পরিচয় পত্রপাসপোর্ট

পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে করণীয়

জন্ম সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট ব্যক্তি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে। জন্ম সনদ ও জাতীয় পরিচয় পত্র নাগরিক জীবনে প্রায় সবার থাকলেও পাসপোর্ট কিন্তু সবার থাকে না। কোন বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া পাসপোর্ট সবাই তৈরী করে না। কিন্তু যাদের পাসপোর্ট আছে তাদের কাছে পাসপোর্টের গুরুত্ব অনেক বেশি। হরহামেশাই অসতর্কতার কারণে পাসপোর্ট হারিয়ে যায় কিংবা নষ্ট হয়ে যায়। তাই  আমরা এই লেখার মাধ্যমে পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে কিভাবে পাসপোর্ট পুনরুদ্ধার করা হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর চেষ্টা করবো।

পাসপোর্ট কি?

এক দেশের নাগরিক অন্য কোনো দেশে ভ্রমণ করতে গেলে তিনি যে দেশের নাগরিক ওই দেশের সরকার কর্তৃক প্রদানকৃত ভ্রমণ নথিই হলো পাসপোর্ট। বাংলদেশের প্রেক্ষাপটে বহির্গমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের নিকট আবেদন করে বিশেষ কিছু ধাপ অতিক্রম করার পরে পাসপোর্ট পাওয়া যায়  সাধারণত পাসপোর্টের বৈধতার মেয়াদকাল ১০ বছর। তবে অনূর্দ্ধ ৫ বছর বয়সী নাগরিকদের জন্য এই মেয়াদকাল ৫ বছর। পাসপোর্ট ইস্যু সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যাদি বাংলাদেশ পাসপোর্ট আদেশ-১৯৭৩ এবং বাংলাদেশ পাসপোর্ট বিধিমালা-১৯৭৪ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মূলত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাসপোর্ট সংক্রান্ত বিষয়াদি তদারকি করে থাকে।

বাংলাদেশে তিন ধরনের পাসপোর্ট প্রদান করা হয়। এগুলো হলোঃ

  • আন্তর্জাতিক পাসপোর্টঃযে কোনো দেশে ভ্রমণ করার জন্য ব্যবহৃত হয় আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট। 
  • বিশেষ পাসপোর্টঃ শুধু ভারতে ভ্রমণ করার জন্য এই বিশেষ পাসপোর্ট প্রদান বরা হয়। 
  • কূটনৈতিক পাসপোর্টঃ কূটনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য এই পাসপোর্ট দেওয়া হয়। 

পাসপোর্টের ব্যবহার

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৩ সালে পূর্ণাঙ্গ রূপে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলাদেশে মূলত তিন রঙ এর পাসপোর্ট চালু আছে, যা মূলত তিনটি ভিন্ন ধরণ ও ব্যবহার নির্দেশকারী প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে লাল, নীল ও সবুজ এই তিন রঙের পাসপোর্ট চালু আছে।

