কৃষিকৃষি ব্যবসাপেশাব্যবসা

দেশি মুরগি পালন করে হোন স্বাবলম্বী

দেশি মুরগি, স্বাদ ও মানে যা নিঃসন্দেহে অনন্য। বর্তমান বাজারে মুরগির কো্নো অভাব না থাকলেও দেশি মুরগির চাহিদা চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলাতেই রয়েছে অসংখ্য মুরগির খামার। কিন্তু সেসব খামারের সিংহভাগেই পালন করা হয় ব্রয়লার অথবা সোনালী জাতের মুরগি। কিন্তু বাঙালীর পছন্দের তালিকায় এ দুটোকে অনেক পেছনে ফেলে দেশি মুরগিই রয়েছে শীর্ষে। তাই বাজারে ব্রয়লার মুরগির অভাব না থাকলেও, চাহিদার তুলনায় দেশি মুরগির যোগানটা নিতান্তই কম। ফলে দামটাও অনেক বেশি। আর ঠিক সে কারণেই তৈরি হয়েছে মস্ত বড় সুযোগ। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সঠিক পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন করে আপনিও দারুণ লাভবান হতে পারেন। 

সূচিপত্রঃ

দেশি মুরগি পালনের সুবিধাসমূহ 

ইতোমধ্যেই বলেছি ব্রয়লার ও সোনালী মুরগির কথা। কিন্তু সেগুলোর চেয়ে দেশি মুরগি পালন নিঃসন্দেহে অনেক বেশি সুবিধাজনক। ঠিক কী কী কারণে দেশি মুরগি পালন করা উচিত তাই ব্যাখা করছি এখনঃ-

চাহিদা

যেকোনো পণ্য উৎপাদন করে লাভবান হওয়ার পূর্বশর্ত হলো সেই পণ্যের চাহিদা থাকা। এদিক দিয়ে দেশি মুরগিকে সেরা বলা চলে। কারণ দেশি মুরগির চাহিদা আকাশচুম্বী। কৃষিজাতীয় ব্যবসাগুলো‘র মধ্যে বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত হতে উচ্চবিত্ত সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের পছন্দের তালিকাতেই দেশি মুরগির নামটা আগে আসে। ঘরে ঘরে এখন ব্রয়লার মুরগি খাওয়ার চল শুরু হলেও যেকোনো অনুষ্ঠানে অথবা ঘরে অতিথি আসলে দেশি মুরগির যেনো কোনো বিকল্প নেই। আবার অনেক মানুষ তো ব্রয়লার মুখেই তুলতে পারেন না। তাদের একমাত্র ভরসা দেশি মুরগি। কিন্তু দেশি মুরগির যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে তার তুলনায় যোগান একেবারেই কম। বর্তমানে বাজারে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা সোনালী মুরগিকে দেশি মুরগি বলে বিক্রি করে থাকে। সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়ে তা কেনেও। কিন্তু ভালো দেশি মুরগির সন্ধান পেলে অনেক ক্রেতাই বেশি দাম দিতে পরোয়া করবে না। তাই এটি পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের বাজারে দেশি মুরগির চাহিদার কোনো কমতি নেই। 

স্বল্প পুঁজি

দেশি মুরগি পালনের অন্যতম সুবিধা হলো এর জন্য স্বল্প পুঁজি হলেও চলে। যেকোনো ব্যবসা শুরু করতে অধিকাংশ মানুষ যেই সমস্যাটি মোকাবেলা করে থাকে তা হলো তাদের হাতে তাকে হয়তো স্বল্প পুঁজি। বাকি সব কিছু থাকা সত্ত্বেও শুধু পুঁজির অভাবে কত মানুষ যে বসে আছে তার ইয়ত্তা নেই। এক্ষেত্রে দেশি মুরগি পালন হতে পারে একদম আদর্শ একটি উপায়। কারণ দেশি মুরগি খুব স্বল্প অথবা মধ্যম পুঁজিতেও পালন করা সম্ভব। ব্রয়লার মুরগির ক্ষেত্রে এ সুবিধা নেই কারণ ব্রয়লার মুরগি পালনের জন্য নির্দিষ্ট কাঠামো লাগে। এছাড়াও আরো অনেক ক্ষেত্রে টাকা খরচ না করলে ব্রয়লার মুরগিকে বাঁচানো যায় না। কিন্তু দেশি মুরগি প্রকৃতিতে ছেড়ে পালন করা যায় বিধায় এতে বলতে গেলে তেমন কোনো পুঁজির দরকারই নেই। আবার অর্ধবদ্ধ পদ্ধতিতে পালন করলেও খুব বেশি পুঁজির প্রয়োজন পড়ে না। অর্থাৎ যারা কম টাকায় ব্যবসা শুরু করার কথা ভাবছেন অথবা ঘরের কাজের পাশাপাশি অন্য কিছু করে বাড়তি আয় করে নিতে চান তাদের জন্য দেশি মুরগি পালন আসলেই একটি আদর্শ পন্থা।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা 

