আইন কানুনবাংলাদেশ

থানায় মামলা করার নিয়ম (বিস্তারিত)

মামলা-মোকদ্দমা। গ্রাম থেকে শুরু করে শহর, সকল অঞ্চলের মানুষের কাছেই অত্যন্ত পরিচিত এই শব্দ দুইটি। সমাজ সৃষ্টির শুরু থেকেই সমাজবদ্ধ মানুষকে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়েছে। আর ধীরে ধীরে সভ্যতা সৃষ্টির সাথে সাথে সে সকল নিয়ম-কানুন আইনে পরিণত হয়েছে। অন্য সকল স্বাধীন দেশের মতই বাংলাদেশেরও নির্দিষ্ট আইন রয়েছে। আর এ আইনের নানা ধারা-উপধারা অনুযায়ীই বিচার প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়ে থাকে। মামলা হলো কোনো ঘটনায় আদালতের কাছে বিচার চাওয়ার প্রক্রিয়া। অপরাধের যেমন ধরন রয়েছে, ঠিক তেমনই মামলা ও আদালতেরও ধরন রয়েছে। সকল অপরাধের জন্য সকল মামলা হয় না। এছাড়াও আইনের মারপ্যাঁচে মামলা করার প্রক্রিয়াও বেশ জটিল। সেই জটিল প্রক্রিয়াটিকেই সামগ্রিক ভাবে কিছুটা সহজ রুপে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এই লেখাটিতে। 

সূচিপত্রঃ

এফআইআর – মামলা করার প্রথম ধাপ 

এফআইআর (FIR) এর পূর্ণরুপ হলো ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট। অনেকেই একে জিডির সাথে গুলিয়ে ফেলে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, জিডি ও এফআইআর এক নয়। জিডি ও এফআইআর করার প্রক্রিয়া অনেকটাই ভিন্ন। এফআইআর কে বাংলাতে বলে এজাহার। কোনো ব্যক্তি বা বস্তু হারানো গেলে তবে তাতে থানায় জিডি করতে হয়। কিন্তু কোনো কিছু চুরি গেলে বা কোনো গুরুতর অপরাধ ঘটলে করতে হয় মামলা।

যিনি মামলা করেন, তাকে বলে বাদী। অপরদিকে যার নামে মামলা হয়, তাকে বলে বিবাদী। আপনার বা আপনার প্রতিবেশী অথবা নিকট আত্নীয়ের সাথে কোনো অন্যায় ঘটলে আপনি বাদী হয়ে মামলা করতে পারেন। এছাড়াও হত্যার মতো গুরুতর অপরাধ ঘটলে কেউ মামলা না করলেও পুলিশ নিজেই বাদী হয়ে মামলা দায়ের করতে পারে।

মামলার ধরন

মামলার অসংখ্য ধরন রয়েছে। তবে মামলা করার কারণের ওপর ভিত্তি করে সকল মামলাকে প্রধানত দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়।

  • ফৌজদারি মামলা 
  • দেওয়ানি মামলা

আবার কোথায় মামলাটি করা হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করেও মামলাসমূহকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।

  • জিআর মামলা (GR Case)
  • সিআর মামলা (CR Case)

জিআর মামলা এর পূর্ণরুপ হলো জেনারেল রেজিস্টার মামলা। যে সকল মামলা সাধারণ ভাবে থানায় এফআইআর হিসেবে রজু করা হয় সেগুলোকে বলে জিআর বা জেনারেল রেজিস্টার মামলা।

আবার সিআর মামলা এর পূর্ণরুপ হলো কমপ্লেইন্ট রেজিস্টার মামলা। বাংলায় একে বলে নালিশী মামলা। যেই মামলাগুলো থানায় নয় বরং আদালতে রজু করা হয় সেগুলোই সিআর মামলা। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট শুনানি করে মামলা গ্রহণ করেন অথবা প্রত্যাহার করেন। এ সময় তিনি বাদীর কাছ থেকে হলফপূর্বক জবানবন্দি গ্রহণ করে মামলা রজু করেন। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট এর কাছে যদি মামলা সন্দেহজনক মনে হয় তাহলে তিনি মামলা গ্রহণের পর পুলিশকে সে বিষয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারেন। তদন্তে যদি মামলার সত্যতার প্রমাণ না পাওয়া যায় তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট সেই নালিশী মামলা খারিজ করে দিতে পারেন।

