টেকনোলজি

জিপিএস কি? জিপিএস সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য

জিপিএস (GPS) নেভিগেশন এবং ম্যাপিং সেক্টরে বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ। বর্তমান যুগে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের বদৌলতে জিপিএস প্রযুক্তি এখন মানুষের হাতে হাতে চলে এসেছে। আমরা এখন যেকোনো সময় আমাদের হাতে থাকা স্মার্টফোনে গুগল ম্যাপের সাহায্যে যেকোনো রাস্তা, জায়গা ও ঠিকানা দেখে নিতে পারি। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই না কেনো, জিপিএস এর মাধ্যমে আমরা নিজেদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারবো। বিভিন্ন কাজে জিপিএস ব্যবহার করলেও এটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য অনেকেই জানেন না। তাই, আজকের এই লেখাটির মাধ্যমে জিপিএস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।    

জিপিএস কি? 

GPS এর পূর্ণরূপ হলো Global Positioning System। এটি Global Navigation Satellite Systems (GNSS) এর একটি উপশাখা। জিপিএস বা গ্লোবাল পজিশনিং হলো একটি নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম যা ব্যবহারকারীদের অবস্থান, নেভিগেশন এবং সময় সংক্রান্ত তথ্য প্রদান করে। এর সাহায্যে আমরা পৃথিবীর যেকোনো স্থানে বসে আমাদের বর্তমান লোকেশন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে পারি। এই প্রযুক্তি দ্বারা যেকোনো বস্তুর অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব। এছাড়া, জিপিএস সিস্টেম স্যাটেলাইটের সাহায্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থানের দূরত্ব, সহজে পৌঁছানোর রাস্তা এবং কত সময় লাগতে পারে তা নির্ধারণ করতে পারে। জিপিএস “Trilateration” নামক প্রযুক্তির সাহায্যে কাজ করে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে স্যাটেলাইট দ্বারা গৃহীত ও প্রেরিত সিগন্যাল থেকে যেকোনো জায়গার তথ্য সম্পর্কে জানা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ তাদের সামরিক বাহিনীর জন্য সর্বপ্রথম জিপিএস সিস্টেম চালু করেছিল। পরবর্তীতে তা সাধারণ জনগনের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। 

জিপিএস এর ইতিহাস

১৯৫০ এর দশকে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেন যে Doppler Effect এর ফলে স্পুটনিক স্যাটেলাইট থেকে আসা রেডিও সিগন্যাল ব্যবহার করে ভূপৃষ্ঠ থেকে স্যাটেলাইটের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। এর উপর ভিত্তি করে ১৯৫৮ সালে Advanced Research Projects Agency (ARPA) “Transit” নামক পৃথিবীর প্রথম গ্লোবাল স্যাটেলাইট নেভিগেশন সিস্টেম তৈরি করে। ১৯৬০ সালে Transit এর প্রথম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয় এবং পরবর্তীতে এই ৬০ এর দশকে পুরো সময় গ্লোবাল স্যাটেলাইটের প্রযুক্তিগত উন্নতির দিকে মনোযোগ দেয়া হয়। ১৯৭৪ সালে প্রথম অ্যাট্মিক ক্লক সম্বলিত স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল, যার ফলে স্যাটেলাইটের তথ্যের নির্ভুলতা এবং লোকেশনের একটি ত্রি-মাত্রিক তথ্য প্রদানের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। 

১৯৭৪ সালের দিকে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ Navstar স্যাটেলাইট তৈরির মাধ্যমে জিপিএস সিস্টেম চালু করার কাজ শুরু করে। ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রথম Navstar স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল এবং একই বছরের শেষের দিকে আরও তিনটি Navstar স্যাটেলাইট উৎক্ষেপিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ এই জিপিএস সিস্টেমটি তৈরি করেছিল মূলত তাদের সামরিক বাহিনীর ব্যবহারের জন্য। ১৯৮০ সালে এটি সাধারণ ও বেসামরিক জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বিমান নেভিগেশন ও এয়ার ট্র্যাফিক সিস্টেমের উন্নতির জন্য ১৯৮৩ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান সর্বসাধারনের জন্য জিপিএস ব্যবহার করার অনুমতি প্রদান করেন। এরপর ১৯৮৯ সালে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য NAV 1000 নামক হ্যান্ডহেল্ড জিপিএস ইউনিট প্রথম বাজারে নিয়ে আসা হয়। ১৯৯৯ সালে মোবাইল ফোনে সর্বপ্রথম জিপিএস প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছিল। এর সাথে সাথেই জিপিএস প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে চলে আসে।  

জিপিএস কিভাবে কাজ করে?

