ব্যাংকিং

চেক লেখার নিয়মঃ যেকোনো ব্যাংকের চেক লিখুন নির্ভুল ভাবে

চেক হল একটি আর্থিক নথি যা একটি ব্যাংককে একজন ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য ব্যক্তির নিকট বা অন্য কোনো কোম্পানির অ্যাকাউন্টে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানের আদেশ দেয়। আর্থিক লেনদেনের জন্য চেক একটি নিরাপদ ও সুবিধাজনক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এটি একটি সুরক্ষিত উপায় বা বিকল্প হিসেবে কাজ করে যেহেতু এর মাধ্যমে নগদ অর্থের স্থানান্তর করতে হয় না, তাই ক্ষতি বা চুরির ভয় কম থাকে। 

ব্যাংক থেকে নগদ টাকা উত্তোলন অথবা স্থানান্তরের জন্য অনেকগুলো মাধ্যম রয়েছে যেমন মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, চেক, কার্ড ইত্যাদি। তবে এসবের মধ্যে চেক হল ব্যাংক লেনদেনের প্রধানতম ও আদি মাধ্যম। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে জমা টাকা উত্তোলনের জন্য একটি চেকের নির্দিষ্ট কিছু তথ্য পূরণ করে তা জমা দিতে হয়। এই পূরণকৃত চেক ছাড়া কোনোভাবেই অ্যাকাউন্ট থেকে নগদ অর্থের লেনদেন সম্ভব নয়। তাই চেক ব্যবহারের পূর্বে সেটি কিভাবে লিখতে হয় তা জেনে নেওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। 

যেকোনো চেক লেখার সময় অত্যন্ত সতর্কতার সহিত প্রতিটি তথ্য সঠিকভাবে উল্লেখ করতে হবে। অন্যথায়, চেক লেখার সময় সামান্য কোনো ভুলে টাকা উত্তোলনে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। সুতরাং, যেকোনো ধরনের ভুল এড়িয়ে চলার জন্য আগে থেকেই চেক লেখার নিয়ম সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। কিভাবে চেক লিখতে হয় তা জানতে শুরুতেই চেক এর বিভিন্ন অংশগুলো সম্বন্ধে জেনে নেওয়া যাক। 

চেক এর প্রধান অংশসমূহ

  • Bank and Branch name: এ অংশে ব্যাংক এবং ব্যাংকের শাখার নাম উল্লেখ থাকে। এছাড়া রাউটিং নাম্বার সহ ব্রাঞ্চের ঠিকানা লেখা থাকে। বেশিরভাগ রাউটিং নাম্বার ব্যবহৃত হয় EFT (ইলেক্ট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার) লেনদেন করার জন্য।
  • Cheque number: চেক বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায় একটি ইউনিক নাম্বার দেখতে পাওয়া যায় যা চেক ট্র্যাক করতে সহায়তা করে। এটি ৬-১২ সংখ্যার একটি বিশেষ নাম্বার।
  • Date: চেক বইয়ের ডানদিকে উপরের অংশে ইংরেজিতে তারিখ লিখাটির পাশে কতগুলো ছোট ছোট বক্স দেখতে পাওয়া যায়। এই বক্সগুলিতে আপনি যেই দিন টাকা উত্তোলন করবেন সেই দিনের তারিখ আপনাকে উল্লেখ করতে হবে।
  • Pay to: এই অংশে প্রাপকের নাম লিখতে হবে অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম যাকে টাকা দেওয়া হবে। নিজেই নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করতে চাইলে এ অংশে ‘Self’ কথাটি লিখতে হবে।
  • The sum of taka: অ্যাকাউন্টধারী ব্যক্তি যে পরিমাণ অর্থ প্রদান বা উত্তোলন করতে ইচ্ছুক তা এখানে স্পষ্টভাবে লিখতে হবে। টাকার অংকের সংখ্যাসূচক অংশটি অস্পষ্ট হলে এই অংশটি বেশিরভাগ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য থাকে।
  • Tk: এই বক্সে অ্যাকাউন্টধারী যে পরিমাণ অর্থ প্রদান বা উত্তোলন করতে ইচ্ছুক তা সংখ্যায় স্পষ্টভাবে লিখতে হবে। লিখিত পরিমাণ এবং সংখ্যার পরিমাণ একই হতে হবে।
  • Account holder information: এই অংশে ব্যাংক কর্তৃক মুদ্রিত অবস্থায় অ্যাকাউন্টধারী ব্যক্তির নাম ও অ্যাকাউন্ট নাম্বার লিখা থাকে।
  • Signature line: এই স্বাক্ষর লাইনের উপর অ্যাকাউন্টধারী সিগনেচার বা স্বাক্ষর করে চেকটিকে টাকা লেনদেনের জন্য বৈধ করে তোলে। ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলার সময় যে যেভাবে স্বাক্ষর দেওয়া হয়েছিল সেভাবেই প্রতিবার স্বাক্ষর দিতে হবে।
  • MICR line: MICR এর পূর্ণরূপ হল Magnetic Ink Character Recognition, যার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো কোনো ত্রুটি ছাড়াই এবং দ্রুত পদ্ধতিতে চেক প্রক্রিয়ার কাজ করতে পারে। এই নম্বরটি সাধারণত চেকের নীচে প্রিন্ট করা হয়। তবে, ব্যাংকভেদে এটি উপর-নিচ বিভিন্ন জায়গায় পরিবর্তিত হতে পারে।