এর বাইরেও মামলাকে অপরাধের মাত্রার ওপর ভিত্তি করেও মামলা দুই ভাগে ভাগ করা যায়।

  • আমলযোগ্য মামলা
  • আমল অযোগ্য মামলা

কিছু গুরুতর অপরাধ সংঘঠিত হলে পুলিশ ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতার করতে পারে। এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে যে ধরনের মামলা হয় সেগুলো আমলযোগ্য মামলা। এসব মামলার ক্ষেত্রে থানার অফিসার ইন চার্জ দ্রুত আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে থাকেন।

অপরদিকে কিছু লঘু অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ ওয়ারেন্ট ছাড়া সরাসরি গ্রেপ্তার করতে পারে না। এক্ষেত্রে তারা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে ৬০ দিনের মধ্যে প্রসিকিউশন রিপোর্ট (Prosecution Report) আদালতে জমা দেয়। একে নন-এফআইআর মামলাও বলা হয়ে থাকে। এর অপর নাম হলো নন-জিআর মামলা। যাকে আমরা বলতে পারি আমল অযোগ্য মামলা।

ফৌজদারি মামলা

ফৌজদারি মামলা এর ইংরেজি হলো ক্রিমিনাল একশন (Criminal Action) বা ক্রিমিনাল প্রসিডিংস (Criminal Proceedings)। একে ক্রিমিনাল কেসও বলে। মূলত ব্যাক্তি, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করে এমন অপরাধমূলক কার্যকলাপের কারণে যে মামলা হয় তাকে ফৌজদারি মামলা বলে।

যেসব কারণে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়

  • হত্যা
  • অপহরণ
  • ধর্ষণ
  • এসিড নিক্ষেপ 
  • অপহরণ
  • যৌতুক 
  • মাদক বহন কিংবা বিক্রয় 
  • অবৈধ অস্ত্র বহন কিংবা বিক্রয়
  • প্রতারনা কিংবা জালিয়াতি 
  • যৌতুক
  • মারপিট বা শারীরিক আঘাত
  • আত্নহত্যায় প্ররোচনা
  • পর্নোগ্রাফি 

এছাড়াও আরো নানা ধরনের গুরুতর অপরাধে ফৌজদারি মামলা বা ক্রিমিনাল কেস হয়ে থাকে। 

ফৌজদারি মামলা কোথায় করবেন?

জিডির মতো এফআইআর বা মামলার এজাহারও ঘটনা যেই থানার অধীনে হয়ে সেই থানাতেই করতে হয়। অর্থাৎ বাদীর বাড়ি অথবা বিবাদীর বাড়ি যেখানেই হোক না কেন, অপরাধ যেখানে ঘটবে মামলা সেই থানাতেই করতে হবে। এছাড়াও ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সরাসরি বিজ্ঞ আদালতে মামলা করা যায়। কোনো কারণে থানায় মামলা না নিলে একজন নাগরিক সরাসরি বিজ্ঞ আদালতে মামলা করতে পারেন। বিজ্ঞ আদালত বিষয়টি আমলে নিলে সংশ্লিষ্ট থানাকে এফআইআর গ্রহণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিতে পারেন। 

