।

বিভিন্ন ধরণের বিজ্ঞাপন আপনার পণ্যকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিবে। এর মাধ্যমে সব শ্রেণির মানুষ সহজেই আপনার পণ্য সমন্ধে জানতে পারবে ও বুঝতে পারবে। অর্থাৎ, আপনার প্রোডাক্টের যেকোনো এড যখন টিভিতে, নিউজ পেপারে বা অন্যান্য জায়গায় প্রচারিত হবে তখন সব ধরনের সব বয়সের ও সকল পেশার মানুষ দেখতে পারবে। এতে আপনার পণ্যের বিক্রয় বৃদ্ধি হবে। ট্রেডিশনাল মার্কেটিং এর মাধ্যমে সব শ্রেণির ক্রেতা টার্গেট করা মূলত এভাবে কোম্পানির প্রোডাক্ট ব্র্যান্ডিং, মার্কেটিং ও সেল সম্ভব।

ট্রেডিশনাল মার্কেটিং এর সুবিধা

  • পণ্যের প্রচার সহজ হয়।
  • অনেক মানুষের কাছে পৌঁছায়।
  • সকল শ্রেণির মানুষকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পণ্য সম্পর্কে বোঝানো যায়।
  • দৃষ্টিনন্দন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ক্রেতাকে আকৃষ্ট করা সম্ভব। 
  • ট্রেডিশনাল মার্কেটিং এর মাধ্যমে বিক্রয় বৃদ্ধি পায়।

ডিজিটাল মার্কেটিং

ডিজিটাল মার্কেটিং

বর্তমান যুগে পৃথিবী মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে ইন্টারনেটের কল্যাণে। আর ঘরে বসেই মানুষ ইন্টারনেটের মাধ্যমে গ্রহণ করছে বিভিন্ন সুবিধা। ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে মানুষ হাতের নাগালেই সব পাচ্ছে। এর মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যেও যোগ হয়েছে নবমাত্রা।

ডিজিটাল এই যুগে তাই বিজনেস আরও সহজ হয়েছে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে। এ যুগে মার্কেটিং কে আরও সহজ করে তুলেছে ডিজিটাল মার্কেটিং। ডিজিটাল মার্কেটিংকে তাই ইন্টারনেট মার্কেটিং বা অনলাইন মার্কেটিংও বলা হয়ে থাকে।

বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল মার্কেটিং ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কোনো প্রোডাক্ট বা সার্ভিসকে অনলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা ও এড দেওয়াকে ডিজিটাল মার্কেটিং বলে

বর্তমান সময়ে অনলাইন বিজনেস ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তাছাড়া ছোট-বড় সকল কোম্পানি এখন ডিজিটাল মার্কেটিং এর মাধ্যমে তাদের প্রোডাক্টের ব্র্যান্ডিং ও প্রমোট করছে। যেকোনো প্রোডাক্ট, সার্ভিস, ইমেজ, ভিডিও কনটেন্ট, ব্লগ, ওয়েবসাইট, ব্র্যান্ড, বিজনেস প্রভৃতি ঘরে বসেই প্রমোট করা সম্ভব।

ডিজিটাল মার্কেটিং এর ধরন

  • সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং 
  • এফিলিয়েট মার্কেটিং
  • কনটেন্ট মার্কেটিং 
  • এসইও
  • ই-মেইল মার্কেটিং 
  • পেইড অ্যাডভার্টাইজমেন্ট
  • সার্চ ইঞ্জিন মার্কেটিং 
  • ওয়েব এনালাইটিক্স 

ডিজিটাল মার্কেটিং এর সুবিধা

  • ডিজিটাল মার্কেটিং এর মাধ্যমে অনলাইন মার্কেটিং করা যায়। এর ফলে দ্রুত ক্রেতা আকৃষ্ট করা সম্ভব। 
  • এর মাধ্যমে আপনার পণ্যের সেল খুব দ্রুত বেড়ে যাবে।
  • ডিজিটাল মার্কেটিং এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী আপনার পণ্যের প্রচার সম্ভব।
  • এটিতে মার্কেটিং খরচ তুলনামূলক কম।
  • আপনি খুব দ্রুত টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছাতে পারবেন।

মার্কেটিং এর প্রয়োজনীয়তা 

ব্যবসায়ের সফলতা ও বৃদ্ধির জন্য মার্কেটিং এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য তাই মার্কেটিং এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে মার্কেটিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক মার্কেটিং বা বিপণনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে- 

সামাজিক চাহিদা পূরণ

মার্কেটিং বিভিন্ন ধরণের উপযোগ সৃষ্টি করে যেমন- স্বত্ত্বগত, স্থানগত, সময়গত, কালগত, রূপগত প্রভৃতি। সমাজের বিভিন্ন মানুষের বস্তুগত ও অবস্তুগত নানা চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মার্কেটিং ছাড়া সমাজের মানুষের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই সামাজিক চাহিদা পূরণে বিপণন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

উৎপাদন বৃদ্ধি

বিপণন একদিকে পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উৎপাদকের উপায় ও উপকরণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। অন্যদিকে সেই উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। মার্কেটিং উৎপাদনের চাকা সচল রাখে, ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