দেশি মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যান্য হাইব্রিড মুরগির চেয়ে বহু গুণে বেশি। ব্রয়লার মুরগি পালনে রোগ বালাই এক ভীষণ আতঙ্কের নাম। কত খামারি যে এর কারণে সর্বস্ব হারিয়েছেন তার হিসাব নেই। কারণ ব্রয়লার মুরগি তেমন রোগ প্রতিরোধী নয়। এছাড়াও ব্রয়লার মুরগির রোগ ছড়ায় খুব দ্রুত। একটি মুরগি অসুস্থ হলেই পুরো খামার অসুস্থ হয়ে যাওয়া খুবই নিয়মিত ঘটনা। সেদিক দিয়ে দেশি মুরগি অনেক নির্ভরযোগ্য। এরা মাঠে ঘাটে চরে খায় বলে এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বহুগুণে বেশি। যদিও তার মানে এই নয় যে দেশি মুরগির একেবারেই রোগ হয় না। কিন্তু দেশি মুরগি পালনে তুলনামূলকভাবে অনেক নিশ্চিন্তে থাকা যায়।  

দেশি মুরগির জাত

মুরগির জাত নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। মনে রাখতে হবে, যেহেতু এই মুরগিগুলো পুরোপুরি খোলা বা অর্ধ-বদ্ধ অবস্থায় পালন করা হবে তাই অবশ্যই এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হওয়া চাই। এছাড়াও এদের মাংস বা ডিম উৎপাদন ক্ষমতার দিকেও নজর রাখতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতের দেশি মুরগির সংখ্যা ২০ কোটিরও ওপরে।

এদেশে বহুল প্রচলিত তিনটি মুরগির জাত হচ্ছেঃ

১) কমনদেশি

২) গলাছিলা

৩) হিলি

কমনদেশিঃ

এদের তেমন কোন নির্দিষ্ট রং নেই। তবে লালচে বাদামি ও লালচে কালো রঙের মুরগিই বেশি দেখা যায়। এদের পা লোমহীন ও পায়ের নলা সাদাটে অথবা হলুদ হয়ে থাকে। কখনো কখনো কালোও হয়ে থাকে। এরা একক ঝুঁটি বিশিষ্ট এবং ডিমের রং সাদা অথবা গাড় বাদামি হয়ে থাকে। 

গলাছিলাঃ

এই জাতের মুরগির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এদের গলায় কোনো লোম নেই। এ কারণেই ‘গলাছিলা’ নামটির উৎপত্তি। এরা সাধারণত লালচে পালক বিশিষ্ট হয়ে থাকে। তবে কখনো কখনো কালো পালকও দেখা যায়। এদের পা থাকে লোমহীন এবং পায়ের নলা বেশিরভাগ সময়ই হলুদ হয়। তবে মাঝে মাঝে সাদা কালো নলা দেখা যায়। এদের ডিমের রং হালকা বাদামি। 

হিলিঃ

এই জাতের মুরগিগুলো আকারে অন্যান্য দেশি মুরগির চেয়ে কিছুটা বড় হয়। এই জাতের বেশিরভাগ মুরগির পালক সাদার মাঝে কালোর ছিটা যুক্ত হয়। এদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এদের হলদে চামড়া ও পালকহীন পা। ডিমের রং হালকা বাদামি।

উল্লেখ্য যে, উপরে বর্ণিত প্রত্যেকটি জাতই বেশ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন হয়। এছাড়াও এ দেশে ভালো জাতের মুরগি হিসেবে রোড আইল্যান্ড রেড ও ব্ল্যাক অস্ট্রালপ মুরগির সুনাম রয়েছে। 

দেশি মুরগি পালন পদ্ধতি 

পূর্বেই বলেছি দেশি মুরগি মূলত দুইভাবে পালন করা যায়। একটি হলো সম্পূর্ণ ছাড়া অবস্থায়। একে ইংরেজিতে বলে স্ক্যাভেঞ্জিং (Scavenging) আরেকটি হলো আধা ছাড়া- আধা বদ্ধ অবস্থায়। এই প্রক্রিয়াটির ইংরেজি নাম হলো সেমি-স্ক্যাভেঞ্জিং (Semi-Scavenging)। এই দুটি প্রক্রিয়াকে দুই ভাগে ভাগ করে নেওয়া যায়। 

১) সনাতন পদ্ধতি।

২) উন্নত পদ্ধতি।

সনাতন পদ্ধতি হলো সম্পূর্ণ ছাড়া অবস্থায় দেশি মুরগি পালন। একে সনাতন বলার কারণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাংলাদেশে এই পদ্ধতিতেই দেশি মুরগি পালিত হয়ে আসছে। এই প্রক্রিয়ায় দেশি মুরগি তার খাবারের প্রায় পুরোটাই নিজে খুঁজে নেয়। এতে করে মুরগিগুলো তাদের মালিকের ওপর শুধু বাসস্থানের ব্যাপারে নির্ভরশীল থাকে। অপরদিকে উন্নত পদ্ধতি অর্থাৎ আধা ছাড়া-আধা বদ্ধ পদ্ধতিতে দেশি মুরগির পালনকারীই মুরগিকে প্রয়োজনীয় খাবারের জোগান দেয় এবং একইসাথে আনুষাঙ্গিক সকল কিছুর খেয়াল রাখে। 