ফৌজদারি মামলার নিয়ম 

  • ফৌজদারি মামলা করতে হলে প্রথমেই চলে যাবেন ঘটনাস্থল যেই থানার অধীনে সেই থানাতে।
  • থানায় এফআইআর বা এজাহার দাখিল করুন।
  • নূন্যতম ২৪ ঘন্টা কোনো ব্যাক্তির খোঁজ পাওয়া না গেলে সে হারানো গেছে বলে থানায় জিডি করা যায়। কিছু ক্ষেত্রে জিডি থেকেও মামলায় হতে পারে।
  • মামলা দায়ের হলে প্রথমে তা ম্যাজিস্ট্রেট এর সামনে উপস্থাপন করা হয়।
  • ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থাপনের পরে মামলার তদন্ত শুরু হয়।
  • তদন্ত শেষে পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট / চার্জশীট দাখিল করে। তদন্তে বিবাদী নির্দোষ হলে ফাইনাল রিপোর্ট আর দোষী হলে চার্জশীট দেওয়া হয়।
  • অতঃপর নারাজী দরখাস্ত অথবা চার্জ শুনানী হয়ে থাকে। তদন্তে বিবাদী নির্দোষ প্রমাণিত হলে তার বিপক্ষে বাদী নারাজী দরখাস্ত প্রদান করতে পারেন। আবার বিবাদী দোষী প্রমাণিত হলেও বিবাদী নিজেও চার্জের শুনানি দাবি করতে পারেন।
  • শুনানি শেষে বিবাদী নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়ে থাকে। আর দোষী প্রমাণিত হলে চার্জশীট গঠন করা হয়।
  • চার্জশীট গঠনের পরে বিবাদী যদি নিজের দোষ স্বীকার করে তাহলে মামলা ওখানেই শেষ৷ দোষীকে যথোপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হয়।
  • বিবাদী দোষ স্বীকার না করলে এরপরে শুরু হয় যুক্তিতর্ক, শুনানী ও স্বাক্ষরগ্রহণের পালা। এই পর্বেই মূলত কাউকে দোষী কিংবা নির্দোষ নির্ধারণ করা হয়।
  • মামলার রায় অনুযায়ী সর্বশেষে বিবাদীকে শাস্তি প্রদান করা হয় অথবা বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
  • উল্লেখ্য যে বিবাদী গ্রেপ্তার হলে মামলার রায় হওয়ার আগ অবধি যেকোনো সময় জামিনের জন্য আবেদন করতে পারেন। জামিনের আবেদন গ্রহণ করা হলে তিনি জেলের বাইরে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। আর আবেদন খারিজ হলে জেলেই অবস্থান করতে হয়।

ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজাবলি 

বিভিন্ন ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে যে সকল কাগজপত্রের প্রয়োজন হতে পারে এবং তা কোথায় পাবেন তা নিচে উল্লেখ করা হলো।

মামলার ধরনপ্রয়োজনীয় কাগজাবলিপ্রাপ্তিস্থান 
খুন, আঘাত, আত্নহত্যার চেষ্টাফরেনসিক রিপোর্ট (Forensic Report), ময়না তদন্তের রিপোর্ট। 
ধর্ষণ মেডিকেল সার্টিফিকেট। সরকার অনুমোদিত ডাক্তার / হাসপাতাল। 
মানহানি প্রকাশনা। যেমনঃ পোস্ট, নিউজ, পোস্টার, অডিও, ভিডিও ইত্যাদি। প্রকাশনার মাধ্যম।
যৌতুককাবিননামা। কাজী অফিস। 
যৌতুকের জন্য নির্যাতন মেডিকেল সার্টিফিকেট। সরকার অনুমোদিত ডাক্তার / হাসপাতাল। 
প্রতারণাজাল দলিল, জাল সনদ, অবৈধ ভাবে তৈরি অঙ্গীকার বা বায়নানামা। – 
মারধোরমেডিকেল সার্টিফিকেট। সরকার অনুমোদিত ডাক্তার / হাসপাতাল।
কারাগারে আটক ব্যাক্তিদের মামলার ক্ষেত্রে এজাহার বা নালিশী প্রতিবেদনের নকল, চালান প্রতিবেদন, পুলিশ রিপোর্ট, মেডিকেল সার্টিফিকেট, আগের আদেশের কপি। যে কোর্টে মামলা, জিআর ও সেকশন। 

দেওয়ানি মামলা

কোনো বিষয়ে অধিকার বা ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য যে মামলা করা হয় তাকে দেওয়ানি মামলা বলে। বাংলাদেশে দেওয়ানি মামলার অধিকাংশই জমি-জমা সংক্রান্ত। 

যেসব কারণে দেওয়ানি মামলা দায়ের করা হয় 

  • সম্পত্তির দখল, অধিকার / মালিকানা নিয়ে মামলা। 
  • জমি-জমা সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলা। যেমন নামজারি (মিউটেশন), নামখারিজ। 
  • চুক্তি সংক্রান্ত মামলা। যেমনঃ টাকা উদ্ধারের মামলা, চুক্তির নানা শর্ত মানার জন্য মামলা। 
  • পারিবারিক মামলা। যেমনঃ সন্তান দত্তক নেওয়া, সন্তানের দায়িত্ব নেওয়া, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিবাহ বিচ্ছেদ, দেনমোহর আদায়, ভরণপোষণ আদায়, পারিবারিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার এসব সংক্রান্ত মামলা। 
  • দলিল সংশোধন বা বাতিল করার মামলা। 
  • স্থায়ী বা অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মামলা।

দেওয়ানি মামলা কোথায় করবেন?