সঠিকভাবে চেক লেখার নিয়ম

ব্যাংক চেক ব্যবহার করে অর্থ উত্তোলন বা স্থানান্তরের জন্য অবশ্যই একটি চেক বই থাকতে হবে। এই চেক বই সংগ্রহের জন্য ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলার সময়ই আবেদন করতে হয়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এই আবেদনের প্রেক্ষিতে একটি চেক বই প্রদান করে। চেক বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা ব্যবহার করে টাকা উত্তোলন করা যায়। আমরা এর আগে চেকের বিভিন্ন অংশগুলো সম্পর্কে জেনেছি। এবার জানবো কিভাবে এই অংশগুলো সঠিকভাবে পূরণ করতে হয়।

Date:

চেকের উপরের ডানদিকে Date নামের একটি অপশন বক্স দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণত প্রতিটি ব্যাংক তারিখের জন্য dd/mm/year বিন্যাস ব্যবহার করে। এখানে তারিখের জন্য প্রথম দুটি বক্স, পরবর্তী দুটি মাসের জন্য এবং শেষ চারটি বক্স বছরের জন্য। এখানে যেই দিন টাকা উত্তোলন করা হবে সেই দিনের তারিখ সেখানে উল্লেখ করতে হবে। তবে অনেকেই পরবর্তীতে ব্যবহার করার জন্য অথবা অন্য কাউকে চেক দেয়ার জন্য আগে থেকেই চেক লিখে থাকেন। এক্ষেত্রে সেখানে পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে যেকোনো একটি তারিখ লিখে রাখতে পারবে। কেননা, তিন মাসের অধিক হয়ে গেলে চেক বাতিল হয়ে যাবে।

Pay to:

এখানে যে ব্যক্তি বা কোম্পানি টাকা উত্তোলন করবে অথবা যার অ্যাকাউন্টে টাকা হস্তান্তর হবে, সেই ব্যক্তি বা কোম্পানির নাম উল্লেখ করতে হবে। অ্যাকাউন্টধারী ব্যক্তি নিজেই টাকা উত্তোলন করতে চাইলে এই অপশনে ‘Self’ লিখে দিতে হবে। অ্যাকাউন্টধারী ব্যক্তি ব্যতিত অন্য কারো নাম এই লাইনে লিখলে সেক্ষেত্রে Bearer লেখাটি কেটে দিতে হবে। অন্যথায় উল্লেখিত নাম ছাড়া অন্য কেউ এই চেক ব্যবহার করতে পারে। 

The Sum of Taka:

এখানে যে পরিমাণ টাকা হস্তান্তর বা উত্তোলন হবে তা কথায় লিখে দিতে হবে। যেমন, কেউ যদি ১০০০ টাকা তুলতে চায় তবে তাকে সেখানে লিখতে হবে ‘One Thousand taka only’ অথবা বাংলায়, ‘এক হাজার টাকা মাত্র’। এভাবে যত টাকা উঠানো হবে সেই পরিমাণকে উল্লেখ করতে হবে। 

Tk:

এটি একটি বক্সের মধ্যে লিখতে হয়। বামপাশে যে পরিমাণ টাকা উত্তোলনের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল তা এই বক্সের মধ্যেই অংকে লিখতে হবে। অর্থাৎ, অ্যাকাউন্টধারী ব্যক্তি যেই পরিমাণ টাকা উত্তোলন করবে তা এইখানে অংকে লিখে দিতে হবে। যেমন, কোনো ব্যক্তি যদি ৫০০০ টাকা উত্তোলন করতে চায়, তবে তাকে এই বক্সে লিখতে হবে ইংরেজিতে 5000 অথবা বাংলায় ৫০০০।

