জন্ম নিবন্ধনপরিচয় পত্র

জন্ম নিবন্ধন বাতিল করার নিয়ম

জন্মসনদ প্রতিটি নাগরিকের জীবনেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একজন নাগরিকের নাগরিকত্ব প্রমাণে ভোটার আইডি কার্ডের পরেই জন্মসনদ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও পাসপোর্ট নিবন্ধন, বিবাহ নিবন্ধন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, সরকারি বেসরকারি বা স্বায়ত্ত্শাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরি, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, জমি রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি কাজে বয়স প্রমাণের ক্ষেত্রে জন্মসনদ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাই এর গুরুত্ব লিখে শেষ করা যাবে না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভূলবশত অনেকের একাধিক জন্মসনদ হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় অবশ্যই জন্মসনদের ডুপ্লিকেট কপিটি বাতিল করে দেওয়া প্রয়োজন।

কেনো জন্ম নিবন্ধন বাতিল করবেন?

জন্ম নিবন্ধন সনদ অনলাইনে যাচাই করার পরে যদি দেখেন একের অধিক বা ডুপ্লিকেট হয়ে গেছে তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাতিল করুন কারন, ডুপ্লিকেট জন্মসনদ থাকলে শুধু যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় তা না, এটি নানাবিধ সমস্যারও জন্ম দেয়। পাসপোর্ট তৈরি, চাকরিতে নিয়োগ, ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে শুরু করে আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রেও ডুপ্লিকেট জন্মসনদের কারণে নানা রকম ঝামেলা তৈরি হতে পারে। এমনকি আবেদন বাতিলও হতে পারে। বাংলাদেশের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ অনুযায়ী একজন ব্যাক্তির দুইটি জন্মসনদ থাকা দন্ডনীয় অপরাধ। এই আইন ভঙ্গকারী ব্যাক্তি অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হতে পারেন। ২০১৯ সালের এক পরিসংখ্যানে দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে জন্ম নিবন্ধনের সংখ্যা বেশি হয়ে দাঁড়ায়। যা এক বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্ম দেয়। এর প্রধান কারণ ছিল দ্বৈত জন্ম নিবন্ধন। তারই প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালেই দ্বৈত জন্ম নিবন্ধন ঠেকাতে ইলেক্ট্রনিক মনিটরিং সিস্টেম চালু করা হয়। এছাড়াও কয়েক বছর যাবত দ্বৈত অথবা ভুয়া জন্মসনদের সাহায্যে বহিরাগত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে। তাই বর্তমানে এ ব্যাপারে প্রশাসন বেশ কঠোর হয়েছে। রেজিস্ট্রার জেনারেল এর অফিস থেকে জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠিও পৌঁছেছে। তাই এখন দ্বৈত জন্ম নিবন্ধন করে ডুপ্লিকেট কপি ফেলে রাখাটা এক প্রকার বোকামি ছাড়া কিছু নয়। সেজন্যই ভুলক্রমে আপনার একাধিক জন্মসনদ হয়ে গেলে কিভাবে তা বাতিল করবেন তা জানা থাকা প্রয়োজন।

কিভাবে জন্ম নিবন্ধন বাতিল করবেন?

ডুপ্লিকেট জন্ম নিবন্ধন সনদ বাতিল করা অত্যন্ত সহজ একটি কাজ যা নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করে সহজে ঘরে বসেই  করে ফেলতে পারবেন।

ধাপ ১ঃ নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে প্রবেশ করুন

বাংলাদেশ সরকার অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন ও মৃত্যু নিবন্ধন সম্পর্কিত সকল কাজের জন্য একটি নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট চালু রেখেছে। সেটি হলোঃ www.bdris.gov.bd । এই লেখা থেকে সরাসরি লিংকে ক্লিক করে অথবা ইউআরএলটি (URL) টাইপ করে আপনারা সাইটটিতে প্রবেশ করতে পারবেন। নিচের চিত্রে এর হোম পেজটি দেখানো হলো।জন্ম নিবন্ধন বাতিল করার নিয়ম ধাপঃ ১এই ওয়েবসাইটটিতে প্রবেশ করলেই আপনারা এর মেনুতে ‘জন্ম নিবন্ধন’ নামক অপশন দেখতে পাবেন। অপশনটির উপর মাউসের কার্সর (Cursor) নিলেই নিচের মতো অনেকগুলো অপশন ভেসে উঠবে।জন্ম নিবন্ধন বাতিল করার নিয়ম ধাপঃ ১, ছবিঃ ১অপশনগুলো থেকে ‘সার্টিফিকেট বাতিলের আবেদন’ অপশনটিতে ক্লিক করুন। 

