চিকিৎসাস্বাস্থ্য

চুল পড়া বন্ধ করার উপায়

চুল পড়া। অনেকের জীবনেই শব্দ দুটি যেন এক বিভীষিকা। বয়স বেড়ে গেলে চুল পড়ে, তা তো সবাই জানে। কিন্তু বর্তমানে অসংখ্য নারী পুরুষ বেশ কম বয়সেই এই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। যা তাদের জন্য বেশ বড় একটি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর স্বাস্থ্য ও রুপের প্রতি বিশেষ ভাবে সচেতন নারী পুরুষদের জন্য এটি তো রীতিমতো এক অভিশাপ। এই অভিশাপের হাত থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই অনেক পন্থা অবলম্বন করছেন। অনেক স্থানে ধরনা দিচ্ছেন। তাই চুল পড়ার কারণ ও তা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় নিয়ে বিস্তারিত থাকছে আজকের এই লেখাটিতে।

সূচিপত্রঃ

চুল পড়ার কারণ

চুল পড়ার কারণ

চুল পড়া বন্ধের চেষ্টা করার আগে অবশ্যই এর পেছনের কারণগুলো জানা উচিত। প্রথমেই বলে রাখা ভাল, নারী পুরুষ উভয়ের মাথা থেকেই দৈনিক ৫০-১০০ টা চুল পড়া খুবই স্বাভাবিক। সাধারণত এই চুল পড়া চোখে পড়ে না কারণ একই সাথে মাথায় চুল গজাতে থাকে। চুল পড়ার সমস্যা তখনই চোখে পড়ে যখন চুল গজানোর চেয়ে চুল পড়ার মাত্রাটা অনেক বেশি হয়ে যায়।

জিনগত কারণ

চুল পড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো মানবদেহের জিন। জিন হলো মানবদেহের বংশগতির মূল ধারক ও বাহক। আমরা প্রায়ই দেখি যে বাবার মাথায় টাক থাকলে ছেলের মাথাতেও টাক পড়ে। এটিই জিন বা বংশগত কারণে চুল পড়ার সবচেয়ে সহজ উদাহরণ। মহিলাদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একইরকম। নির্দিষ্ট বয়সের পরে প্রত্যেক মানুষেরই বংশগত কারণে চুল পড়া বাড়তে থাকে। সাধারণত শতকরা ৫০ ভাগ পুরুষ ৪০ বছর থেকেই চুল পড়ার সমস্যায় ভুগতে শুরু করে। এর পোষাকি নাম হলো অ্যান্ড্রোজেনিক অ্যালোপেচিয়া (androgenic alopecia)। নারীদের ক্ষেত্রে এর বয়সসীমা ৭০ বছর।

হরমোনাল কারণ

মানবদেহে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হলে চুল পড়াটা খুবই স্বাভাবিক। তবে হরমোনাল কারণে চুল পড়ার সমস্যাটায় নারীরা বেশি ভুগে থাকেন। সাধারণত গর্ভধারণ, বাচ্চা জন্মদান, মেনোপজ (নির্দিষ্ট বয়সের পর ঋতু বন্ধ হওয়া) ও থাইরয়েড জনিত সমস্যার কারণে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়। ফলে আরো নানা সমস্যার পাশাপাশি চুল পড়াও একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব কারণে চুল পড়ার সমস্যা ক্ষণস্থায়ী। হরমোনের ভারসাম্য ফিরে এলে চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি শুরু হয়।

ঔষুধের প্রভাব 

বিভিন্ন ঔষুধের প্রভাবেও অনেক সময় চুল পড়তে পারে। অনেক সময় ক্যান্সার, আর্থ্রাইটিস, ডিপ্রেশন, হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের ঔষুধের কারণে চুল পড়তে পারে। তবে এ ব্যাপারে সিধান্তে পৌছানোর আগে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে নিতে হবে।

রেডিয়েশন থেরাপি

রেডিয়েশন থেরাপি তথা ক্যামো থেরাপি চুল পড়ার অন্যতম কারণ। এর কারণেই সবচেয়ে বেশি চুল পড়ে। অন্যান্য কারণের চেয়ে ক্যামো থেরাপির কারণে চুল পড়ার হার অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে প্রায়শই রোগীর মাথা সম্পূর্ণ চুলশূন্য হয়ে যায়। ক্যামো থেরাপি শেষ হলেও পরবর্তীতে চুল আর আগের মতো গজায় না।