দেওয়ানি মামলাগুলো থানাতে এফআইআর হিসেবে দায়ের করা যায় না। এগুলো সরাসরি আদালতে দায়ের করতে হয়। দেওয়ানি মামলার ধরন অনুযায়ী একেক ধরনের আদালতে তা দায়ের করা হয়ে থাকে। যেমন পারিবারিক বিরোধের ক্ষেত্রে মামলাগুলো হয় পারিবারিক আদালতের অধীনে। অপরদিকে জমি-জমা সংক্রান্ত মামলাগুলো জেলা জজ আদালত, অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, সহকারী জজ আদালত, সিনিয়র সহকারী জজ আদালত, যুগ্ন জজ আদালত, স্মল কজেস কোর্ট আদালতে নিষ্পত্তি করা হয়। কোন আদালতের অধীনে কি ধরনের মামলার বিচার হয় তা নিচে উল্লেখ করা হলো। 

  • স্মল কজেস আদালতঃ এই আদালতে ক্ষুদ্র মামলার বিচার হয়ে থাকে। এসব মামলার মূল্যমান পচিশ হাজার টাকা পর্যন্ত।
  • সহকারী জজ আদালতঃ এই আদালতে দেওয়ানি প্রকৃতির যেসব মামলার মূল্যমান সর্বোচ্চ ১৫ লক্ষ টাকা সেসব মামলার বিচার হতে পারে।
  • সিনিয়র সহকারী জজ আদালতঃ দেওয়ানি প্রকৃতির যেসব মামলার মূল্যমান ১৫ লক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ লক্ষ টাকা সেসব মামলার বিচার এই আদালতে হয়ে থাকে।
  • জেলা জজ আদালতঃ এই আদালতে রিভিশন এখতিয়ার, প্রবেট সংক্রান্ত বিষয়াদির বিচার হয়ে থাকে। এছাড়াও যেসব দেওয়ানি মামলার মূল্যমান সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা সেগুলোর বিচার এই আদালতে হয়ে থাকে।
  • অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতঃ জেলা জজ আদালত থেকে পাঠানো সকল মামলার বিচার এই আদালতে হয়ে থাকে।
  • যুগ্ন জেলা জজ আদালতঃ এই আদালতে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। এছাড়াও রিভিশন-জেলা জজ আদালত ও আপিল-জেলা জজ আদালত থেকে পাঠানো মামলার বিচার করা হয়ে থাকে। তার পাশাপাশি যেসব দেওয়ানি মামলার মূল্যমান নূন্যতম ২৫ লক্ষ টাকা থেকে অসীম সেসব মামলার বিচারও এই আদালতের অধীনে হয়ে থাকে।