প্রথমে আমরা সনাতন পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন নিয়ে আলোচনা করবো। 

সনাতন পদ্ধতি

সনাতন পদ্ধতি হলো আদি ও অকৃত্রিম পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে দেশি মুরগির জন্য শুধু ঘর বানিয়ে দিলেই হয়। নিয়ম করে ভোরবেলা ঘরের দরজা খুলে দিলে ও সন্ধ্যার পরে দরজা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া এতে খুব একটা দায়িত্ব নেই। এ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যগুলোঃ

বাসস্থানঃ

সনাতন পদ্ধতিতে বাসস্থানের কোন ধরা বাঁধা নিয়ম নেই। গ্রামে প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরেই কাঠ, সিমেন্ট অথবা বাঁশ দিয়ে ছোট ঘর বানিয়ে দেওয়া হয় যেখানে হাঁস-মুরগি একত্রে বসবাস করে। অনেক গৃহস্থ আবার শলার তৈরি খোপেও মুরগি রাখেন। এ পদ্ধতিতে মুরগির বাসস্থানে আলো বাতাস ঢোকে না ও বাসস্থান স্যাঁতসেতে ও নোংরা থাকে। এমন বাসস্থান লালন-পালনের জন্য আদর্শ নয়। আবার অনেক খামারি মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে কাঠ বা বাঁশ দিয়ে আরেকটু ভালো ঘর বানান। সেক্ষেত্রে ঘরের মাপ হতে পারেঃ

লম্বাঃ ৫ফুট

প্রস্থঃ ৪ দুট

উচ্চতাঃ ৩.৫ ফুট 

খাদ্যঃ

সনাতন পদ্ধতিতে খাদ্য অনেকটাই অসুষম। এ পদ্ধতিতে গ্রামের অনেক পালনকারী ঘরের পড়ে থাকা এঁটো ভাত-তরকারি, সবজি ইত্যাদি দিয়ে থাকে। কেউ কেউ ধান গম ইত্যাদি দিয়ে থাকে। মুরগি সকাল বেলা সেসব খাবার খেয়ে বাকি সারাদিন খুটে খুটে অন্যান্য খাবার খুঁজে খায়। এসব খাবারের মধ্যে পোকামাকড় অন্যতম। সম্পূর্ণ সনাতন প্রক্রিয়াতে মুরগির পুষ্টি চাহিদা অনেক সময়ই মিটে না। তাই খোলা পদ্ধতিতে পালন করলেও খাবারের জন্য মুরগিদের পুরোপুরি প্রকৃতি নির্ভর না করে কিছু সুষম খাদ্য সরবরাহ করা উচিত। 

স্বাস্থ্যঃ

সনাতন পদ্ধতিতে পালিত মুরগি সম্পূর্ণ খোলা পরিবেশে বড় হয় বলে এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হয়। আবার একইসাথে এদের রোগের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনাও অনেক বেড়ে যায়। এছাড়াও বনে বাদাড়ে ঘুরে বিভিন্ন প্রাণী যেমনঃ কুকুর, বিড়াল, গুইসাপ, চিল ইত্যাদির আক্রমণে অনেক বাচ্চা এমনকি বড় মুরগিরও মৃত্যু হয়। সম্পূর্ণ খোলা পদ্ধতিতে পালিত মুরগিগুলোর ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সম্ভব হয় না বলে এসব আক্রমণ রোধেরও তেমন কোনো উপায় থাকে না।

সনাতন পদ্ধতিতে পালনের সুবিধাসমূহ

সনাতন পদ্ধতির সবচেয়ে বড় যেই সুবিধাটি তা হলো এর দারুণ কম ব্যয়। এই পদ্ধতিতে মুরগি পালন করতে চাইলে একদমই স্বল্প পুঁজি নিয়ে তা করা সম্ভব। যেহেতু খাবারের জন্য মুরগিগুলো অনেকটা প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল তাই খরচ প্রায় হয়না বললেই চলে। একইসাথে মুরগিগুলো নিজেরাই চরে খায় বলে এদের খুব বেশি পরিচর্যার দরকার হয় না। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে শুধু ব্যয় কম তা নয়। পরিশ্রমও কম। 

সনাতন পদ্ধতির অসুবিধাসমূহ 

সনাতন পদ্ধতির সুবিধা সম্পর্কে তো ধারণা পেয়েছেন। এবার এর অসুবিধা সম্পর্কে জানা যাক। এই পদ্ধতির মূল কথা হলোঃ “কম ব্যয়, কম আয়”। 

১) এই পদ্ধতিতে লাভ খুব একটা বেশি হয় না। 

২) মুরগিগুলো সুষম খাদ্যের অভাবে প্রায়ই অপুষ্টিতে ভোগে। ফলে মাংস কম হয় এবং ডিম দিতে দেরি হয়। 

৩) ছোট বাচ্চাকে খুদ, কুড়ে ইত্যাদি শক্ত খাবার খেতে দেওয়া হয়। কিন্তু এসব শক্ত খাবার তাদের খেতে অসুবিধা হয় বলে অনেক বাচ্চা অপুষ্টিতে ভোগে। এমনকি মারাও যায়। 