পণ্যের সুষম বন্টন  

সব পণ্য সব জায়গায় উৎপাদন হয় না। যেমন- চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের উৎপাদন বেশি। আর নির্দিষ্ট এলাকার পণ্য সকলের কাছে পৌঁছে দিতে কাজ করে বিপণন। কারণ বিপণনের মাধ্যমে ঘাটতি অঞ্চলে উদ্বৃত্ত পণ্য বিক্রি করা হয়, এতে পণ্যের যথাযথ ও সুষম বন্টন করা সম্ভব। 

মূল্যমানে স্থিতিশীলতা 

পণ্যের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমতা বিধান করে মার্কেটিং। চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমতা না থাকলে বাজারে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে। কিন্তু মার্কেটিং এটি ব্যালেন্স করে। এতে পণ্যের মূল্যমান স্থিতিশীল থাকে। 

ভোগের বৈচিত্র্যকরণ

বিপণন ভোগ প্রবণতা বৃদ্ধির সাথে আয়ের প্রবণতা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা পালন করে। নানা ধরণের বিকল্প পণ্য মানুষের সামনে তুলে ধরে বিপণন। এতে ভোক্তা তার সামর্থ্য অনুসারে প্রয়োজনীয় ও উত্তম পণ্য বেছে নেবার সুযোগ পায়। এতে ভোগের ক্ষেত্রে যেমন বৈচিত্র্যতা আসে তেমন উৎপাদন ও বন্টনেও গতিশীলতা আসে।

ব্যবসায়িক ঝুঁকি হ্রাস

একজন ব্যবসায়ীর মূল লক্ষ্য পণ্য বিক্রি করা আর এ পণ্য ভোক্তার নিকট পৌঁছে দিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে বিপণন। বাজারে পণ্যের ধরণ, চাহিদা, কতটুকু প্রয়োজন তা বিপণন নিশ্চিত করে আর সে অনুযায়ী উৎপাদন হয়। ঠিক তেমনি স্বল্প সময়ে কিভাবে অধিক ভোক্তার কাছে সেই পণ্য পৌঁছাতে পারে তা বিপণনের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। এতে অ-বিক্রিত পণ্য থাকার ঝুঁকি কমে সেই সাথে ব্যবসায়িক ঝুঁকিও হ্রাস পায়।

কর্মসংস্থান

বর্তমানে মার্কেটিং ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ। ট্রেডিশনাল মার্কেটিং এর পাশাপাশি ডিজিটাল মার্কেটিং এর গুরুত্ব ও চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। কোম্পানিগুলো প্রোডাক্ট মার্কেটিং এর উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করছে। এছাড়া অনেকেই আজকাল ডিজিটাল মার্কেটিং এর মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। ফলে অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। 

শিল্প কলার উন্নয়ন 

মার্কেটিং শিল্প কলার উন্নয়নে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোনো পণ্যের প্রচারে শিল্প কলারও অবদান রয়েছে৷ অর্থাৎ, একটি পণ্যের মোড়ক কিভাবে সুন্দর করা যায়, বিজ্ঞাপন কতটা দৃষ্টিনন্দন ও ভোক্তা আকৃষ্ট করা যায়, দোকানের সাজসজ্জা কতটা আকর্ষণীয় করা যায়, পণ্যের উপস্থাপন প্রভৃতি বিষয় শিল্প কলার অন্তর্ভুক্ত। তাই বলা যায়, বিপণনের মাধ্যমে মূলত শিল্প কলার উন্নয়ন হয়।

সম্পর্কের উন্নয়ন 

বিপণনের মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতার প্রত্যক্ষ এবং উৎপাদনকারী ও ক্রেতার পরোক্ষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এছাড়া বিপণনের মাধ্যমে একদেশের সাথে গড়ে উঠে অন্য দেশের সম্পর্ক। তাই সম্পর্কের উন্নয়নে বিপণনের ভূমিকা রয়েছে। 

জীবন-যাত্রার মানোন্নয়ন 

মার্কেটিং ভোক্তার পছন্দ, চাহিদা নিয়ে কাজ করে। মার্কেটিং এর মাধ্যমে ক্রেতার পছন্দ অনুসারে পণ্য সরবারাহ করা হয় বিধায় জীবন-যাত্রার মানোন্নয়নও সম্ভবপর হয়। আয় বৃদ্ধি, ভোগের সামর্থ্য বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে মানুষের জীবন-যাত্রার উন্নতি হয়। 

অর্থনৈতিক উন্নয়ন 

বিপণনের ফলে দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন বৃদ্ধি পায় তেমন বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডেরও ব্যাপক উন্নয়ন হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, ভোক্তা উন্নয়ন, আয় বৃদ্ধি পায়। মূলকথা সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়। 