জিপিএস মহাকাশে পাঠানো স্যাটেলাইটে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে কাজ করে। এই স্যাটেলাইট গুলো থেকে পাঠানো সিগন্যাল ব্যবহার করে সঠিক অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেকগুলো জিপিএস স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছে। এই স্যাটেলাইট গুলো পৃথিবী থেকে সিগন্যাল গ্রহণ করে এবং অবস্থানের নির্ভুল তথ্য সিগন্যাল আকারে রিসিভারে প্রেরণ করে।

জিপিএস স্যাটেলাইট গুলো একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে থেকে দিনে ২ বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। প্রতিটি স্যাটেলাইট একটি ইউনিক সিগন্যাল ও অরবিটাল প্যারামিটার প্রেরণ করে। এটি জিপিএস ডিভাইসগুলিকে স্যাটেলাইটের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করতে সহায়তা করে। জিপিএস রিসিভার এই তথ্য ব্যবহার করে যেকোনো ব্যক্তি বা বস্তুর সঠিক অবস্থান নির্ণয় করতে পারে। জিপিএস রিসিভার মূলত স্যাটেলাইটে একটি প্রেরিত সিগন্যাল রিসিভারে গ্রহণ করতে কত সময় লাগে তার উপর ভিত্তি করে প্রতিটি স্যাটেলাইটের দূরত্ব পরিমাপ করে। এভাবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্যাটেলাইট থেকে দূরত্ব পরিমাপের মাধ্যমে রিসিভার একজন ব্যবহারকারীর অবস্থান নির্ধারণ করতে পারে। 

বর্তমান অবস্থান নির্ধারণের জন্য একটি জিপিএস রিসিভারের কমপক্ষে ৩টি স্যাটেলাইটের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে হয়। 2-D অবস্থান (অক্ষাংশ- দ্রাঘিমাংশ) নির্ণয়ের জন্য একটি জিপিএস রিসিভারকে কমপক্ষে ৩টি স্যাটেলাইট থেকে আসা সিগন্যাল লক করতে হবে। আবার, জিপিএস রিসিভার ৪টি বা তার বেশি স্যাটেলাইট থেকে আসা সিগন্যাল ট্র্যাক করতে পারলে বস্তুর 3-D অবস্থান (অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ এবং উচ্চতা) দেখতে পাওয়া যাবে।    

জিপিএস এর উপাদান

গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএস (GPS) এর তিনটি অংশ বা উপাদান রয়েছে। অংশগুলি হলো স্পেস সেগমেন্ট, কন্ট্রোল সেগমেন্ট এবং রিসিভার। এই উপাদানগুলো একত্রে কাজ করে যাতে অবস্থান, নেভিগেশন ও সময় সম্পর্কিত তথ্য সমুহ সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায়।

১। স্পেস সেগমেন্ট

জিপিএস সিস্টেমে প্রায় ২৪টি স্যাটেলাইট রয়েছে যেখানে স্যাটেলাইট গুলো তাদের নিজস্ব কক্ষপথ থেকে প্রতিনিয়ত পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। এই স্যাটেলাইট গুলো পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০,০০০ কি.মি. উপরে অবস্থিত এবং প্রতিটি স্যাটেলাইট ক্রমাগত মাইক্রোওয়েভ সিগন্যাল রিসিভারে প্রেরণ করে থাকে। প্রত্যেক স্যাটেলাইটে অ্যাটোমিক ক্লক সংযুক্ত থাকে যা স্যাটেলাইটকে পৃথিবীর ঘুর্ণন গতির সাথে সমন্বয় রেখে তাদের নিজস্ব কক্ষপথে থেকে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে সাহায্য করে।