৪) গ্রামে গ্রামে একটি প্রচলিত ধারণা হলো উম বা তা দেওয়ার সময় মুরগি খাদ্য গ্রহণ করে না। বাস্তবে এর বিপরীত। তা দেওয়ার সময় মুরগির পর্যাপ্ত খাদ্যের জোগান না থাকলে পরবর্তীতে ডিম দিতে অনেক দেরি হয়। 

৫) মা ও বাচ্চা মুরগিকে বেশি সময় একসাথে রাখা হয় বলে পরবর্তীতে ডিম পাড়তে অনেক সময় নেয়। 

৬) আশেপাশের পরিবেশে চরে খাওয়ার সময় অন্যান্য পশুর আক্রমণে অনেক বাচ্চা মুরগি মারা যায়।  

উন্নত পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন

আধা আবদ্ধ-আধা ছাড়া পদ্ধতিকেই উন্নত পদ্ধতি বলে। সনাতন পদ্ধতির সাথে এর মৌলিক পার্থক্য হলো দেশি মুরগির বাসস্থান, খাবার ও খরচের দিক দিয়ে। এছাড়াও সামগ্রিকভাবেই উন্নত পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন সনাতন পদ্ধতির চেয়ে আলাদা। এ পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন করতে হলে খরচ তুলনামূলক বেশিই পড়বে। কিন্তু একইসাথে মাংস ও ডিমের উৎপাদন বাড়বে কয়েকগুণ। ফলে লাভও হবে অনেক। অর্থাৎ আপনি যদি বাণিজ্যিকভাবে দেশি মুরগি পালন করতে চান তবে উন্নত পদ্ধতিতেই পালন করা শ্রেয়।

উন্নত পদ্ধতিতে পালনের কারণসমূহ 

আগেই বলেছি উন্নত পদ্ধতির সাথে সনাতন পদ্ধতির পার্থক্য মূলত বাসস্থান, খাবার ও খরচের মধ্যে। কিন্তু আরো একটি দিক রয়েছে যা বিপুল পার্থক্য গড়ে দেয়। তা হলো মুরগির উৎপাদনচক্র। সনাতন পদ্ধতিতে একটি উৎপাদনচক্র সম্পূর্ণ হতে সময় লাগে ১৩৫-১৫০ দিন। যা অত্যধিক বেশি। নিয়ম মেনে উন্নতভাবে দেশি মুরগি পালন করলে তা ৫০-৬০ দিনেই নামিয়ে আনা সম্ভব। ফলে বছরে তিনটি উৎপাদন চক্রের বদলে ছয়টি উৎপাদনচক্র করা সম্ভব। যা ডিম ও মাংসের পরিমাণকে করে তুলবে প্রায় দ্বিগুণ। ঠিক এ কারণেই এই পদ্ধতি বাণিজ্যিকীকরণের জন্য আদর্শ। আবার এতে পরিশ্রম খুব বেশি তেমনও নয়। এককালীন একটি আদর্শ ঘর বানিয়ে নিলে এরপর থেকে দৈনিক ১-২ ঘন্টা কাজের মাধ্যমে আপনি খুব সহজেই মুরগি পালনের পুরো প্রক্রিয়াটি বজায় রাখতে পারবেন।

তাহলে চলুন জানা যাক কিভাবে করবেন উন্নত পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন।

বাসস্থানঃ

উন্নত পদ্ধতিতে বাসস্থান নির্মাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া। সাধারণত হাস মুরগির খোপগুলো বদ্ধ ও স্যাঁতসেতে হয়। কিন্তু উন্নত পদ্ধতিতে সেরকম হলে মোটেও চলবে না। প্রথমেই আসা যাক খোপ নির্মাণের জন্য কী কী ব্যবহার করবেন তার ব্যাপারে। সাধারণ বাঁশ-কাঠ, তাল, নারিকেল অথবা সুপারি পাতা এসব ব্যবহার করেই ঘর নির্মাণ করতে পারবেন। খেয়াল রাখবেন ঘরটি যেনো নিরাপদ ও উঁচু স্থানে হয়। খোপের আশেপাশের দেয়াল দিয়ে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস আসার ব্যবস্থা করুন। ঘরটির সাধারণ বৈশিষ্ট্যঃ

দৈর্ঘ্যঃ ৬ ফুট

প্রস্থঃ ৪ ফুট

উচ্চতাঃ সাড়ে ৩ ফুট

খোপটিতে মোট তিনটি স্তর বা তলা থাকবে। ঘর হবে মোট ৮ টি। প্রথম তলায় থাকবে বড় বড় দুটি ঘর। একটি দুই ফুট চওড়া অপরটি চার ফুট চওড়া। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় সমান আকারের তিনটি করে মোট ছয়টি ঘর থাকবে। প্রত্যেকটি ঘর এক ফুট উঁচু ও দুই ফুট চওড়া হবে। প্রত্যেকটি ঘরেই দরজা থাকবে ও দরজায় তালা দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রতিটি খোপে অবশ্যই খাবার ও পানির আলাদা আলাদা পাত্র স্থাপন করতে হবে। একইসাথে প্রত্যেকটি ঘরের মেঝে শুকনো লিটার দিয়ে ঢেকে দিতে হবে যাতে মুরগির বিষ্ঠা মেঝেতে লেপটে না যায়। কিছুদিন পর পর লিটার শক্ত হয়ে গেলে সেগুলো পরিষ্কার করে নতুন লিটার দিতে হবে। এক্ষেত্রে বাজার থেকে কিনে লিটার ব্যবহার করতে পারেন। আবার কাঠের গুঁড়া বা তুষ জোগাড় করতে পারলে তা দিয়েও কাজ চালিয়ে নিতে পারেন। এছাড়াও শীতকালে যেনো মুরগির ঠান্ডা না লাগে তাই পুরো খোপ ঢেকে দেওয়ার মতো চটের ব্যবস্থা থাকতে হবে। 