Signature:

এরপর চেক এর নিচের দিকে ডানপাশে সিগনেচার দেয়ার অপশনে অ্যাকাউন্টধারী তার সিগনেচার বা স্বাক্ষর প্রদান করবে। সর্বশেষে, চেক এর পিছনের পৃষ্ঠায় “Endorse Here” লিখাটির ঠিক নিচে দুটি সিগনেচার দিতে হবে। এইভাবে চেক সঠিকভাবে লিখতে হবে।

চেক লেখার সময় সতর্কতা

চেক লেখার সময় কিছু বিষয়াবলী সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখতে হবে। যেমন,

  • Pay to অংশে নাম লেখা শেষ হওয়ার পরও ফাঁকা জায়গা থাকলে সেখানে একটি লম্বা দাগ টেনে দেয়া যাবে। এতে করে চেক হারিয়ে গেলেও অন্য় কেউ সেখানে অন্য কোনো নাম বসিয়ে দিতে পারবে না।
  • বক্সে টাকার অংক লেখার পর শেষে অবশ্যই “/-“ এই চিহ্নটি বসিয়ে দিতে হবে। এতে করে কেউ চেক এ লিখিত টাকার পরিমাণ পরিবর্তন করতে পারবে না।
  • সিগনেচার এর জায়গায় অবশ্যই ব্যাংক স্বীকৃত সিগনেচার দিতে হবে। অন্যথায়, চেকটি গ্রহনযোগ্য হবে না।
  • চেক সবসময় যেকোনো একটি ভাষা ব্যবহার করে লিখতে হবে। যেমন, ইংরেজিতে লিখলে সকল তথ্যই ইংরেজিতে পূরণ করতে হবে। আবার, বাংলায় লিখলে সবকিছু বাংলা ভাষায় লিখতে হবে।
  • চেক এর উপর কাটাকুটি এবং ওভাররাইট করা যাবে না।

শেষকথা

বাংলাদেশ ব্যাংকিং সিস্টেমের অন্যতম মাধ্যম হল এই ব্যাংক চেক। চেক এর মাধ্যমে নিরাপদে টাকা উত্তোলন এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা যায়। সতর্কতার সাথে চেক এর সকল তথ্য সঠিকভাবে পূরণ করলে এতে জালিয়াতির কোনো সম্ভবনা থাকে না। সুতরাং, চেক লেখার পূর্বে এর সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকলে নিরাপদে লেনদেন করা সম্ভব।

সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলি

১। ব্যাংক চেক লেখার ক্ষেত্রে মিশ্র ভাষা কি গ্রহণযোগ্য? 

না। চেক সাধারণত বাংলা অথবা ইংরেজি ভাষায় লিখতে বলা হয়ে থাকে। দুটি ভাষার মিশ্রণ অনেক সময় বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।

২। চেক নাম্বার বলতে কি বুঝায়?

এটি ৬-১২ ডিজিটের একটি ইউনিক নাম্বার যা প্রতিটি চেককে আলাদা বৈশিষ্ট্য প্রদান করে। চেক বইয়ের প্রত্যেক পাতায় এই নাম্বার ছাপানো থাকে।

৩। একটি চেকের মেয়াদকাল কত?

সাধারণত একটি চেক ইস্যু করার তারিখ থেকে ১৮০ দিন বা ৬ মাসের জন্য বৈধ থাকে।  ১৮০ দিন পর এটি অবৈধ চেক হিসেবে গণ্য হবে।

৪। একটি ব্যাংক কখন চেকের মাধ্যমে লেনদেন করতে অস্বীকার করতে পারে?

  • চেক লেখার সময় ভুল তথ্য উপস্থাপন করলে।
  • চেক ইস্যু করার পর ৬ মাস অতিবাহিত হলে।
  • একটি পোস্টডেটেড চেক তার তারিখের আগে লেনদেনের জন্য উপস্থাপন করলে।

৫। চেক কত প্রকার হতে পারে?

আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রকার চেক ব্যবহার করতে দেখা যায়। যেমন-

  • বিয়ারার বা বহনকারী চেক
  • অর্ডার চেক
  • ক্রসড চেক
  • পোস্ট-ডেটেড চেক
  • সেলফ চেক
  • ওপেন চেক
  • স্টেল চেক
  • ব্যাঙ্কারস চেক
  • ট্রাভেলার্স চেক

৬। চেক হারিয়ে গেলে কি করণীয়?

চেক হারিয়ে গেলে সাথেসাথেই ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। 

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button