জন্ম নিবন্ধনপরিচয় পত্র

জন্ম সনদ তৈরি না করলে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়

জন্ম সনদ প্রত্যেক মানুষের জীবনে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সনদ। জন্ম নিবন্ধনের মাধ্যমে জন্ম সনদ গ্রহণ করা সকলের জন্য জরুরি। শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যেই তার জন্ম নিবন্ধন করা উচিত। স্কুলে ভর্তি, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট তৈরি, চাকরি, চিকিৎসা সেবা গ্রহণসহ সকল ক্ষেত্রে জন্ম সনদের প্রয়োজন পরে। তাই জন্ম সনদ না থাকলে একজন ব্যক্তির জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।  

জন্ম সনদ কি?

একটি শিশু জন্মের পর তার জন্ম পরিচয় ও জাতীয়তা নিশ্চিত করার আইনগত প্রক্রিয়া শুরু হয় জন্ম নিবন্ধন করার মাধ্যমে। জন্ম নিবন্ধন ও জন্ম সনদ প্রতিটি নাগরিকের অধিকার। এটি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার ‘জন্ম ও মৃত্যু আইন ২০০৪’ প্রণয়ন করে। এই আইনের আওতায় প্রতিটি ব্যক্তি তার নাম, লিঙ্গ, জন্মের তারিখ ও স্থান, বাবা-মায়ের নাম, তাদের জাতীয়তা এবং স্থায়ী ঠিকানা নির্ধারিত নিবন্ধক কর্তৃক রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ অথবা কম্পিউটারে এন্ট্রি করে জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন ও জন্ম সনদ গ্রহণ করতে পারবে। জন্ম সনদ প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত পরিচয় বহন করে।  

জন্ম নিবন্ধন ও জন্ম সনদের পার্থক্য 

প্রকৃতপক্ষে, জন্ম নিবন্ধন হলো রাষ্ট্র কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার প্রক্রিয়া, এবং এই নিবন্ধনের ফলস্বরূপ রাষ্ট্র তার নাগরিককে পত্র আকারে যে সার্টিফিকেট প্রদান করে তাই হলো জন্ম সনদ। সাধারণত কোনো শিশুর জন্মের পরপরই অনলাইনে অথবা জন্ম নিবন্ধকের কার্যালয় থেকে আবেদন করার মাধ্যমে এই জন্ম নিবন্ধনের কার্যক্রম শুরু করতে হয়। জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষে জন্ম নিবন্ধন  কর্তৃপক্ষ নিবন্ধনকারীকে একটি জন্ম সনদ দিয়ে থাকেন। এই জন্ম সনদই একজন মানুষের জন্ম, পরিচয় ও নাগরিকত্বের প্রমাণ।

জন্ম সনদের প্রয়োজনীয়তা 

জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জন্ম সনদ অর্জন করা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার। জন্ম সনদই একজন শিশুকে তার দেশের নাগরিক হিসেবে প্রমাণের নিশ্চয়তা দেয়। একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সকল সুযোগ সুবিধা ও মর্যাদা লাভ করতে হলে জন্ম নিবন্ধন সনদ থাকা অত্যাবশ্যক। জন্ম নিবন্ধন যেসব কাজে লাগে-

১। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে

২। জাতীয় পরিচয়পত্র বা নতুন করে ভোটার নিবন্ধন করতে 

৩। পাসপোর্ট তৈরি করতে

৪। ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে

৫। বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ও সরকারি চাকুরিতে যোগদান করতে

৬। বিয়ের নিবন্ধন করতে 

৭। জমি ও সম্পত্তির রেজিস্ট্রেশন 

৮। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন 

৯। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা 

১০। ট্রেড লাইসেন্স পেতে

১১। আমদানি ও রপ্তানি লাইসেন্স পেতে

১২। বাড়ির নকশা অনুমোদন পেতে

১৩। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ও টেলিফোন সংযোগ পেতে 

১৪। ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) পেতে

১৫। ঠিকাদারি লাইসেন্স পেতে 

১৬। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে

১৭। শিশুশ্রম প্রতিরোধ করতে

জন্ম সনদ তৈরি না করলে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়

১। স্কুলে ভর্তিঃ শিশুর প্রাথমিক স্কুল থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ও বয়স প্রমাণের জন্য জন্ম সনদ প্রদর্শন করতে হয়। জন্ম সনদ না থাকার কারণে অনেকেই তাদের কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে না। জন্ম সনদ না দেখাতে পারলে অনেক সময় পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে পারেন না।

২। জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিঃ বয়স প্রমাণের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা ভোটার আইডি কার্ড আবেদন ফর্মের সঙ্গে জন্ম নিবন্ধন সনদও জমা দিতে হয়। জন্ম সনদ ছাড়া ভোটার আইডি কার্ডের আবেদন গ্রহণযোগ্য হয় না। এতে করে ভোটাধিকারসহ সকল প্রকার নাগরিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয়।

৩। পাসপোর্ট তৈরিতেঃ পাসপোর্টের আবেদন করতে গেলে জন্ম সনদের ফটোকপি জমা দিতে বলা হয়। পড়াশোনা, ব্যবসা, চিকিৎসা, চাকরি, ভ্রমণ ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে প্রতিনিয়ত আমাদের বিদেশ যেতে পাসপোর্টের প্রয়োজন পরে। জন্ম সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকলে পাসপোর্টের আবেদন করা যায় না। 

৪। ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরিঃ সাধারণত ১৮ বছর বয়সের পর থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য আবেদন করা যায়। তাই ড্রাইভিং লাইসেন্সের বয়স হয়েছে কিনা এবং আবেদনকারীর জাতীয়তা যাচাই করার জন্য জন্ম সনদ দেখাতে হয়।   