মানসিক চাপ

মানসিক চাপ চুল পড়ার অন্যতম কারণ। মানুষের শরীর ও মন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মনের ওপর চাপ পড়লে তার প্রভাব শরীরেও পড়ে। অতিরিক্ত চিন্তা ভাবনা করলে অথবা মানসিক চাপ বা সমস্যার মুখোমুখি হলে চুল পড়াটা খুবই স্বাভাবিক। এ সমস্যা স্বল্পমেয়াদী থেকে দীর্ঘমেয়াদী উভয়ই হতে পারে। তাই চুল তথা শরীরকে সার্বিক ভাবে সুস্থ রাখতে হলে যথা সম্ভব মানসিক চাপমুক্ত থাকতে হবে।

চুল বাঁধার উপায়

চুল বাঁধার উপায় আসলেই চুল পড়ার একটি বড় কারণ। এটিও মূলত নারীরাই বেশি মোকাবেলা করে থাকেন। নারীদের লম্বা চুল নানা ভাবে বেঁধে রাখা যায়। কিন্তু সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক নানা ক্ষেত্রে অনেক নারীই নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলতে নানা উপায়ে চুল বাঁধেন। কিন্তু সেই বাধার উপায় যদি অস্বাভাবিক হয় তবে দীর্ঘমেয়াদে তা চুল পড়ার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

মূলত উপরিউক্ত কারণগুলোতে অধিকাংশ মানুষের চুল পড়ে। তবে এর বাইরে কারো বিশেষ শারীরিক অবস্থা থাকতেই পারে। বস্তুত শারীরিক জটিলতার কারণে চুল পড়া খুবই স্বাভাবিক। তেমনটি হলে আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে হবে। মনে রাখতে হবে যেকোনো সমস্যা রোধ করতে হলে আগে তার কারণটা চিহ্নিত করাই সবচেয়ে জরুরী।

চুল পড়া বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় খাদ্যাভাস

চুল পড়া বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় খাদ্যাভাস 

লেখার প্রথমেই বলেছি, চুল পড়ার সমস্যা তখনই চোখে ধরা পড়ে যখন চুলের বৃদ্ধির হার চুল পড়ার হারের চেয়ে কমে যায়। আর তাই স্বাভাবিক চুলের বৃদ্ধি বজায় রাখা খুবই জরুরী। চুলের বৃদ্ধিতে খাদ্যাভাস অনেক বড় ভূমিকা রাখে। চুলের ফলিকলগুলো মূলত কেরাটিন (keratin) নামক এক ধরনের আমিষ দ্বারা গঠিত। ২০১৭ সালের একটি গবেষণা মতে দেখা গিয়েছে যে, চুল পড়া সমস্যায় ভোগা অনেকেরই পুষ্টিজনিত সমস্যা ছিল। যদিও আমিষ জাতীয় খাদ্য খাওয়াটাই একমাত্র সমাধান নয়। তবে চুলের বৃদ্ধিতে আমিষ জাতীয় খাদ্য কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলে। এছাড়াও ভিটামিন ‘এ’ জাতীয় খাবারও চুলের বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। শুধু চুলের বৃদ্ধি নয় বরং মাথার ত্বকের পুষ্টি যোগাতেও ভিটামিন ‘এ’ কার্যকরী। তাই আমিষ জাতীয় ও নানা প্রকার ভিটামিন সমৃদ্ধ একটি খাবারের তালিকা  আলোচনা করা হলো লেখার এই অংশে।

ডিম

চুলের স্বাস্থ্য রক্ষায় সবচেয়ে সহজলভ্য খাদ্যটি সম্ভবত ডিম। ডিম আমাদের নিত্যদিনের খাদ্য তালিকার অংশ। তবে ডিম বেশ কমদামী খাবার হলেও মনে রাখতে হবে এটি একটি আমিষ জাতীয় খাদ্য। এবং চুলের ফলিকলগুলো আমিষ দ্বারাই গঠিত। তাই চুলের বৃদ্ধিতে ডিম ভূমিকা রাখে। এর পাশাপাশি ডিমে রয়েছে বায়োটিন। এটিও চুলের অতি দরকারি কেরাটিন আমিষ উৎপাদনে সহায়ক। এছাড়াও চুলে রয়েছে জিংক, সেলেনিয়াম সহ নানা উপাদান যা চুলের জন্য স্বাস্থ্যকর।