২। কন্ট্রোল সেগমেন্ট

কন্ট্রোল সেগমেন্টটি গ্রাউন্ড সেগমেন্ট নামেও পরিচিত। জিপিএসের এই উপাদানটি অনেকটা টাওয়ার স্টেশনের মতো। স্যাটেলাইটের কার্যকারিতা যথাযথ ভাবে পরিচালনা এবং নিশ্চিত করাই কন্ট্রোল সিস্টেমের প্রধান কাজ। কন্ট্রোল সেগমেন্টে একটি প্রধান কন্ট্রোল স্টেশন, একটি ব্যাকআপ কন্ট্রোল স্টেশন, কিছু কমান্ড অ্যান্টেনা, কন্ট্রোল অ্যান্টেনা, এবং মনিটরিং সাইট রয়েছে। এই সিস্টেমের মাধ্যমে স্যাটেলাইটের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ, স্যাটেলাইটের ট্রান্সমিশন পর্যবেক্ষণ করা হয়। এছাড়া, স্যাটেলাইট থেকে রিসিভারে পাঠানো তথ্য যাতে নির্ভুল থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে থাকে।        

৩। রিসিভার

জিপিএস সিগন্যাল রিসিভার হলো জিপিএস এর সবচেয়ে সাধারণ উপাদান যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ডিভাইস যেমন স্মার্টফোন, গাড়ি, ঘড়ি ইত্যাদিতে সংযুক্ত থাকে। জিপিএস রিসিভার একটি অ্যান্টেনা এবং একটি প্রসেসর নিয়ে গঠিত। অ্যান্টেনা স্যাটেলাইট থেকে প্রেরিত সিগন্যাল গ্রহণ করে এবং একই সময়ে প্রসেসরটি ট্রাইলেটারেশন নামক পদ্ধতি ব্যবহার করে সিগন্যাল থেকে তথ্য ডিকোড করে। রিসিভারে একটি ঘড়ি সংযুক্ত থাকে যা সিগন্যাল শনাক্ত করার সময়টা রেকর্ড করে রাখে।

জিপিএস এর প্রকারভেদ 

ব্যবহারভেদে বিভিন্ন প্রকারের জিপিএস প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা হয়েছে। জিপিএস এর প্রকারভেদ নিচে দেওয়া হলো।

১। Assisted GPS (A-GPS) 

Assisted GPS বা A-GPS হল এক ধরনের জিপিএস যার মাধ্যমে রিসিভার লোকাল নেটওয়ার্ক উৎস থেকে তথ্য গ্রহণ করতে পারে। এ ধরনের জিপিএস সাধারণত এমন জায়গায় ব্যবহার করা হয় যেখানে গাছ বা উঁচু ভবনের কারণে স্যাটেলাইট সিগন্যাল সহজে পৌঁছাতে পারে না। তবে, A-GPS কাজ করার জন্য অবশ্যই সেলুলার নেটওয়ার্ক থাকতে হবে। বর্তমানে স্মার্টফোন গুলোতে A-GPS ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে জরুরিভিত্তিক কল প্রেরণের মাধ্যমে ফোনের অবস্থানের তথ্য শেয়ার করা যায়। 

২। Simultaneous GPS (S-GPS)

S-GPS এ একটি ডিভাইস থেকে একই সাথে জিপিএস সিগন্যাল এবং ভয়েস ডেটা উভয়ই প্রেরণ করা যায়। জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান সমুহ এ ধরনের জিপিএস এর সাহায্যে খুব দ্রুত বিপদ্গ্রস্থ মানুষের অবস্থান শনাক্ত করতে পারে। 

৩। Differential GPS (D-GPS)

প্রথাগত জিপিএস রিসিভার থেকে প্রাপ্ত লোকেশন ডেটা নির্ভুলভাবে উপস্থাপনের জন্য D-GPS ব্যবহার করা হয়। D-GPS হল জিপিএসের একটি উন্নত সংস্করণ, যা একটি বস্তু বা ব্যক্তির প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা প্রদান করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডিয়ান কোস্ট গার্ড দ্বারা এ ধরনের জিপিএস ব্যবহৃত হয়।

৪। Non-differential GPS

Differential GPS এর বিপরীত হচ্ছে Non-differential GPS যা অবস্থান নির্ণয় করতে সরাসরি স্যাটেলাইটের সংকেত ব্যবহার করে। এটি D-GPS এর তুলনায় কম নির্ভুল।

৫। Mapping and non-mapping GPS

ম্যাপিং জিপিএস হলো এমন ধরনের জিপিএস যেখানে আগে থেকেই ম্যাপ তৈরি করা থাকে। এসব ম্যাপ ইন্টারনেট এর সাহায্যে ডাউনলোড করে এই জিপিএস এর সাথে যোগসূত্রও স্থাপন করা যায়। সাধারণত এই ধরনের জিপিএস ইউনিট প্রায়ই মোবাইল এবং অন্যান্য ডিভাইসে পাওয়া যায়।