  • লাল পাসপোর্টঃ  লাল পাসপোর্টকে বলা হয় ডিপ্লোম্যাটিক বা কূটনৈতিক পাসপোর্ট। অর্থাৎ কূটনৈতিক কাজে দেশের বাইরে যেতে লাল পাসপোর্ট প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসভার সদস্যগণ, সংসদ সদস্য এবং তাদের স্বামী বা স্ত্রী কূটনৈতিক পাসপোর্ট পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। পাশাপাশি উচ্চতর আদালতের বিচারপতিগণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রধান, মন্ত্রণালয়ের সচিবগণ এবং বিদেশে বাংলাদেশি মিশনের কর্মকর্তারাও লাল পাসপোর্ট পাওয়ার যোগ্য। লাল পাসপোর্টধারীদের সুবিধা হলো তাদের বিদেশ ভ্রমণের জন্য কোন রকম ভিসার প্রয়োজন হয় না। তারা সংশ্লিষ্ট দেশে অবতরণের পর ভিসা পান। অর্থাৎ তাদের ভিসা জটিলতা নেই বললেই চলে।
  • নীল পাসপোর্টঃ অফিসিয়াল পাসপোর্টের রং নীল হয়ে থাকে। সরকারি কাজে সরকারি কর্মকর্তাগণ দেশের বাহিরে গেলে নীল পাসপোর্ট ব্যবহার করে থাকেন। তবে এই পাসপোর্ট  এই করার জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিসের অনুমোদন বা গভর্নমেন্ট অর্ডার (জিও) থাকতে হয়। নীল পাসপোর্ট শুধু অফিসিয়াল কিংবা সরকারি কাজেই ব্যবহার করা যাবে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা যাবে না। লাল পাসপোর্টধারীদের মতো নীল পাসপোর্টধারীরা ভিসা ছাড়া সব দেশে যেতে না পারলেও ২৭ টি দেশে যেতে পারেন ভিসা ছাড়াই।
  • সবুজ পাসপোর্টঃ সবুজ রং এর পাসপোর্টকে সাধারণ পাসপোর্ট বা বর্তমানে যাকে ই-পাসপোর্ট হিসেবে ধরা হয়। এই পাসপোর্ট দেশের সব নাগরিক ব্যবহার করতে পারে। সবুজ পাসপোর্ট ব্যবহার করতে প্রত্যেককে দেশের নাগরিক হওয়া বাধ্যতামূলক। এই পাসপোর্টধারীদের ভ্রমণের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের ভিসা প্রয়োজন।

পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে করণীয় 

অনেক সময় খেয়ালিপনার জন্য কিংবা ভুলক্রমে পাসপোর্ট হারিয়ে যায়। মূল্যবান এই পাসপোর্ট দেশে কিংবা দেশের বাহিরে যেখানেই হারায়ে যাক অথবা খোয়া যাক না কেনো বেশ বিপাকে পড়তে হয়, ভোগান্তি পোহাতে হয়। পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে পাসপোর্টধারী পাগলের মতো পাসপোর্ট পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে থাকে। পাসপোর্ট পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে দেশে ও দেশের বাহিরের প্রসেসে ভিন্নতা রয়েছে। এ পর্যায়ে আপনাদের পাসপোর্ট দেশে হারিয়ে গেলে করণীয় ও বিদেশে হারিয়ে গেলে করণীয় সম্পর্কে অবগত করবো।

পাসপোর্ট দেশে হারালে যা করবেন

থানায় জিডি করুন

আমরা বিভিন্ন কারণেই থানায় সাধারণ ডায়রি বা জিডি করে থাকি। কোনো কিছু হারিয়ে গেলেও একই কাজ করি আমরা। তবে জিডি যে কোনো থানায় করলে হবে না, পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে যে এলাকায় পাসপোর্টটি হারিয়ে গেছে সেই এলাকার থানাতে জিডি করতে হবে। জিডি করার সময় অবশ্যই পাসপোর্ট নাম্বারটি দিতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনার পাসপোর্টের নাম্বার জানা থাকা জরুরী। জিডি করার পর অন্তত নিশ্চিত হওয়া যাবে যে আপনার পাসপোর্ট কেউ ব্যবহার করতে পারবেনা। কারণ জিডি করার পরপরই পুলিশ ইমিগ্রেশন ডাটাবেজে আপনার হারিয়ে যাওয়া বা চুরি যাওয়া পাসপোর্টের বিষয়ে সতর্কতা জারি করবে যেনো ওই পাসপোর্ট ব্যবহার করে কেউ দেশের বাহিরে যেতে না পারে। 

পাসপোর্ট রি-ইস্যুর আবেদন করুন

পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে রি-ইস্যুর আবেদন প্রক্রিয়া