পালং শাক

বাঙালীর দৈনন্দিন খাদ্যাভাসে আরেকটি সহজলভ্য জিনিস হলো পালং শাক। সবুজ এই শাকটি আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ মনে হলেও এতে রয়েছে ফোলেট (ফলিক এসিড), লৌহ, ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’। পূর্বেই ভিটামিন ‘এ’ এর মাথার ত্বকের ওপর প্রভাব বর্ণনা করেছি। ভিটামিন ‘এ’ এর ফলে মাথার ত্বক পুষ্টিবান হওয়ায় চুলের বৃদ্ধি আরো বাড়ে। শুধু তাই নয় পালং শাকে থাকা লৌহ বা আয়রন শরীরের মেটাবলিজমকে ঠিক রাখতে সাহায্য করে। ফলে চুলের বৃদ্ধিও ঠিক হয়।

তেলযুক্ত মাছ

মাংসের তেল আমাদের শরীরের জন্য বেশ ক্ষতিকারক হলেও মাছের ক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা। মাছকে বলা হয় সর্বোৎকৃষ্ট আমিষ। এবং মাছের তেলে রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড চুল পড়া কমায় ও চুলের বৃদ্ধিতে দারুণ ভূমিকা রাখে। শুধু তাই নয়, তেলযুক্ত মাছগুলোতে রয়েছে আমিষ, সেলেনিয়াম, ভিটামিন বি ও ডি৩। তাই চুলের যত্ন চাইলে আমিষের উৎস হিসেবে মাছকে বেছে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত।

মিষ্টি আলু

মিষ্টি আলু অনেকেই বেশ শখ করে খান। কেউ বা হয়তো অতটা পছন্দ করেন না। তবে এই মিষ্টি আলু বিটা ক্যারোটিনের একটি দারুণ উৎস। এবং শরীর এই বিটা ক্যারোটিনকে ভিটামিন ‘এ’ তে রুপান্তর করে। একটি মধ্যম আকারের মিষ্টি আলু থেকে যে পরিমাণ ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায় তা আমাদের শরীরের দৈনিক চাহিদার চারগুণ।

বাদাম

বাদাম আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভাসের সাথে খুব একটা জড়িত নয়। তবে চুলের প্রতি বিশেষ ভাবে যত্নবান হলে আপনার উচিত হবে বাদাম খাওয়া। তবে সকল বাদামে একই ধরনের পুষ্টিগুণ নেই। উদাহরণস্বরুপ আ্যলমন্ড (Almond) এক প্রজাতির বাদাম। এর বাজারদর বেশ চড়া। তবে মাত্র ২৮ গ্রাম আ্যলমন্ড বাদামই আপনার শরীরের দৈনিক ভিটামিন ‘ই’ চাহিদার ৩৭% মেটাতে পারে।  তার পাশাপাশি আ্যলমন্ডে আছে ভিটামিন বি, জিংক সহ আরো নানা প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড৷ তাই এর পুষ্টিগুণের কারণে শুধু চুলের স্বাস্থ্য নয় বরং হৃৎপিন্ডের স্বাস্থ্যেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বীজ/সিডস (Seeds)

আপনি যদি স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে থাকেন তাহলে মোটেও চাইবেন না আপনার দৈনিক ক্যালোরি চাহিদার থেকে বেশি ক্যালোরি গ্রহণ করতে৷ কিন্তু চুলের বৃদ্ধির জন্য মূলত আমিষ জাতীয় খাদ্যই বেশি খেতে হয়। তাই দৈনিক ক্যালোরি গ্রহণের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার একটা ঝুকি থাকে৷ এই ঝুকি এড়াতে আপনাকে সাহায্য করবে সিডস বা বীজ৷ বিভিন্ন ফল ও ফুলের বীজ বেশ কম ক্যালোরি যুক্ত খাবার হলেও এতে ভিটামিন, জিংক ও সেলেনিয়ামের মাত্রা প্রচুর৷ বীজের ধরনের উপর নির্ভর করে এসব উপাদানের মাত্রা হ্রাস ও বৃদ্ধি পায়।