নন-ম্যাপিং জিপিএস হলো এক ধরনের জিপিএস ইউনিট যা ম্যাপ ছাড়াই আসে। এটি রাস্তার কোনো ম্যাপ ছাড়াই কাংক্ষিত অবস্থানে যাওয়ার দিক নির্দেশ করতে পারে।

জিপিএস এর উদাহরন 

জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করার জন্য বেশ কিছু কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার তৈরি করেছে। বহুল ব্যবহৃত কয়েকটি জিপিএস প্রযুক্তি হলো-

১। Google Maps Navigation

গুগল ম্যাপ একটি বহুল ব্যবহৃত জিপিএস সফটওয়্যার যা গুগল ক্লাউড প্লাটফর্ম দ্বারা পরিচালিত হয়। ২০২০ সালের হিসাবে, গুগল ম্যাপ প্রতি মাসে এক বিলিয়নেরও বেশি ব্যক্তির দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছিল। গুগল ম্যাপ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায়, যেমন-

  • নেভিগেশনঃ এটি এক অবস্থান থেকে অন্য জায়গায় যেতে যে সেরা সম্ভাব্য রুট নেয়া যেতে পারে তা দেখায়। এছাড়া, এটি পরিবহন বা বর্তমান গতির উপর ভিত্তি করে ভ্রমণের সম্ভাব্য সময়টিও গণনা করে থাকে।
  • স্ট্রীট ভিউঃ ৩৬০ ডিগ্রি প্যানোরামিক চিত্র সহ, গুগল স্ট্রিট ভিউ অনেকটা বাস্তবের কাছাকাছি অভিজ্ঞতা দেয়। 
  • রিয়েল-টাইম ট্র্যাফিক আপডেটঃ বেশ কয়েকটি স্মার্টফোন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, গুগল ম্যাপ নির্ধারণ করতে পারে যে সামনের রাস্তা কতোটা যানজটে পরিপূর্ণ এবং এর সাথে বিকল্প রাস্তাও দেখিয়ে দেয়।
  • ল্যান্ডমার্ক এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তালিকাঃ স্যাটেলাইট পজিশনিং সিস্টেমের মাধ্যমে, গুগল ম্যাপে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সংস্থা এবং হাসপাতালগুলির অবস্থান বিভিন্ন রুটে চিহ্নিত করা থাকে। এতে করে ব্যবহারকারীরা সহজেই এসব প্রতিষ্ঠান খুঁজে পেতে পারেন।

২। NASA’s GIPSY OASIS

GIPSY OASIS একটি নেভিগেশন সফটওয়্যার যা মূলত ভূ-ত্বাত্তিক এবং গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম গবেষণার জন্য ব্যবহৃত হয়। GIPSY OASIS এর পূর্ণরূপ হলো GNSS-inferred positioning system and orbit analysis simulation software। এটি National Aeronautics and Space Administration (NASA) এর মালিকানাধীন একটি সফটওয়্যার। এটি তিনটি জিওডেটিক কৌশল ব্যবহার করে নেভিগেশন, সময় এবং অবস্থান নির্ধারণ করেঃ

  • The global navigation satellite systems (GNSS)
  • Satellite laser ranging (SLR)
  • Doppler orbitography and radio positioning integrated by satellite (DORIS) 

৩। NAVSTAR GPS

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা পরিচালিত গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেমটি সাধারণত NAVSTAR GPS হিসাবে পরিচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের সামরিক ট্র্যাকিংয়ের জন্য এবং বিভিন্ন বিশেষায়িত কার্যক্রম পরিচালনা ইত্যাদি কাজে এই জিপিএস সিস্টেম ব্যবহৃত হয়।

জিপিএস এর ব্যবহার 

বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সকল প্রান্তে নানা কাজে জিপিএস ব্যবহার হয়ে আসছে। সাধারণত জিপিএস এর ৫টি প্রধান ব্যবহার রয়েছে। এগুলো হলো-

