চাকরিপড়াশুনাপেশাশিক্ষা

সঠিকভাবে প্রতিবেদন লেখার নিয়ম ২০২৩ (নমুনা সহ)

প্রতিবেদনের সাথে আমাদের দৈনিক অনেকভাবেই পরিচয় হয়। খবরের কাগজ থেকে শুরু করে টিভির বিভিন্ন খবরের প্রতিটিই এক একটি প্রতিবেদন। এছাড়াও বর্তমানে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুল কলেজেও পরীক্ষায় প্রতিবেদন রচনা করতে হয়। যেকোনো ধরনের সমস্যায় রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষন করতে কোন একটি দৈনিক পত্রিকায় সমস্যাটির উপর প্রতিবেদন জমা দেয়া যায়। যা অনেক সময়ই বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। চাকরিক্ষেত্রেও এর অনেক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিভিন্ন মিটিংয়ে বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নিকট বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে হতে পারে। তাই সঠিকভাবে প্রতিবেদন লিখতে পারাটা আমাদের সবার জন্যই প্রয়োজনীয়। সেকারণে এই লেখাটিতে প্রতিবেদন লেখার নিয়ম ও এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় বিষয়বস্তু উল্লেখ করছি।

প্রতিবেদন কি?

প্রতিবেদন শব্দটি ইংরেজি রিপোর্ট (report) শব্দের পারিভাষিক শব্দ। যদিও বাংলা ভাষায় প্রতিবেদনের পাশাপাশি রিপোর্ট শব্দটিও সমানভাবে একই অর্থে ব্যবহৃত হয়।

কোন নির্দিষ্ট বিষয় বা বিশেষ ঘটনার সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধানের পর সে বিষয় বা ঘটনা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা বিবরণীকেই প্রতিবেদন বলে। কারো কারো মতে তথ্যগত ও সত্যনিষ্ঠ বিবরণীকেই প্রতিবেদন বলে। অর্থাৎ কোন বাস্তব ঘটনা বা বিষয়ের উপর নির্দিষ্ট কাঠামোতে লেখা নথি বা বিবরণীই প্রতিবেদন বা রিপোর্ট।

প্রতিবেদনের শ্রেণীবিভাগ

প্রতিবেদন প্রয়োজন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। গঠনের দিক দিয়ে প্রায় সবগুলোতেই কিছু অংশ একই থাকলেও লেখার ধরণ, ভাষা ও অন্যান্য অনেক কিছুতে পার্থক্য থাকতে পারে। এখানে কিছু আলাদা আলাদা প্রতিবেদনের শ্রেনীবিভাগ সম্পর্কে লেখা হলো।

১) সংবাদ প্রতিবেদন

সংবাদপত্রে প্রকাশিত কোন ঘটনা সম্পর্কিত প্রতিবেদনকে সংবাদ প্রতিবেদন বলে। সংবাদ প্রতিবেদন সাধারণত নিজস্ব সংবাদদাতা, নিজস্ব প্রতিবেদক ও অন্যান্য দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে থাকে।

২) দাপ্তরিক প্রতিবেদন

দাপ্তরিক প্রতিবেদনে সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক কোন ঘটনা বা অবস্থা নিয়ে যাচাই-বাছাই করে সে সম্পর্কিত তথ্য, তত্ত্ব, উপাত্ত তুলে ধরা হয়। এবং ক্ষেত্র বিশেষে করনীয় কি তা ব্যাখ্যা করা হয়। দাপ্তরিক প্রতিবেদন অনেক ধরনের হতে পারে। এখানে কয়েকটির ব্যাপারে বলা হচ্ছে।

৩) পর্যায়ক্রমিক প্রতিবেদন

এধরণের প্রতিবেদন সাধারণত কোন একটি প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট কিছু মানুষের কাছে পেশ করা হয়। এতে প্রতিষ্ঠানটির কোন একটি বিষয়কে বিস্তারিতভাবে গ্রাফ বা অন্যান্য তথ্যের সাহায্যে বোঝানো হয়।

৪) প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদন

এধরনের প্রতিবেদন তুলনামূলকভাবে কিছুটা বড় হয়। এতে বিস্তারিত ভাবে একটি ঘটনার বা বিষয়ের প্রতিবেদনের সকল তথ্য দেওয়া থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট কাঠামো মেনে চলে। 

৫) অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদন

এধরনের প্রতিবেদন তুলনামূলকভাবে ছোট আকারের হয়। এসব প্রতিবেদন সাধারণত কোন অনুষ্ঠান ঘোষণা, কোন প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন ঘোষণার কাজে ব্যবহৃত হয়।

৬) গবেষণামূলক বা তদন্ত প্রতিবেদন

এসকল প্রতিবেদনে কোন একটি ঘটনা বা নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের তথ্য নিয়ে কাজ করা হয়। এক্ষেত্রে তথ্য প্রকাশ করে ঐ ঘটনা বা বিষয়ের কারণে পরবর্তীতে কি কি হতে পারে, সমাধান কি এসব নিয়ে লেখা হয়। 