খোপ ব্যবস্থাপনাঃ

উন্নত পদ্ধতিতে যেহেতু একটি খোপে মোট ৮টি ঘর বানানো হয় তাই ঘরগুলোর কার্যকারীতা সম্পর্কেও জেনে নেওয়া উচিত। 

প্রথম তলাঃ- প্রথম তলার সবচেয়ে বড় ঘরটি হলো প্রাপ্তবয়স্ক মুরগির ঝাঁক রাখার জন্য। প্রথম তলার ছোট ঘরটি হলো ডিমে তা দেওয়ার ঘর। মুরগির ডিমে তা দেওয়ার জন্য নিরিবিলি পরিবেশ প্রয়োজন। তাই এই ঘরে তা দেওয়ার আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে। 

তৃতীয় তলাঃ- তৃতীয় তলার সর্ব বাম অথবা সর্ব ডানের ঘরটি হলো ডিম ফোটার পর ৩০ দিন বয়সী বাচ্চা রাখার জন্য। বাচ্চার সংখ্যা বেশি হলে ধীরে ধীরে বাকি ঘরগুলো পূরণ হবে। 

দ্বিতীয় তলাঃ- দ্বিতীয় তলার ঘরগুলো হলো ৩০ দিন থেকে ৭০ দিন বা তার বেশি বয়সী মুরগি রাখার জন্য। 

মুরগির সংখ্যাঃ

উন্নত পদ্ধতিতে একটি খোপে ১০-১২ টি মুরগির ঝাঁক রাখুন। প্রথমেই ১০-১২ টি মুরগি জোগাড় করতে না পারলে এর কমেও শুরু করতে পারেন। তবে এক ঘরে ১৫-১৬টির বেশি মুরগি রাখবেন না। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে আরো বড় ঘর বানিয়ে নিন অথবা বেশি সংখ্যক ঘর বানান। প্রতি ১০-১২টি দেশি মুরগির জন্য ১-২টি মোরগ রাখবেন। এক্ষেত্রে ভালো জাতের মোরগ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত ৪০০-৬০০ গ্রাম ওজনের মোরগ দিয়ে শুরু করা যায়। 

খাবারের পরিমাণঃ

উন্নত পদ্ধতিতে পালন করতে হলে অবশ্যই সুষম খাবারের নিশ্চয়তা থাকা চাই। চাইলে এ খাবার বাজারে কিনতে পাওয়া যাবে। আবার গম, গমের ভুষি, ভুট্টা, খুদ, কুড়া, শুটকি গুঁড়া, ঝিনুক বা শামুকের গুঁড়া, হাড় সিদ্ধ গুঁড়া, খৈল, কচি ও সবুজ শাকসবজি মিলিয়ে নিজেই বানিয়ে নিতে পারেন সুষম খাদ্য।

নিচে মুরগির ১ কেজি সুষম খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের তালিকা দেওয়া হলোঃ

১) গম বা ভুট্টা ভাঙা বা চালের খুদ-৪০০ গ্রাম            

২) চালের কুড়া (তুষ ছাড়া) ও গমের ভুষি-৩০০ গ্রাম 

৩) তিল অথবা সরিষার খৈল-১২০ গ্রাম 

৪) শুটকি মাছের গুঁড়া-১০০ গ্রাম 

৫) ঝিনুক বা ডিমের খোসার গুঁড়া-৭৫ গ্রাম 

৬) লবণ-৫ গ্রাম 

প্রতিটি মুরগিকে প্রতিদিন ৫০-৬০ গ্রাম সুষম খাবার দিতে হবে। সাথে ঘরের অন্য খাবার মিশিয়ে মাথাপিছু দৈনিক ৮০-৯০ গ্রাম খাবার খাওয়াতে হবে। কিছুদিন পর পর মুরগির ওজন মাপতে হবে। একটি ডিম পাড়া দেশি মুরগির ওজন সাধারণত ১,২০০-১,৫০০ গ্রাম থাকে। এর চেয়ে কম হলে খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে মুরগির ওজন ঠিক করতে হবে। এছাড়াও প্রতিদিন বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ বজায় রাখতে হবে। পুরোনো পানি ফেলে দিতে হবে। সাথে কচি ঘাস ও শাক-সবজি কুচি করে খাওয়াতে হবে। বড় দেশি মুরগিকে দৈনিক অন্তত ৫-৭ ঘন্টা চরতে দিতে হবে। 