ধাপ ২ঃ জন্মসনদ নির্ধারণ করুন

‘সার্টিফিকেট বাতিলের আবেদন’ অপশনটিতে ক্লিক করলেই আপনি নিচের চিত্রের মতো একটি পেজে চলে যাবেন। এই পেজটিতে আপনি ঠিক কোন জন্মসনদটি বাতিল করতে চান তা নির্ধারণ করতে হবে।জন্ম নিবন্ধন বাতিল করার নিয়ম ধাপঃ ২এটি করতে আপনার ‘জন্ম নিবন্ধন নম্বর’ ও ‘জন্ম তারিখ’ প্রবেশ করিয়ে নিচের ‘অনুসন্ধান’ বাটনে ক্লিক করুন। ক্লিক করার পর জন্ম নিবন্ধনের আইডি, জন্ম তারিখ, নিবন্ধিত ব্যাক্তির নাম, পিতার নাম, মাতার নাম সব দেখানো হবে। সব তথ্য ঠিক আছে কি না তা নিশ্চিত হোন। এবার ডান পাশে থাকা নীল রঙের ‘নির্বাচন করুন’ বাটনে ক্লিক করুন।জন্ম নিবন্ধন বাতিল করার নিয়ম ধাপঃ ২, ছবিঃ ১‘নির্বাচন করুন’ বাটনে ক্লিক করার পর আপনার পদক্ষেপটি নিশ্চিত করতে বলা হবে। নিশ্চিত হলে ‘কনফার্ম’ বাটনে ক্লিক করুন। ‘কনফার্ম’ করার মধ্যে দিয়ে আপনি সংশ্লিষ্ট জন্ম নিবন্ধন বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন। 

ধাপ ৩ঃ নিবন্ধন কার্যালয়ের ঠিকানা প্রদান করুন

‘কনফার্ম’ বাটনে ক্লিক করার পর আপনাকে নিবন্ধন কার্যালয়ের ঠিকানা প্রদান করতে বলা হবে। উল্লেখ্য যে যেই কার্যালয় থেকে আপনার জন্মসনদটি নিবন্ধন করিয়েছেন ঠিক ওই কার্যালয় থেকেই আবার তা বাতিল করতে হবে৷ অন্য কোনো কার্যালয়ের নাম দিলে হবে না। কোন কার্যালয় থেকে করিয়েছেন তা মনে না থাকলে জন্মসনদের উপরে কার্যালয়ের নাম খুজে পাবেন। সেই কার্যালয়ের ঠিকানা প্রদান করুন।জন্ম নিবন্ধন বাতিল করার নিয়ম ধাপঃ ৩ঠিকানা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রথমে দেশ ও বিভাগের নাম প্রদান করতে হবে। বিভাগের নাম প্রদান করার পরে বাকি ঘরগুলো দেখতে পাবেন। পর্যায়ক্রমে জেলা, উপজেলা, সিটি করপোরেশন অথবা ক্যান্টনমেন্টের নাম, ওয়ার্ড বা অঞ্চলের নাম প্রদান করুন। অত:পর ঐ অঞ্চলের যেই অফিস থেকে আপনার জন্মসনদটি নিবন্ধন করিয়েছিলেন তা নির্ধারণ করে দিন। এরপর নীল রঙের ‘পরবর্তী’ বাটনে ক্লিক করুন।

ধাপ ৪ঃ সার্টিফিকেট বাতিলের কারণ ও আবেদনকারীর তথ্য প্রদান করুন

এই ধাপে আপনি কেন জন্ম নিবন্ধন সনদটি বাতিল করতে চাচ্ছেন তার কারণ দর্শাতে হবে। তবে ওয়েবসাইটে বর্তমানে শুধু একটি কারণেরই অপশন রয়েছে। সেটি হলো “ডুপ্লিকেট কপি”। অর্থাৎ শুধুমাত্র জন্মসনদের এক, দুই বা তার বেশি ডুপ্লিকেট কপি থাকলেই কেবল আপনি জন্মসনদ বাতিল করতে পারবেন৷ এক্ষেত্রে আপনি ডুপ্লিকেট কপিটি বাতিল করবেন।জন্ম নিবন্ধন বাতিল করার নিয়ম ধাপঃ ৪কারণ দর্শানোর পর আবেদনকারীর তথ্য প্রদান করতে হবে৷ আপনি যদি নিজের জন্মসনদ বাতিলের জন্য আবেদন করে থাকেন এবং আপনার বয়স যদি ১৮ এর উপর হয়ে থাকে তবে ‘নিজ’ অপশন নির্ধারণ করুন। নাহলে ‘পিতা’ বা ‘মাতা’ অপশন নির্ধারণ করুন।