৭) ঘোষণা দেয়ার প্রতিবেদন

এধরনের প্রতিবেদনে কোন প্রতিষ্ঠান তাদের কোন তথ্য বাইরের সাধারণ মানুষের কাছে প্রকাশ করে। এটি তাদের কোন অভ্যন্তরীণ তথ্য প্রকাশে, কোন পণ্য বাজারে ছাড়া, কোন নতুন ঘোষণা দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়।

৮) নতুন প্রস্তাবের প্রতিবেদন 

এধরনের প্রতিবেদনে কোন একটি সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য, কোন পরিবর্তন আনার জন্য বা অন্য কোন কাজের সুবিধার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়।

প্রতিবেদনের বৈশিষ্ট্য

প্রতিবেদন লেখার নিয়মের পাশাপাশি কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর লক্ষ্য রাখতে হয়।

  • কাঠামো: প্রতিবেদন লেখার ক্ষেত্রে যথাযথ কাঠামো অনুসরণ করতে হয়। তাই প্রতিবেদন রচনার আগে প্রতিবেদনের কাঠামো আগে তৈরি করে নেয়াটা সুবিধাজনক।
  • সঠিক তথ্য: প্রতিবেদন যে ধরনেরই হোক না কেন, প্রতিবেদনের তথ্য সবসময় নির্ভুল, নির্ভরযোগ্য ও সম্পুর্ণ হতে হবে। এজন্য প্রতিবেদন রচনার আগে প্রতিবেদককে প্রতিবেদনের বিষয়ের উপর সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে নিতে হবে।
  • উপস্থাপনা: প্রতিবেদনের উপস্থাপনা ও পরিবেশন আকর্ষণীয় হতে হবে। যাতে প্রতিবেদনটি যিনি পড়বেন তিনি প্রতিবেদনটি পড়তে আগ্রহ বোধ করেন। এবং একই সাথে প্রতিবেদনের ভাষা যথাসম্ভব সহজ সরল রাখতে হবে। 
  • প্রতিবেদনের আকার: প্রতিবেদনের কোন নির্দিষ্ট আকার নেই। ধরনভেদে প্রতিবেদন ছোট বড় দুই ধরনেরই হতে পারে।

একটি সফল প্রতিবেদনের গুণাবলিঃ

প্রতিবেদন কখনো কখনো প্রধান কাঠামো অনুসরণ করে লেখা হলেও সেটা ভালোভাবে জনপ্রিয়তা না পেতে পারে। প্রতিবেদন কখনো নির্দিষ্ট একজনকে উদ্দেশ্য করেও লেখা হয়। গঠনগত ভুল ছাড়াও অন্য কোন কারণেও ঐ ব্যাক্তির প্রতিবেদনটি পছন্দ না হতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেদনটি ব্যর্থ বলা হতে পারে। সফল প্রতিবেদন সেটিই, যেটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। এখানে সফল একটি প্রতিবেদনের বৈশিষ্ট্য দেয়া হল্য

  • আকর্ষণীয় শিরোনামঃ প্রতিবেদনের শিরোনাম আকর্ষণীয় থাকবে। যাতে করে শিরোনাম পড়ার পর প্রতিবেদনটি পড়ার জন্য পাঠকের আগ্রহ জাগবে।
  • স্বাভাবিক ও সহজ ভাষায় লেখাঃ একটি প্রতিবেদনের ভাষা হতে হবে যথাসম্ভব সহজ-সরল। প্রতিবেদনে কোন অতিরিক্ত কথা থাকবে না।
  • যথাসম্ভব ছোট ও এক কথার বাক্য ব্যবহার করাঃ কোন কিছু পড়ার সময় ছোট ও এক কথার বাক্য বোঝা আমাদের জন্য তুলনামূলকভাবে সহজ। এমনকি এধরণের বাক্যে ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে। তাই প্রতিবেদনে বাক্যগুলো ছোট ও এক কথায় থাকবে।
  • স্পষ্ট ও নির্দিষ্টভাবে বিষয়ের বর্ণনাঃ প্রতিবেদনের প্রতিটি বিষয় স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট থাকবে। যাতে কোন বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ থাকবে না।
  • কোন বিষয়ের উপসংহার, ধারণা, অনুমান ব্যবহার না করাঃ প্রতিবেদনের প্রতিটি তথ্য বাস্তব ও পর্যবেক্ষণযোগ্য ঘটনা থাকবে। এবং কোন তথ্য সম্পুর্ন উল্লেখ না করে শুধুমাত্র তথ্যের উপসংহার লেখা যাবে না।
  • প্রতিটি তথ্যের জন্য ছোট ছোট প্যারাগ্রাফ থাকাঃ পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতিবেদনের আলাদা আলাদা তথ্য ছোট ছোট প্যারাগ্রাফ হিসেবে আলাদাভাবে থাকবে।
  • ছোট ছোট অনেকগুলো তথ্যের জন্য বুলেট ব্যবহার করাঃ প্রতিবেদনে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে অনেকগুলো ছোট তথ্য থাকলে সেগুলো বুলেট পয়েন্ট আকারে লেখা থাকবে। এর ফলে পাঠকের প্রতিটি তথ্য আলাদা করতে ও বুঝতে সুবিধা হয়। 
  • নিরপেক্ষতাঃ এটি মুলত খবরের প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে বেশি প্রয়োজনীয়। এধরণের প্রতিবেদনের প্রতিটি বিষয়ই নিরপেক্ষ হতে হবে। এবং কোন বাক্যেই কোনভাবে পক্ষপাত প্রকাশ পাবে না।