ডিম সংগ্রহ ও তা দেওয়ার জন্য ডিম নির্বাচনঃ

স্বাভাবিকভাবেই ঝাঁকের দেশি মুরগিগুলো ৫-৬ মাস বয়স থেকে ডিম পাড়ার উপযোগী হবে। ডিম পাড়া শুরু করলে প্রতিদিন সকালে তাদের বিরক্ত না করে খুব সাবধানে ডিমগুলো সংগ্রহ করতে হবে এবং ডিমের ওপর ডিম সংগ্রহের তারিখ লিখে রাখতে হবে। এতে ডিমের বয়স হিসাবে রাখতে পারবেন। অতঃপর ডিমগুলো ঘরের সবচেয়ে নিরাপদ ও ঠান্ডা স্থানে তুষের পাত্রে রাখতে হবে। এ সময় ডিমের মোটা দিক উপরে রাখতে হবে কারণ ডিমের ভ্রুণ এই অংশেই থাকে এবং এ অংশের মাধ্যমেই শ্বাস নেয়। অতঃপর ডিমে তা দেওয়ার বয়স হলে একই বয়সী সকল ডিমের তা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে গরম কালে ৫-৬ দিন বয়সের ডিম এবং শীতকালে ১০-১২ দিন বয়সের ডিম তা দেওয়ার জন্য নির্বাচন করতে হবে। 

উমে আসা মুরগির পরিচর্যাঃ

উমে আসা মুরগি বলতে বোঝায় যেসব মুরগি ডিম পাড়ার পর ডিমে তা দিতে প্রস্তুত। ডিমে ভা্লোভাবে তা দেওয়ানোর জন্য এদের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। দেশি মুরগি নিরিবিলি ও কিছুটা অন্ধকার পরিবেশে তা দিতে পছন্দ করে। তাই তা দেওয়ার ঘরের চারপাশে কালো কাপড় টাঙিয়ে দিতে হবে। এছাড়াও মুরগিগুলোকে উকুন মুক্ত করে নিতে হবে। এজন্য বিষকাটালি পাতার রস মুরগির গায়ে মাখা যেতে পারে।

আবার ন্যাপথলিন গুঁড়া ছাইয়ের সাথে মিশিয়ে মুরগির গায়ে লেপে দিলেও উকুন মরে যাবে। এছাড়াও ‘সাইমিন ভেট’ নামক ওষুধ পানিতে মিশিয়ে মুরগিকে গোসল করালেও উকুন মারা যাবে। তবে এক্ষেত্রে মুরগির মুখ অবশ্যই বেঁধে নিতে হবে। নয়তো বিষাক্ত পানি খেয়ে মুরগি মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, একটি দেশি মুরগির উর্বরতা বয়সের সাথে সাথে কমতে থাকে। তাই নির্দিষ্ট সময় পর পর ডিম পাড়া মুরগি বদল করতে হবে। অর্থাৎ বয়স্ক মুরগি বিক্রি করে নতুন মুরগিকে জায়গা দিতে হবে। সাধারণত আড়াই বছর অবধি একটি দেশি মুরগি পূর্ণ উর্বরতার সাথে ডিম পাড়ে। তাই এ সময়ের পরে মুরগি বেচে দেয়াই শ্রেয়। 

ডিমে তা দেওয়ার ব্যবস্থাঃ

ডিমে তা দেওয়ার জন্য আলাদা মাটির বড় পাত্র অথবা বাঁশের ঝুড়ি নিন। এক্ষেত্রে তা নূন্যতম ১৮ ইঞ্চি চওড়া ও গোলাকার হতে হবে। যদি ঝুড়ি ব্যবহার করে থাকেন তবে প্রথমেই কাগজ দিয়ে নিন। অতঃপর পাত্রের নিচে ন্যাপথলিন মেশানো শুকনো ছাই দুই ইঞ্চি করে বিছিয়ে দিতে হবে। তার ওপর খড় বিছিয়ে ডিম রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে পাত্রের মুখ থেকে গভীরতা যেন ৮-১০ ইঞ্চির বেশি না হয়। তারপর ডিমের ওপর মুরগিকে উম দেওয়ার জন্য বসিয়ে দিতে হবে। পাত্রে এমন সংখ্যক ডিম রাখতে হবে যেন প্রত্যেকটি ডিম মুরগির পালকের নিচে ভালোভাবে থাকে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেই বিষয়টি তা হলো, অবশ্যই তা দেওয়ার পাত্রের সামনে খাবার ও পানির পাত্র রাখতে হবে। এতে করে মুরগি ডিমে তা দেওয়া অবস্থাতেই খেতে পারবে। এটি খুবই জরুরী কারণ বার বার খাওয়ার জন্য উঠলে তা দেওয়া ব্যহত হবে। আবার অনেক সময় মুরগি উঠতে চায় না। ফলে না খেয়ে শুকিয়ে যায়। যার ফলে পরবর্তীতে ডিম দিতে অনেক দেরি হয়। 