দেওয়ানি মামলার নিয়ম 

  • দেওয়ানি মামলা করতে হলে প্রথমেই যেতে হবে সংশ্লিষ্ট আদালতে। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে আপনার মামলার বিষয়টি নিশ্চিতভাবে ওই আদালতের এখতিয়ারভুক্ত কিনা। যেমন ২৫ হাজার টাকার অধিক মূল্যের দেওয়ানি মামলা যদি কেউ স্মল কজেস আদালতে করে তাহলে তা ঐ আদালতের এখতিয়ারভুক্ত হয় না।
  • সংশ্লিষ্ট আদালতে যাওয়ার পর প্রথম ধাপই হলো সেরেস্তাদের কাছে মামলার লিখিত বিবরণ দাখিল করা। একে আরজি বলা হয়ে থাকে। আরজির সাথে ওকালতনামা, যে সকল কাগজাবলির ওপর মামলার ভিত্তি নির্ভর করে সেসব কাগজাবলি দাখিল করতে হয়। এছাড়াও কোর্ট ফি, প্রসেস ফি, সমন ও ডাকযোগে সমন জারির জন্য প্রয়োজনীয় প্রাপ্তিস্বীকারপত্র দাখিল করতে হয়।
  • মামলার আরজি বাদী নিজেই অথবা তার আইনজীবী দাখিল করতে পারেন। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে মামলার মূল্যমান সঠিক ভাবে নির্ধারিত হয়েছে কি না এবং কোর্ট ফি সঠিক ভাবে দেওয়া হয়েছে কি না।
  • কোর্ট ফি, প্রসেস ফি, সমন ইত্যাদি সঠিক না থাকলে অথবা দাখিলকৃত দলিল বা ওকালতনামা ইত্যাদির মধ্যে কোনো গাফিলতি থাকলে সেরেস্তাদার মামলাটি স্থগিত রাখতে পারেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই বাদী বা বাদীর আইনজীবিকে ভুলগুলো শুধরে দিতে হবে। কোনো কিছুতে কোনো সমস্যা না থাকলে তবেই সেরেস্তাদার মামলাটি আদালতের পেশকারের কাছে পাঠাবেন। অতঃপর পেশকার আনুষ্ঠানিকভাবে মামলাটি শুরু করবেন।
  • মামলা আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হলে আদালত থেকে বিবাদীর ঠিকানায় সমন পাঠানো হবে। এই সমন সরাসরি বা ডাকযোগে পাঠানো হতে পারে। সমন পেলে বিবাদীকে অবশ্যই এর জবাব দিতে হবে।
  • বিবাদী জবাব দাখিল করার পর দুই পক্ষের মধ্যে আপোষ মিমাংসা এর একটি সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাদী ও বিবাদী যদি আপোষ করতে না চায় তাহলে মামলার পরবর্তী ধাপ হিসেবে বিচার্য বিষয় গঠন হয়।
  • বিচার্য বিষয় গঠন হলে প্রথমে প্রাথমিক শুনানী হয়। প্রাথমিক শুনানীর পরে চূড়ান্ত শুনানী হয়। চুড়ান্ত শুনানি ও যুক্তি তর্কের পরে সবশেষে রায় ঘোষণা করা হয় ডিগ্রি জারি হয়। 

দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজাবলি

বিভিন্ন দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে যে সকল কাগজপত্রের প্রয়োজন হতে পারে এবং তা কোথায় পাবেন তা নিচে উল্লেখ করা হলো।

মামলার ধরনপ্রয়োজনীয় কাগজাবলিপ্রাপ্তিস্থান
মূল দলিল জমি কেনার সময় যে দলিল করা হয়। সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিস। 
বায়া দলিল মালিকানার ধারাবাহিকতা প্রমাণের জন্য আগের দলিলসমূহ। সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিস।
সি. এস. পর্চা / খতিয়ান ১৮৯০ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ভূমি জরিপের মাধ্যমে যে খতিয়ান প্রস্তুত হয়েছিল। জেলা ভিত্তিক এই জরিপ সম্পন্ন (১৮৯০-১৯৪০) হয়েছিল বলে এই খাতিয়ান কে ডি.এস.খতিয়ানও বলা হয়।ডেপুটি কালেক্টরের অফিস।
আর. এস. পর্চা / খতিয়ান সি.এস.জরিপে (১৮৯০-১৯৪০) তৈরী করা রেকর্ড অর্থাৎ খতিয়ান ও নকশার অন্তর্ভুক্ত সম্পত্তির ক্ষেত্রে এ দীর্ঘ সময়ে ভোগ দখলের জন্য যে পরিবর্তন হয় তা হালনাগাদ করার জন্য এ সংশোধন কার্যক্রম চালু হয়। ডেপুটি কালেক্টরের অফিস।
এস. এ. পর্চা / খতিয়ান ১৯৫৬ সাল হতে ১৯৬২ সালের পরিসরে একটি সংক্ষিপ্ত জরিপ কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। এই জরিপেকে এস.এ.জরিপ বলা হয়। এ জরিপে মালিক জমিদারের নাম, জমির বিবরণ সম্বলিত তালিকা প্রণয়ন এবং সকল মালিকের নামে হাতে লেখা খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়।ডেপুটি কালেক্টরের অফিস।
বি. এস. পর্চা / খতিয়ান বর্তমানে খতিয়ান হালনাগাদ করার জন্য যে জরিপ চলছেডেপুটি কালেক্টরের অফিস।
নামজারি খতিয়ানজমির মালিকানা পরিবর্তনের পর দাবীকারির নামে যে খতিয়ান সম্পাদিত হয়।সহকারী কমিশনার (ভুমি) 

অফিস।

ডি. সি. আরনামজারি হয়ে যাওয়ার পর যে কাগজ দেওয়া হয়।সহকারী কমিশনার (ভুমি) অফিস।
কাবিননামা বিবাহ রেজিস্ট্রির দলিল কাজী অফিস। 

কিভাবে সরকারি সহায়তায় মামলা পরিচালনা করা যায়?

দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় ক্ষেত্রেই মামলা চালানোর খরচে সরকারি সহায়তা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর আওতায় নানা ধরনের পরামর্শ ও সেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রদান করা হয়ে থাকে। তবে যাদের বাৎসরিক আয় ১ লক্ষ টাকার বেশি নয় শুধু তারাই এ সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। এ সুবিধা ভোগ করতে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের দ্বারস্থ হতে হবে। 

ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে আইনগত সহায়তা

  • জেলা লিগ্যাল এইড অফিস থেকে নানা বিষয়ে আইনগত তথ্য এবং পরামর্শ।
  • প্যানেল আইনজীবী থেকে আইনগত পরামর্শ। 
  • ফরিয়াদী বা অভিযুক্ত ব্যক্তি আইনজীবি নিয়োগে অপারাগ হলে সরকারি সহায়তায় তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে মামলা পরিচালনা। 
  • আসামীর হাজিরার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ। 
  • প্রয়োজনীয় কাগজ সংগ্রহ করার ব্যাপারে তথ্য বা পরামর্শ প্রাপ্তি। 
  • কারাগারে বন্দী আবেদনকারীর প্রয়োজনীয় নকল প্রাপ্তিতে সহায়তা। 
  • ডি. এন. এ. টেস্ট এর খরচ।

দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে আইনগত সহায়তা

  • প্যানেল আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে মামলা পরিচালনা।
  • লিগ্যাল এইড অফিসারের কাছ থেকে আইনগত পরামর্শ।
  • প্যানেল আইনজীবীর নিকট থেকে দলিল-পত্র পরীক্ষা ও আইনগত সহায়তা।
  • দরকারি নকল পাওয়া।
  • মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি।
  • আইনগত তথ্য সেবা।
  • ডি.এন.এ. টেস্টের খরচ।

সরকারি আইন সহায়তা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

সরকারি আইন সহায়তা চাইলেই যে কেউ পায় না। সেজন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল করতে হয়। নিচে কোন ধরনের মামলায় কি কি কাগজ লাগতে পারে তার একটি বিবরণ দেওয়া হলো।

জমি-জমা সংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রঃ

  • সি.এস. , এস.এ. , আর.এস. রেকর্ডের কাগজপত্র। 
  • খাজনার দাখিলা। 
  • DCR (Duplicate Carbon Recite)
  • দলিলের কপি (মূল / জাবেদা)।
  • নাম খারিজের কাগজ।
  • জাতীয় পরিচয় পত্র / জন্ম নিবন্ধন সনদ।

পারিবারিক মামলার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রঃ

  • কাবিন নামা।
  • তালাক নামা (প্রয়োজন হলে)। 
  • জাতীয় পরিচয় পত্র / জন্ম নিবন্ধন সনদ।
  • বাচ্চার জন্ম নিবন্ধন কার্ড (BRC) (প্রয়োজন হলে)। 
  • ২য় বিবাহের কাবিন নামা (প্রয়োজন হলে)।

ফৌজদারী / নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রঃ

কারাগারে আটক ব্যাক্তিদের সরকারি আইন সহায়তা পাওয়ার উপায়

কারাগারে আটক ব্যাক্তিদেরও সঠিক বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আর সেজন্যই তাদেরও সরকারি আইন সহায়তা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে জেলা কারাগার কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আইন সহায়তার জন্য আবেদন করতে হয়।