  • অবস্থান নির্ণয়ঃ এর মাধ্যমে সহজেই যেকোনো ব্যক্তি বা বস্তু কোথায় অবস্থান করছে তা সম্পর্কে জানা যায়।
  • নেভিগেশনঃ এক জায়গা থেকে অপর জায়গায় যাওয়ার সবচেয়ে সহজ পথ খুঁজে বের করে দেয়।
  • ম্যাপিংঃ বিশ্বের যেকোনো স্থানের সঠিক মানচিত্র তৈরি করা যায়।
  • ট্র্যাকিংঃ যেকোনো বস্তু বা ব্যক্তির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা যায়।
  • সময়ঃ দুরত্ব ও ট্র্যাফিক মনিটরিং করে সময়ের সঠিক পরিমাপ বের করে দিতে পারে।

জিপিএস প্রযুক্তি এখন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পরেছে এবং বৈশ্বিক অবকাঠামোর একটি প্রয়োজনীয় অংশে পরিণত হয়েছে। ম্যাপিং, ইন্টারনেট, শিল্পক্ষেত্র, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সামরিক, কৃষি, ব্যাংকিং ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে জিপিএস প্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ব্যবহারের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য হলো-

  • যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় জিপিএস প্রযুক্তি এখন অপরিহার্য অংশ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে প্রায় সকল গাড়িতেই জিপিএস নেভিগেশন সিস্টেম সংযুক্ত থাকে। ফলে জিপিএস সিস্টেম পরিবহন ব্যবস্থায় পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে। এছাড়া চুরি যাওয়া মোবাইল ফোন, গাড়ি খুঁজে পেতেও জিপিএস এর ব্যবহার করে গাড়ির বর্তমান অবস্থান শনাক্ত করা যায়।
  • জরুরি পরিষেবাঃ যেকোনো জরুরি অবস্থায় ভিকটিমের অবস্থান শনাক্ত করতে জিপিএস ব্যবহার করা হয়। জরুরি সেবা পেতে নির্ধারিত হটলাইন নাম্বারে কোনো ব্যক্তি ফোন করলে সেবা প্রদানকারী কর্মীরা জিপিএস এর মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার অবস্থান ট্র্যাক করতে পারে। ফলে তারা দ্রুত সেই ব্যক্তির নিকট পৌঁছাতে সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে ভিক্টিম তার অবস্থান সম্পর্কে না জানলেও জিপিএস এ কাজটি সহজ করে দেয়। তাই জরুরি দুর্যোগ মোকাবিলায় জিপিএস অনন্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
  • সামরিক সংস্থাঃ সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের কর্মক্ষেত্রে জিপিএস প্রযুক্তির ব্যবহার করে আসছে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের যানবাহনে জিপিএস ট্র্যাকিং ডিভাইস বসিয়ে তারা সংঘটিত অপরাধ সম্পর্কে জানতে সক্ষম হয়। এতে করে সময়মত ঘটনাস্থলে পৌঁছে ক্ষয়ক্ষতি রোধ করতে পারেন। এছাড়াও জিপিএস ট্র্যাকারের সাহায্যে বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র ইত্যাদি শনাক্ত করা হয়।
  • কৃষিক্ষেত্রেঃ মাটির নমুনা পরীক্ষা, ক্ষেতের ম্যাপ তৈরি, ট্র্যাক্টর ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি পর্যবেক্ষণ, উচ্চতর ফলন ইত্যাদি ক্ষেত্রে জিপিএস প্রযুক্তির অবদান বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
  • বিমান ব্যবস্থাঃ বর্তমানে বিমান পরিবহন ব্যবস্থায়ও জিপিএস প্রযুক্তির অবদান অনস্বীকার্য। এখন প্রায় সকল বিমানেই ফ্লাইট চলাকালীন সময়ে নেভিগেট করতে জিপিএস এর উপর নির্ভর করে। এছাড়া একই এলাকার মধ্যে একটি বিমানের লোকেশন অন্য বিমানের কাছে প্রেরণ করে এয়ার ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। ড্রোন ও অন্যান্য যন্ত্রচালিত যানবাহনে জিপিএস ব্যবহার করে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