ডিমের উর্বরতা পরীক্ষা ও পরিচর্যাঃ

সব ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে না। যেসব ডিম থেকে ফোটে সেগুলোকে বলে উর্বর ডিম। উর্বর ডিম চিহ্নিত করতে ডিমে তা দেওয়ার এক সপ্তাহ পরে রাতের বেলা ডিমগুলো বের করে একটা একটা করে টর্চের আলো মেরে পরীক্ষা করতে হবে। এ সময় ডিমের ভেতর লাল শীরা দেখতে পেলে বোঝা যাবে যে ডিম উর্বর। কিন্তু দেখা না গেলে ধরে নিতে হবে যে ডিমটি থেকে বাচ্চা হবে না। তখন ডিমটি খেয়ে ফেলতে হবে অথবা বিক্রি করে দিতে হবে। এই পরীক্ষা সূর্যের আলোর দিকে ধরেও করা যায়। 

ডিমের আরেকটি পরিচর্যা হলো এর আর্দ্রতা বজায় রাখা। বাতাসে জলীয় বাষ্প কম থাকলে অনেক সময় বাচ্চা ডিমের ভেতরেই শুকিয়ে মারা যায়। তাই প্রচন্ড গরম বা প্রচন্ড শীতের সময় ডিমের আর্দ্রতা বজায় রাখতে কৃত্রিম প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে। তা দেওয়ার প্রথম দিন থেকে ১৮-২০ দিন অবধি কুসুম গরম পানিতে সুতি কাপড় ভিজিয়ে ভাল করে চিপে নিতে হবে। এরপর তা দিয়ে ডিম আলতো করে মুছে দিতে হবে। এছাড়াও আঙুলের সাহায্যে পানির ছিটে দিয়েও ডিমের আর্দ্রতা বজায় রাখা যায়। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন ডিম কোনভাবেই অতিরিক্ত ভিজে না যায়। 

বাচ্চার খাবার ও পরিচর্যাঃ

বাচ্চা জন্মনোর সাথে সাথেই মাকে বাচ্চা থেকে আলাদা করা উচিত নয়। বাচ্চা ফোটার পর অন্তত ৫-৬ ঘন্টা বাচ্চা ও মাকে তা দেওয়ার ঘরেই রাখুন ও উম পেতে দিন। অতঃপর মাসহ বাচ্চাদের তৃতীয় তলার একটি ঘরে স্থানান্তর করুন। তার পূর্বে ঘরের মেঝেতে চট পেতে দিন। বাচ্চা রাখার সাথে সাথেই পানির পাত্র স্থাপন করুণ এবং তার আধা ঘন্টা পরে খাবারের পাত্র স্থাপন করুন। প্রথম চারদিন সাধারণ পানি না দিয়ে একটি মিশ্রণ খাওয়াতে হবে। এক লিটার পানিতে এক গ্রাম রেনামাইসিন পাউডার অথবা যে কোনো টেট্রাসাইক্লিন জাতীয় ওষুধ, এক গ্রাম ডব্লিউএস (WS) ভিটামিন, ১০ গ্রাম আখের গুড় বা চিনি মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করুন।

প্রথম ৩-৪ দিন বাচ্চাদের শুধু এই মিশ্রণ পান করালেই চলবে। প্রথম দিন খাদ্য হিসেবে প্রত্যেক ছানার জন্য ৩-৪ গ্রাম সুষম খাবার দিতে হবে। এক্ষেত্রে ঘরে তৈরি সুষম খাবার দিতে পারেন আবার বাজারের ‘ব্রয়লার স্টার্টার’ খাবারও দিতে পারেন। অতঃপর প্রথম সপ্তাহ জুড়ে মাথাপিছু ১০ গ্রাম হারে খাবার দিতে হবে। প্রতি সপ্তাহে খাবারের পরিমাণ ৫-৭ গ্রাম হারে বাড়াতে হবে। বাচ্চার বয়স চার সপ্তাহ হলে ভাত, গমের গুঁড়া, ভুট্টা ভাঙা, খুদ ইত্যাদি সুষম খাবারের পাশাপাশি অল্প অল্প খাওয়াতে হবে। একইসাথে দিনে ১-২ ঘন্টা বাইরে হাঁটাচলা করতে দিতে হবে। এছাড়াও চার সপ্তাহ পর বাচ্চাকে তৃতীয় তলার একদম বাচ্চা মুরগির কক্ষ থেকে সরিয়ে দ্বিতীয় তলার মাঝারি মুরগির কক্ষে নিয়ে আসুন। এভাবে পর্যায়ক্রমে ঘরগুলো ব্যবহার করুন। 

বাচ্চা থেকে মা কে আলাদা করাঃ

বাচ্চা থেকে মা কে আলাদা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। মুরগির উৎপাদন চক্রের সময়কাল কমিয়ে আনার জন্য এটি অপরিহার্য। বাচ্চার বয়স গরমকালে ৫-৭ দিন এবং শীতকালে ১০-১২ দিন হলে মা মুরগিকে বাচ্চা থেকে আলাদা করে ফেলতে হবে। শুধু আলাদা করলেই চলবে না; সম্পূর্ণ চোখের আড়ালে রাখতে হবে। এটি না করা হলে মা ও বাচ্চা মুরগি উভয়েই চেঁচামেচি করবে ও খাবার খাবে না। ফলে উভয়েরই স্বাস্থ্যহানি হবে। তাই নির্দিষ্ট সময়ের পরে মা মুরগিকে খোপের প্রথম তলায় বড় মুরগি রাখার ঘরে নিয়ে যান ও প্রতিদিন ৪০-৫০ গ্রাম হারে সুষম খাবার দিতে থাকুন। ১০ দিন পর থেকে ঘরের সাধারণ খাবার দিলেও চলবে। খেয়াল রাখতে হবে যেনো আলাদা রাখার প্রক্রিয়া মা মুরগি আবারো ডিম দেওয়ার আগ অবধি বজায় থাকে। নাহলে ডিম পেতে অনেক দেরি হবে। 