প্রতিবেদন লেখার কাঠামো

  • শিরোনামঃ প্রতিবেদনের সবার উপরে প্রতিবেদনের শিরোনাম থাকবে। শিরোনাম একটি ছোট বাক্যে দেওয়াটাই ভালো। 
  • প্রতিবেদনের সারাংশঃ প্রতিবেদনের শিরোনামের পর একটি ছোট প্যারায়  শিরোনামের সারাংশ লেখতে হবে। যাতে এই অংশ পড়েই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবেদন লেখার সময় এই অংশটি বাদ রাখা হতে পারে।
  • ভুমিকাঃ মূল প্রতিবেদনের শুরুতে প্রতিবেদনের ভূমিকা থাকবে। ভূমিকায় প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুর সাথে পাঠকের পরিচয় করে দেওয়া হবে। 
  • বিষয়বস্তুঃ এটি প্রতিবেদনের প্রধান ও সবচেয়ে বড় অংশ। এখানে প্রতিবেদনের সকল বিষয়বস্তু থাকে।
  • প্রতিবেদকের নাম, ঠিকানা ও অন্যান্য বিষয়ঃ এখানে প্রতিবেদকের সকল তথ্য, প্রতিবেদন তৈরীর সময়, ছবি যুক্ত থাকবে। সংবাদপত্রের জন্য লেখা প্রতিবেদনে এই অংশটি প্রতিবেদনের একদম প্রথমে উপস্থাপন করতে হয়। 

প্রতিবেদনের নমুনা

আপনাদের সুবিধার জন্য এখানে কিছু প্রতিবেদনের নমুনা দেওয়া হলো।

শিক্ষা সফরের প্রতিবেদন লেখার নিয়মঃ

এধরণের প্রতিবেদন মূলত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিকট জমা দিতে হয়। এতে শিক্ষা সফরের সকল খুটিনাটি বিষয় ও সমস্যা বর্ণনা করা থাকে।শিক্ষাসফরের প্রতিবেদন এর নমুনা

যানজট সমস্যার প্রতিবেদন লেখার নিয়মঃ

এটি একটি সংবাদ প্রতিবেদন। এখানে যানজটের ফলে কি কি অসুবিধা হয়, যানজট কেন হয় এবং এর প্রতিকার কি এসব বিষয় উঠে আসবে। এটি সাধারণত একটি গবেষণামূলক প্রতিবেদন হবে, যাতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও সেগুলো বিশ্লেষণ করে আলোচনা থাকবে।যানজট সমস্যার প্রতিবেদন এর নমুনা

করোনা ভাইরাসের বিষয়ে প্রতিবেদন লেখার নিয়মঃ

এটিও একটি গবেষণামূলক প্রতিবেদন। এখানে করোনা ভাইরাসের বিষয়ে সকল বর্তমান তথ্য প্রদান করতে হবে ও সেগুলো বিশ্লেষণ করা হবে।করোনা ভাইরাসের বিষয়ে প্রতিবেদন এর নমুনাঃ ১করোনা ভাইরাসের বিষয়ে প্রতিবেদন এর নমুনাঃ ২করোনা ভাইরাসের বিষয়ে প্রতিবেদন এর নমুনাঃ ৩করোনা ভাইরাসের বিষয়ে প্রতিবেদন এর নমুনাঃ ৪করোনা ভাইরাসের বিষয়ে প্রতিবেদন এর নমুনাঃ ৫

শেষকথা

প্রতিবেদন আমাদের অনেকেরই অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়তে পারে। প্রতিবেদন লেখা বেশ সময়সাপেক্ষ ও পরিশ্রমের একটা কাজ। কিন্তু সঠিকভাবে প্রতিবেদন না লিখতে পারার কারণে অনেক সময়ই প্রতিবেদন বাতিল হয়ে যেতে পারে। তাই সঠিক ও নির্ভুলভাবে প্রতিবেদনের নিয়ম মেনে লেখার জন্য এই লেখাটি আপনাদের কাজে আসবে বলে আশা করছি।

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button