‘নিজ’ অপশন নির্ধারণ করলে ‘আবেদনকারীর নাম’ এর স্থলে জন্মসনদ অনুযায়ী আপনার নাম আসবে। ‘পিতা’, ‘মাতা’ নির্ধারণ করলে জন্মসনদ অনুযায়ী তাদের নাম আসবে। তবে যদি অন্য কারো হয়ে আবেদন করতে গিয়ে ‘অভিভাবক’ অপশন সিলেক্ট করেন তাহলে আলাদা করে নিজের নাম লিখতে হবে। সেই সাথে নিজের জন্মসনদ নং ও জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর প্রদান করতে হবে।

আবেদনকারী হিসেবে যেই অপশনটি আপনার জন্য সুবিধাজনক ও যথার্থ মনে হয় সেটি নির্ধারণ করুন। অত:পর আবেদনকারীর ঠিকানা দিন। মোবাইল নম্বরটি অবশ্যই নির্ভুল ভাবে দিন। এটিই সবচেয়ে জরুরী। এছাড়াও ইমেইল দিন। সব ঠিক থাকলে ‘সাবমিট’ বাটনে ক্লিক করুন।

ধাপ ৫ঃ আবেদন প্রিন্ট করুন

এই পেজে আসা মানে আপনার আবেদনটি সাবমিট অর্থাৎ দাখিল হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট পেজে আপনার আবেদন পত্রের একটি নম্বর উল্লেখিত থাকবে। নম্বরটি সংরক্ষণ করুন। এই আবেদনটি প্রিন্ট করে আপনি যেই কার্যালয়ে জন্মসনদ বাতিলের আবেদন করেছেন সেই কার্যালয়ে জমা দিতে হবে। জমা দেওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট তারিখও রয়েছে।জন্ম নিবন্ধন বাতিল করার নিয়ম ধাপঃ ৫আবেদনটি প্রিন্ট করতে ‘আবেদনপত্র প্রিন্ট’ নামক সবুজ বাটনটিতে চাপ দিন। এরপর আবেদনের সাথে দেওয়া মোবাইল নম্বরে একটি ম্যাসেজ আসবে এবং আবেদনপত্রটি প্রিন্টের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠবে। অতঃপর আবেদনপত্রটি আপনি সরাসরি প্রিন্ট করতে পারবেন অথবা তার একটি পিডিএফ (PDF) কপি সংরক্ষণ করতে পারবেন। পিডিএফ কপিটির সাহায্যে পরে সুবিধা মতো প্রিন্ট করাতে পারবেন। মনে রাখবেন এই প্রিন্ট কপিটি নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে জন্ম নিবন্ধন কার্যালয়ে যাওয়া অত্যন্ত জরুরী। নাহলে পুরো আবেদনটিই বৃথা হয়ে যাবে।  

শেষকথা

জন্ম নিবন্ধন প্রতিটি নাগরিকের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। আপনি যে এই দেশে জন্মেছেন এবং আপনি এই দেশের নাগরিক তা প্রাথমিক ভাবে জন্মসনদই প্রমাণ করে। তাই প্রত্যেক বাবা মা এর উচিৎ জন্মের ৪৫ দিনের মাথায় শিশুর জন্মসনদ তৈরি করে ফেলা। কিন্তু অনেক সময় সার্ভারের সমস্যা বা অন্যান্য কারিগরি জটিলতার কারণে জন্মসনদের ডুপ্লিকেট কপি হয়ে যেতেই পারে। কিন্তু যেহেতু বর্তমানে জন্ম নিবন্ধনের প্রক্রিয়াটি ডিজিটাল তাই যত দ্রুত সম্ভব এই ডুপ্লিকেট কপি বাতিল করে ফেলা প্রয়োজন।

অনবরত জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

১) জন্মসনদে যেই তথ্য আছে তা ভুল। ভুল তথ্য থাকলে কি তা সংশোধন করবো না কি বাতিল করবো?

উত্তরঃ যদি সংশোধন করা সম্ভব হয় তাহলে অবশ্যই জন্মনিবন্ধন সংশোধন করবেন। 

২) আমার দুইটি / তিনটি / চারটি জন্মসনদ আছে, কয়টি বাতিল করতে হবে? 

উত্তরঃ মূল একটি রেখে বাকি সবই বাতিল করতে হবে।

৩) নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে আবেদনপত্র প্রিন্ট করে কার্যালয়ে দাখিল করতে না পারলে কি করবো?

উত্তরঃ এক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব কার্যালয়ের সাথে যোগাযোগ করুন ও কারণ বুঝিয়ে বলুন। পরবর্তীতে তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করুন।

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button