জিপিএস এর সুবিধা

জিপিএস ব্যবহারের কিছু উল্লেখযোগ্য সুবিধা হলো-

  • জিপিএস রোদ, বৃষ্টি বা ঝড় যেকোনো আবহাওয়ায় কাজ করতে সক্ষম।
  • জিপিএস এর দাম অন্যান্য নেভিগেশন সিস্টেমের তুলনায় অনেক কম এবং এর ব্যবহারও খুব সহজ। আমাদের হাতে থাকা স্মার্টফোন বা স্মার্টওয়াচ দিয়েই এটি ব্যবহার করা যায়। 
  • বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকেই জিপিএস ব্যবহার করা সম্ভব।
  • জিপিএস এর মাধ্যমে লাইভ ট্র্যাফিক আপডেট পাওয়া যায়। ট্র্যাফিক আপডেট দেখে রাস্তায় চলাচল করলে আমাদের সময়ের অপচয় হ্রাস করা যায়।
  • জিপিএস এর সাহায্যে যেকোনো নির্দিষ্ট জায়গার আশেপাশের এটিএম বুথ, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ব্যাংক, হসপিটাল ইত্যাদির লোকেশন দেখতে পাওয়া যায়।
  • জিপিএস এর আরেকটি সুবিধা হল এর মাধ্যমে রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিং এবং লাইভ স্ট্রিমিং ভিডিও রেকর্ডিং করা যায়।

জিপিএস এর সীমাবদ্ধতা 

সারা বিশ্বজুড়ে জিপিএস ব্যবহৃত হলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন-

  • জিপিএস সিগন্যাল অনেক সময় বড় পাহাড় অথবা পুরু দেয়াল ভেদ করতে বাধার সম্মুখীন হয়। ফলে সেসব জায়গায় জিপিএস সিগন্যাল ভালো কভারেজ দিতে পারে না।
  • জিপিএস ব্যবহার করার জন্য একটি ডিভাইস ও ইন্টারনেট থাকা আবশ্যক। এগুলো ছাড়া জিপিএস সিগন্যাল ব্যবহার করে লোকেশন ট্র্যাক করা সম্ভব না।
  • পাহাড়ি ও বরফে আবৃত এলাকায় জিপিএস ঠিকমত কাজ করে না। এসব জায়গায় জিপিএস সিগন্যাল পেতে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়। 

শেষকথা

বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে জিপিএস প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমরা এখন বাসা থেকে বের হওয়ার পূর্বে একবার হলেও আমাদের গন্তব্য এবং ট্র্যাফিক আপডেট সম্পর্কে জানার জন্য জিপিএস এর সাহায্য নিয়ে থাকি। অপরিচিত জায়গায় যাওয়ার জন্য সঠিক রাস্তা ও ঠিকানা খুঁজে পেতে জিপিএস প্রযুক্তির উপরই সবাই নির্ভরশীল। যোগাযোগ ব্যবস্থা, দুর্যোগ মোকাবিলায়, ব্যবসা, শিল্প, কৃষি ক্ষেত্রে, ব্যাংকিং, সামরিক ও বেসামরিক নিরাপত্তা বজায় রাখতে ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নতি সম্ভব হয়েছে জিপিএস এর ব্যবহারের ফলে। সুতরাং, এটা বলা যেতেই পারে যে ভবিষ্যতে জিপিএস প্রযুক্তি আমাদের জীবনের আরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠবে।    

সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নসমূহ 

১। স্মার্টফোনে জিপিএস কিভাবে চালু করতে হয়?

আপনার স্মার্টফোনে জিপিএস চালু করার জন্য সেটিংস্‌ অপশন বা নোটিফিকেশান প্যানেলে গিয়ে “Location” অপশনটি চালু করে দিতে হবে। এতে করে আপনার মোবাইলে সাথে সাথেই জিপিএস কানেক্ট হয়ে যাবে। 

২। ইন্টারনেট ছাড়া কি জিপিএস চলে?

সাধারণত জিপিএস সিগন্যাল রিসিভ করার জন্য ইন্টারনেট কানেকশন থাকার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে কিছু জিপিএস সফটওয়্যার যেমন গুগল ম্যাপ ব্যবহার করার জন্য ইন্টারনেট কানেকশনের প্রয়োজন পরে। 

৩। ট্রাইলেটারেশন কি?

ট্রাইলেটারেশন হলো একটি গাণিতিক কৌশল যা গতি, উচ্চতা এবং অবস্থান নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়। 

৪। জিপিএস সিগন্যাল কখন বাধাগ্রস্ত হতে পারে?

জিপিএস সিগন্যাল অনেক সময় উঁচু পাহাড়, মোটা দেয়াল অথবা বড় বড় গাছ দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। এতে করে জিপিএস তথ্যের নির্ভুলতা কমে যেতে পারে।

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button