দুর্ভাগ্যবশত হারিয়ে যাওয়া পাসপোর্টটি উদ্ধার করা না গেলে পুনঃরায় পাসপোর্টের রি-ইস্যুর জন্য আবেদন করে পাসপোর্ট নিতে হবে। পাসপোর্টের আবেদন করতে আবারো নতুন করে সব তথ্যাদি দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সদ্য তোলা ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, সাধারণ ডায়েরির মূল কপি, হারিয়ে যাওয়া পাসপোর্টের ফটোকপি (যদি থাকে)। পাসপোর্ট আবেদনের সময় পুরো আবেদন ফি দিতে হবে। অর্থাৎ পাসপোর্ট প্রথমে করতে যেমন টাকা লেগেছিলো এখনো তেমনটাই লাগবে। তবে পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে তা পুনরুদ্ধার করতে ওই পাসপোর্টের রঙীন, সাদাকালো ফটোকপি, ভিসা সংযুক্ত থাকলে তার ফটোকপি সাথে থাকলে পাসপোর্ট পুনঃরুদ্ধার করা সহজ হয় কিছুটা, অন্ত্যত ঝামেলা এড়ানো যায়। 

বিদেশে পাসপোর্ট যা করবেন

দেশে পাসপোর্ট হারালে কিছুটা ভোগান্তি হলেও পুনরুদ্দার করা কিংবা নতুন করে পাসপোর্ট করা বিদেশের তুলানয় তুলনামূলক সহজ। কেননা দেশের সব কিছুই আপনার জানা, চেনা কিন্তু বিদেশে আপনার সবটাই অপরিচিত। তবুও বিদেশে পাসপোর্ট হারালেও তো সেটা পুনঃরুদ্ধার করতে হবে নয়তো বিদেশ থেকে ফেরাও যাবে না। তাই বিদেশে পাসপোর্ট হারালে যাবতীয় করণীয় বিষয়াদি জানবো এ পর্যায়ে।

দূতাবাসে বিবৃতি দান ও পাসপোর্ট পুনরুদ্ধারে করণীয়

বিদেশে পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে প্রথমে তাকে ঐ দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস খুঁজে বের করে সেখানে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে পাসপোর্ট হারানোর বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে হবে। এরপর যে এলাকায় বা যে সম্ভাব্য এলাকায় পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে ওই এলাকায় সাধারণ ডায়েরি বা জিডি করতে হবে। এই জিডি কপি দূতাবাসে জমা দেওয়ার পর তারা পাসপোর্টের বিকল্প হিসেবে ট্রাভেল পারমিট দেবেন, যা ব্যবহার করে ভ্রমণ করা যাবে। তবে ট্রাভেল পারমিটের জন্যও দূতাবাসে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্যাদি প্রদান করতে হবে।

সেগুলো হলোঃ 

হারানো পাসপোর্টের ফটোকপি

★ হারানো পাসপোর্টের সংযুক্ত ভিসার ফটোকপি

★থানার জিডি কপি

★ পাসপোর্ট সাইজের দুই কপি ছবি

★ সি ফরম

★মিনিস্টার কাউন্সিলর বরাবর চিঠি

পাসপোর্ট লস্ট সার্কুলার কপি সংগ্রহ করুন

দূতাবাসে যোগাযোগ করে পাসপোর্ট হারানোর বিষয়ে রিপোর্ট করার সময় অবশ্যই পাসপোর্ট লস্ট সার্কুলারের জন্য আবেদন করতে হবে। ভবিষ্যতে ভিসা আবেদন ও বিভিন্ন আইনি কার্যক্রমের জন্য পাসপোর্ট লস্ট সার্কুলার একটি অতি প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট হিসেবে কাজ করে। এতো ঝামেলা পোহানোর পর ট্রাভেল পারমিট পাওয়া যায়।