খাদ্য থেকে মাংসে রুপান্তরের অনুপাতঃ

খাদ্য থেকে মাংসে রুপান্তরের অনুপাত এমন একটি জিনিস যা বেশিরভাগ দেশি মুরগি পালনকারীই তেমন গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু ব্যবসা লাভজনক রাখতে এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সকল প্রাণীই তার গৃহিত খাদ্যকে ওজনে রূপান্তর করে। বাচ্চা মুরগিও তার গৃহিত খাদ্যকে মাংসে রুপান্তর করে এবং তার একটি অনুপাত আছে। অনুপাতটি হলো ৩ঃ১ । অর্থাৎ প্রতি তিন কেজি খাদ্য খাওয়ালে একটি মুরগির ওজন ১ কেজি বাড়লে সেটি হবে আদর্শ অনুপাত। কিন্তু সবসময় এই অনুপাত বজায় থাকে না। বিশেষত দেশি মুরগির বাচ্চা ৭০ দিন বয়স অবধি খাদ্যকে আদর্শ অনুপাত অনুযায়ী মাংসে রূপান্তর করতে পারে। তাই দেশি মুরগির বাচ্চা ৭০ দিন হওয়ার পরেই বিক্রির উপযোগী হয়ে ওঠে। বাচ্চাগুলোকে পালার উদ্দেশ্য না থাকলে ৭০ দিনের পরে বিক্রি করে দেওয়া উচিত। 

স্বাস্থ্যবিধিঃ

দেশি মুরগির স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে বলতে হলে প্রথমেই বলতে হবে বাচ্চার সুস্থতা বিধানের কথা। কারণ মুরগির বাচ্চা অত্যন্ত দুর্বল এবং এদের রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। তাই প্রত্যেকবার কোনো ঘরে বাচ্চা উঠানোর আগে ঘরটি ব্লিচিং পাউডার অথবা ফিনাইল দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এছাড়াও নিয়মিত লিটার পরিষ্কার করতে হবে। মুরগিকে চোখে চোখে রাখতে হবে এবং অন্য কোন প্রাণীর সংস্পর্শে আনা যাবে না। নিজেকেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে ও বাচ্চাকে সময়মতো টিকা দিতে হবে। এক্ষেত্রে গুটি বসন্তের টিকা অতি দ্রুত দিতে হবে। 

দেশি মুরগি সাধারণত যেসব রোগের শিকার হয় সেগুলো হলো রাণীক্ষেত, গুটি বসন্ত, ক্রিমি, ককসিডিওসিস (রক্ত বমি), কলেরা, সালমোনেলা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। এর মাঝে রাণীক্ষেত ও বসন্ত ভাইরাসজোনিত রোগ। এর কোনো প্রতিকার নেই। প্রতিরোধই একমাত্র উপায়। অন্যান্য রোগ গুলোর চিকিৎসা থাকলেও সময়মতো টিকা দিয়ে প্রতিকার করাই শ্রেয়। দেশি মুরগিকে রোগমুক্ত রাখতে এর বাসস্থান সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে। বিশেষত কৃমি হওয়ার প্রধান কারণ অপরিষ্কার ঘর। এর পাশাপাশি যথাসম্ভব জীবাণু থেকে নিরাপদে রাখার চেষ্টা করতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ি টিকা দিতে হবে এবং মুরগি রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসা করাতে হবে। রোগাক্রান্ত মুরগি দ্রুত আলাদা খোপে সরিয়ে ফেলতে হবে। 

লাভের হিসাব ও শেষকথা

লেখাটির একদম শুরুতেই এদেশের বাজারে দেশি মুরগির চাহিদার কথা বলেছি। ব্রয়লার মুরগির কেজি যেখানে ১২০-১৩০ সর্বোচ্চ ১৬০ এর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে, সেখানে দেশি মুরগির কেজি কম করে হলেও ৪৫০ টাকা। কখনো সে আবার আরো বেড়ে ছুঁয়ে ফেলে ৫৫০ টাকাও। অন্যদিকে ব্রয়লার মুরগির তুলনায় এর উৎপাদন ব্যয় যে খুব বেশি এমনটিও না। অর্থাৎ স্বল্প খরচে অনেক বেশি পরিমাণ লাভ করা সম্ভব এই দেশি মুরগি থেকে। এর ডিমও বিক্রি হয় বেশ ভাল দামে। তাই স্বল্প খরচে ও সীমিত পরিশ্রমে লাভের মুখ দেখতে চাইলে, আজই শুরু করতে পারেন দেশি মুরগি পালনের পরিকল্পনা।

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button