৫। চিকিৎসা সেবাঃ অনেক ক্ষেত্রেই শিশুর ভ্যাকসিন ও অন্যান্য চিকিৎসা সেবা পেতে জন্ম সনদের প্রয়োজন হতে পারে। সরকার কর্তৃক আয়োজিত বিনামূল্যে ভ্যাকসিন সুবিধা পেতে জন্ম সনদ তৈরি করে রাখতে হবে।

৬। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত চাকরিঃ বর্তমানে সরকারি ও বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত চাকরি পেতে হলে জন্ম নিবন্ধন সনদ জমা দিতে হয়। বয়স, পরিচয়, দেশের নাগরিক কিনা এসব যাচাই করার জন্য জন্ম সনদ চাওয়া হয়। এক্ষেত্রে জন্ম সনদ দেখাতে না পারলে অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত চাকরিটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। 

৭। সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় করতেঃ সম্পত্তি কেনা-বেচার পর রেজিস্ট্রেশান করতে গেলে জন্ম সনদের প্রয়োজন হয়। জন্ম সনদ ছাড়া সম্পত্তির রেজিস্ট্রেশান করানো সম্ভব নয়। 

৮। বিয়ের নিবন্ধনঃ বিয়ের নিবন্ধন করতে গেলে জন্ম সনদের প্রয়োজন হয়। দেশের আইন অনুযায়ী বিয়ের উপযুক্ত বয়স হয়েছে কিনা তা প্রমাণ করতে জন্ম সনদ দেখাতে হয়। বাল্যবিবাহ রোধে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৯। শিশু অপরাধ রোধেঃ শিশু পাচার ও শিশুশ্রম এর মত অপরাধ প্রতিরোধ করতে জন্ম সনদ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া শিশুরা বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ফলে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পরে। এক্ষেত্রে সঠিক বিচার করার জন্য বয়স প্রমাণ করতে জন্ম সনদ প্রয়োজন হয়। 

শেষকথা

বাংলাদেশের জন্ম নিবন্ধন আইন অনুযায়ী, বয়স, ধর্ম, জাতি কিংবা গোষ্ঠীভেদে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করা প্রতিটি মানুষের জন্য জন্ম নিবন্ধন ও জন্ম সনদ থাকা বাধ্যতামূলক। ১৮ বছর হওয়ার আগ পর্যন্ত জন্ম সনদই একমাত্র পরিচয়পত্র যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা লাভ করা যায়। তাছাড়াও, জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করার পরেও সকল ক্ষেত্রে জন্ম সনদের প্রয়োজন থাকে। ফলে জন্ম সনদ না থাকলে মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হওয়া লাগতে পারে।

সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

১। জন্ম সনদ হারিয়ে গেলে কি করতে হবে?

উত্তরঃ জন্ম সনদ হারিয়ে গেলে অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন সনদ পুনঃ মুদ্রণের জন্য আবেদন করতে হবে। এজন্য আপনার জন্ম নিবন্ধন নাম্বার জানা থাকা আবশ্যক। জন্ম নিবন্ধন নম্বর ও জন্ম তারিখ ব্যবহার করে জন্ম সনদের প্রতিলিপির জন্য আবেদন করা যাবে।

২। বাংলা ও ইংরেজী জন্ম সনদ একসাথে প্রদান করা যাবে কি?

উত্তরঃ হ্যাঁ, বাংলা ও ইংরেজী জন্ম সনদ একত্রে প্রদান করা যাবে। এক্ষেত্রে সনদের একপাশে বাংলা ও পৃষ্ঠার অপরপিঠে ইংরেজী লেখা সনদ রাখা যাবে।

৩। পিতা মাতার জন্ম সনদ ছাড়া কি শিশুর জন্ম নিবন্ধনের আবেদন করা যাবে?

উত্তরঃ ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চালু হওয়া আইন অনুযায়ী, ২০০১ সালের পর জন্ম নেওয়া সকল নাগরিকের জন্ম সনদ পেতে হলে পিতা-মাতার জন্ম নিবন্ধন সনদ অবশ্যই প্রয়োজন হবে। তবে, জন্ম নিবন্ধন নিয়ে জনভোগান্তির বিষয় বিবেচনায় এখন পিতা-মাতার জন্ম সনদের বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালের ২৭ জুলাই এর পর থেকে অনলাইনে নতুন জন্ম নিবন্ধনের আবেদন ফরম পূরণ করতে গেলে এখন আর বাবা-মায়ের জন্ম সনদ চাওয়া হচ্ছে না।

৪। জন্ম সনদে ভুল তথ্য থাকলে কিভাবে সংশোধন করতে হবে?

উত্তরঃ জন্ম সনদে কোনো তথ্য ভুল ছাপা হলে তা তৎক্ষণাৎ সংশোধন করে নেওয়া অত্যাবশ্যক। জন্ম সনদ সংশোধনের জন্য অনলাইনে আবেদন করতে হবে। অনলাইনে আবেদনের জন্য http://bdris.gov.bd/br/correction এই লিংকে গিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সংশোধন করে নিতে হবে।

৫। জন্ম নিবন্ধন করার কত দিনের মধ্যে জন্ম সনদ পাওয়া যাবে?

উত্তরঃ সাধারণত জন্ম নিবন্ধনের আবেদন করার ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই জন্ম সনদ হাতে পাওয়া যায়।

৬। একই ব্যক্তি একাধিকবার জন্ম সনদ তৈরি করতে পারবে কি?

উত্তরঃ না, একজন ব্যক্তি জন্ম নিবন্ধনের মাধ্যমে একবারই জন্ম সনদ তৈরি করতে পারবে। একাধিকবার জন্ম সনদ তৈরি করা জন্ম ও মৃত্যু আইন ২০০৪ এর ২১ ধারা অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ।

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button