বাজার সৃষ্টি ও বিশ্লেষণ 

মার্কেটিং এর মাধ্যমে বাজার সৃষ্টি করা হয়। বাজারে পণ্যের চাহিদা, যোগান এসব রিসার্চের পাশাপাশি বাজার নিয়েও মার্কেটারকে গবেষণা করতে হয়। যথাযথ মার্কেট রিসার্চ ও এনালাইসিসের মাধ্যমে ভোক্তা সৃষ্টি করা হয়। একজন বিপণনকারীকে অবশ্যই বাজারের যেকোনো পরিবর্তনের প্রতি নিরীক্ষণ করতে হবে এবং তাদের সাথে দ্রুত মানিয়ে নিতে সক্ষম হতে হবে।

ক্রেতা সন্তুষ্টি

মার্কেটিং এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ক্রেতার জন্য ভ্যালু সৃষ্টি ও তাকে সন্তুষ্টি প্রদান করা। উপযুক্ত মূল্যে, সর্বোচ্চ মানের পণ্য এবং সর্বোচ্চ মানের সেবা প্রদান করার মাধ্যমেই ক্রেতা ভ্যালু ও সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব হয়। 

ব্যবসায়ের খ্যাতি ধরে রাখে

আপনার ব্যবসার খ্যাতি নির্ভর করে ব্যবসায়ের বৃদ্ধি এবং এর আয়ুষ্কাল কত তার উপর। এখানেই মার্কেটিং ব্যবসার ব্র্যান্ড ইক্যুইটি তৈরি করে। মার্কেটিং সঠিক পণ্য ভোক্তাদের নিকট পৌঁছে দেয় সেই সাথে গ্রাহকদের প্রত্যাশা পূরণ করে। এর ফলে ব্যবসায়ের খ্যাতি বৃদ্ধি পায়।

বুস্টিং সেল

যেহেতু বিপণন পণ্য বা পরিষেবার প্রচারের জন্য বিভিন্ন উপায় ব্যবহার করে। তাই এটি বিক্রয়ের সম্ভাবনা বাড়াতেও সাহায্য করে। কাস্টমারদের পছন্দসই প্রোডাক্ট সেল করা, নির্দিষ্ট সময়ে তা কাস্টমারের হাতে পৌঁছানো, ভালো রিভিউ এগুলো প্রোডাক্টের সেল বুস্টিং এ সহায়তা করে।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান সময়ে মার্কেটিং এর ভ্যালু ও ডিমান্ড বাড়ছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে মানুষ ট্রেডিশনাল মার্কেটিং ছাড়াও ডিজিটাল মার্কেটিং এ বেশি আগ্রহী হয়ে পড়ছে। যেহেতু এখন সবকিছুই অনলাইন বেইসড তাই ডিজিটাল মার্কেটিং এর চাহিদাও তুঙ্গে। এতে প্রোডাক্টের সেলও বাড়ছে। তাই ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে মার্কেটিং এর অবদান অনস্বীকার্য।

সচারাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

১. কর্পোরেট মার্কেটিং কি?

উত্তর: কর্পোরেট মার্কেটিং হলো বিপণন কৌশলের একটি দিক। যা মূলত ব্র্যান্ড ইমেজ এবং তার ভোক্তাদের সাথে একটি কোম্পানির সম্পর্ককে কেন্দ্র করে তৈরি। গ্রাহক সন্তুষ্টি বজায় রাখা, ব্র্যান্ডের আনুগত্য তৈরি করা, ব্র্যান্ডের গ্রাহক বাড়ানোর চেষ্টা করার সময় এটি ব্র্যান্ডের নির্দিষ্ট গুণাবলী এবং বৈশিষ্ট্যগুলিকে হাইলাইট করে।

২. মার্কেটিং এর জনক কে?

উত্তর: বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট জগতে ড. ফিলিপ কোটলার- কে মার্কেটিং এর জনক হিসেবে সম্মান করা হয়। তিনি একজন মার্কিন বিপণন বিশেষজ্ঞ। ‘মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট’ তাঁর জনপ্রিয় একটি বই।

৩.ট্রেড মার্কেটিং কাকে বলে?

উত্তর: মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পণ্যদ্রব্য ও সেবাকর্ম ক্রয়-বিক্রয় কার্যকে ট্রেড বা পণ্য মার্কেটিং বলা হয়। আন্তর্জাতিক ট্রেড মার্কেটিং এর মাধ্যমে  এক দেশের সাথে অন্য দেশের মধ্যে পণ্য ও পরিষেবাদি ক্রয়-বিক্রয় করা হয়। 

৪. মার্কেটার কে?

উত্তর: মার্কেটিং পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের বলা হয় মার্কেটার বা বিপণনকারী। একজন মার্কেটার বা মার্কেটিং ম্যানেজার বাজার বিশ্লেষণ, ক্লায়েন্টদের সাথে যোগাযোগ, নতুন ক্লায়েন্ট তৈরি, প্রতিযোগীতা বিশ্লেষণ, ভোক্তা আকৃষ্টকরণ, অর্থ বিশ্লেষণ প্রভৃতি কাজ করে থাকে। 

৫.মার্কেটিং প্ল্যান কাকে বলে?

উত্তর: কোনো প্রতিষ্ঠানের পণ্যকে গ্রাহকদের সামনে পরিচিতির মাধ্যম, কোম্পানির টার্গেট রিচ, যে বিশেষ ধরনের পরিকল্পনা করাকে মার্কেটিং প্ল্যান বলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button