  • যেকোনো ফৌজদারি মামলায় কারাগারে আটক অভিযুক্ত ব্যাক্তি লিগ্যাল এইড প্যানেলের আইনজীবি নিয়োগের জন্য আবেদন করতে পারবে। এক্ষেত্রে তাকে জেলা কারাগারের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। 
  • কারাগার কর্তৃপক্ষ লিগ্যাল এইড অফিসকে অভিযুক্ত ব্যাক্তির নাম, পিতার নাম, হাজতী নম্বর, মামলা নম্বর, কোন আইনের অধীনে এবং কোন আদালতের মামলা এ সম্পর্কিত সকল তথ্য সরবরাহ করবে।
  • প্যানেল আইনজীবি নিয়োগ হলে লিগ্যাল এইড অফিসের সহায়তায় মামলার এজাহার কিংবা নালিশী দরখাস্তের নকল, চালান প্রতিবেদন, পুলিশি রিপোর্ট, মেডিকেল সার্টিফিকেট, পূর্বেকার আদেশের কপি (মিসকেস এর ক্ষেত্রে) সংগ্রহ করতে পারবেন। এগুলো তার মামলা পরিচালনায় সহায়ক হবে।
  • অভিযুক্ত ব্যক্তি আবেদন করার পর মামলার তদবিরকারী হিসেবে তার আত্নীয়রা প্যানেল আইনজীবি ও লিগ্যাল এইড অফিস থেকে মামলা সম্পর্কিত তথ্য জানতে পারবে। 

শেষকথা

সর্বোপরি মামলা দায়ের করা ও পরিচালনা একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। আশা করি এই জটিল প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে সহজে একটি সামগ্রিক ধারনা পেয়েছেন। আপনি যদি কোনো কারণে মামলা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তাহলে আইনজীবীর সহায়তায় নেওয়াটাই শ্রেয়। কারণ অভিজ্ঞ না হলে নিজে নিজে মামলা পরিচালনা করে সফল হওয়া কঠিন নয় বরং অসম্ভবই বলা চলে।

অনবরত জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

১) অভিযুক্ত ব্যক্তি শিশু হলে তার বিচার কোন আদালত করবে?

উত্তরঃ অভিযুক্ত ব্যক্তি শিশু হলে তার বিচার শিশু আদালতে হবে। উল্লেখ্য যে বিদ্যমান যেকোনো আইনে ভিন্ন যা কিছুই থাকুক না কেন, শিশু আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়ষ্ক সকলেই শিশু।

২) মামলার রায়ে সন্তুষ্ট না হলে কি করণীয়?

উত্তরঃ মামলার রায়ে সন্তুষ্ট না হলে বাদী বা বিবাদী যেকোনো পক্ষই উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারেন। 

৩) গ্রেপ্তারের পরে একজন ব্যক্তিকে পুলিশ কতক্ষণ হাজতে রাখতে পারে?

উত্তরঃ নিয়ম অনুযায়ী গ্রেপ্তারের ২৪ ঘন্টার মধ্যে অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে আদালতে হাজির করতে হবে। আদালতের নির্দেশ ব্যাতিত কাউকেই এর বেশি সময় হাজতে ধরে রাখা যাবে না। এছাড়াও কারণ বলা ব্যাতীত কোন ব্যক্তিকেই পুলিশ হাজতে রাখতে পারবেন না।

৪) গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি বাইরের কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন কি না?

উত্তরঃ আইন অনুযায়ী অবশ্যই পারবেন। প্রত্যেক নাগরিকেরই তার আইনজীবীর সহায়তা নেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। 

৫) একই অপরাধের জন্য একই ব্যক্তিকে কি একাধিকবার ফৌজদারিতে সোপর্দ করা যাবে?

উত্তরঃ না। একই অপরাধের জন্য একই ব্যক্তিক্তে একবারই ফৌজদারিতে সোপর্দ করা যাবে ও দন্ড দেওয়া যাবে। পরবর্তীতে আবার অপরাধ না করলে একই অপরাধের জন্য একাধিকবার শাস্তি প্রদানের কোনো সুযোগ নেই।

 

তথ্যসূত্রঃ

১। মামলার তথ্য ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (jessore.gov.bd)  

২। জি.আর (G.R) ও সি.আর (C.R) মামলা কি? | লিগ্যাল হোম (legalhome.org)

৩। মামলা করার আগে যা জানা জরুরি (banglanews24.com) 

৪। আদালতের এখতিয়ার | Judicial Portal (judiciary.org.bd) 

 

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button