হারানো পাসপোর্টের ফটোকপি না থাকলে কিংবা নাম্বার জানা না থাকলে করণীয়

পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে একে আমরা বিপদে পড়ে যাই তার উপর যদি হারিয়ে যাওয়া পাসপোর্টের কোনো কপি না থাকে সেক্ষেত্রে মহা বিপদ। কারণ নাম্বার জানা না থাকলে জিডি করাও সম্ভব না। জিডি করতে অন্তত পাসপোর্ট নাম্বার জরুরি।

হারিয়ে যাওয়া পাসপোর্টের ফটোকপি ও পাসপোর্ট নম্বর জানা না থাকলে সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে পাসপোর্টের তথ্য বের করে নিতে হবে। পাসপোর্টের তথ্য বের করতে প্রয়োজন হবে পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম নিবন্ধন সনদ যেটি ব্যবহার করে পাসপোর্ট করা হয়েছিলো । এরপর ব্যক্তিগত পরিচিতি নম্বর (এনআইডি/জন্ম নিবন্ধন নম্বর) দিয়ে পাসপোর্ট ডাটাবেইজ থেকে সার্চ করে পাসপোর্টের সকল তথ্য পাওয়া যাবে। 

পাসপোর্ট জালিয়াতি

বর্তমান সময়ে প্রত্যেকেই সহজ ভাবে চলতে চায় যার সূত্র ধরে পাসপোর্ট জালিয়াতির মতো কাজ করে থাকে। পাসপোর্ট জালিয়াতি অনেক কারণে করলেও এর একটি কারণের মধ্যে ধরা যায় পাসপোর্ট তৈরীতে ভোগান্তি। পাসপোর্ট তৈরীতে ভোগান্তি হওয়ায় অনেক পাসপোর্ট জালিয়াতি করে বিদেশ ভ্রমণ কিংবা নিজের কাজ করে আসতে পারেন। কিন্তু পাসপোর্ট জালিয়াতি একটি অন্যতম কঠিন ও অসৎ কাজ। 

পাসপোর্ট জালিয়াতি রোধ করতে পারলে পাসপোর্ট গ্রহণেও ভোগান্তি কমবে। পাসপোর্ট জালিয়াতি কমাতে নিজেদের সচেতনতার পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে।

পাসপোর্ট সংরক্ষণে করণীয়

পাসপোর্ট কতোটা গুরুত্বপূর্ণ সে সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। যে কারণে পাসপোর্ট সংরক্ষণে আমাদের সচেতনতা প্রয়োজন। পাসপোর্ট সংরক্ষণে সর্বপ্রথম দরকার ব্যক্তি সচেতনতা। পাসপোর্ট এমন একটি ব্যাগে রাখতে হবে যা সব সময় সাথে থাকে। সেই সাথে পাসপোর্ট ভালোভাবে রাখতে হবে যেনো কোনো ভাজ না পড়ে কিংবা ছিড়ে না যায়। পাসপোর্ট কোনো ফেলনা না যে যেখানে সেখানে রাখা যাবে তাই সচেতনতার সাথে ব্যবহার করতে হবে। পাসপোর্টের রঙিন ও সাদা কালো কপি করে রাখা জরুরি যেনো সবখানে পাসপোর্ট বের না করে ওই কপি দিয়ে কাজ চালানো যায়।

শেষ কথা

বিদেশ গমনে পাসপোর্টের বিকল্প কিছু নেই। যে কারণে বিদেশগামীদের কাছে পাসপোর্ট অন্যতম এক দলিল। বিদেশ ভ্রমণ ছাড়াও পাসপোর্টের অনেক রকমের ব্যবহার রয়েছে তাই পাসপোর্টের গুরুত্ব অনস্বিকার্য। প্রত্যেকের উচিত সচেতনতার সাথে পাসপোর্ট ব্যবহার করা এবং সংরক্ষণ করা। তবে পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে ভোগান্তি পোহাতে হয়। কিন্তু প্রক্রিয়া জানা থাকলে সহজেই পাসপোর্ট পুনরুদ্ধার করা যায়।

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button