সূর্যমুখী ফুলের বীজ এক্ষেত্রে সেরা একটি খাবার। বাংলাদেশে খুব একটা চল না থাকলেও বাইরে প্যাকেটজাত করে সূর্যমূখী ফুলের বীজ বিক্রি করা হয়৷ এ দেশের সুপার শপগুলোতেও তা পেতে পারেন৷ সূর্যমুখী ফুলের বীজে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন ‘ই’ ও নানা ধরনের ভিটামিন ‘বি’। যা চুলের জন্য খুবই স্বাস্থ্যকর। মাত্র ২৮-৩০ গ্রাম সূর্যমুখীর বীজ গ্রহণ করলেই আপনার শরীরের দৈনিক ভিটামিন ‘ই’ চাহিদার অর্ধেক মিটে যাবে৷

সূর্যমুখী ফুলের বীজ বাদেও আরেকটি ভাল উপায় হতে পারে তিসি বীজ। এই নামটি বেশ অপরিচিত বলা চলে। একে অনেকে ‘আলসি’ বীজ বলেও ডাকে। এর ইংরেজি নাম ফ্লাক্স সিড। বৈজ্ঞানিক নাম লিনাম ইউসিট্যাটিসিমাম। এই  বীজটির বিশেষত্ব হলো এতে প্রচুর পরিমাণের ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড রয়েছে। এই বীজের মাত্র ২৮ গ্রামে রয়েছে ৬,৩৩৮ মিলিগ্রাম ওমেগা-৩। যার মাত্রা সাধারণ তেলযুক্ত মাছের থেকে অনেক বেশি। তিসি বীজ খাওয়ার সাধারণত দুই ধরনের উপায় আছে। একটি হলো বীজ গুড়ো করে। অপরটি হলো বীজ থেকে তেল বানিয়ে। উল্লেখ্য যে তিসি বীজের গুড়ো সরাসরি দোকানেই পাওয়া যায়। তবে সেগুলো খুব বেশি দিন কার্যকরী থাকে না। চাইলে নিজের বাসাতেও আস্তো তিসি বীজ গুড়ো করে নিয়মিত খেতে পারবেন। এতে করে চুলের স্বাস্থ্য ভাল হওয়ার পাশাপাশি শরীর অটোইমিউন রোগ প্রতিহত করবে। হার্ট অ্যাটাক, অতিরিক্ত চিন্তা, কোলন ক্যান্সার ইত্যাদির প্রতিকার হিসেবেও কাজ করবে তিসি বীজ।

তবে সূর্যমুখী ও তিসির বীজের ভীড়ে মিষ্টি কুমড়োর বীজের কথা ভুললে চলবে না। মিষ্টি কুমড়োর বীজে রয়েছে ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড, জিংক ও আয়রন। আর তাই সূর্যমুখী বা তিসি ফুলের বীজ যোগাড় করতে না পারলে মিষ্টি কুমড়োর বীজ হতে পারে একটি চমৎকার বিকল্প।

চিংড়ি মাছ

চিংড়ি মাছ হিসেবে পরিচিত প্রাণিটি বাঙালীর কাছে খুব পরিচিত খাদ্য। প্রথমত এটি একটি আমিষ। দ্বিতীয়ত এতে রয়েছে ‘বি১২’ ভিটামিন,  আয়রন, জিংক ও ডিটামিন ‘ডি’। মজার বিষয় হলো, মাত্র ১০০ গ্রাম চিংড়ি খেলেই মানবদেহের দৈনিক ভিটামিন ‘ডি’ এর ৩৮% মিটে যায়। উল্লেখ্য যে, চুল পড়ার সমস্যার সাথে পর্যাপ্ত ভিটামিন ‘ডি৩’ এর অভাব এর যোগসূত্র রয়েছে।

গাজর

খুব সাধারণ একটি সবজি। তবে এই সাধারণ খাদ্যটিই অসাধারণ হয়ে ওঠে এর ভিটামিন ‘এ’ এর কল্যাণে। এতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন ‘এ’ যা মাথার ত্বকে সেবাম নামক একটি তৈলাক্ত রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে। এটি মাথার ত্বক ও চুলের শুষ্কতা রোধ করতে খুবই কার্যকরী। এবং আদ্র ত্বক মানেই স্বাস্থ্যকর চুল।

এর বাইরেও আরো নানা ধরনের খাবার চুলের সঠিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে। যেমনঃ গ্রিন টি, ডাল, বিন, সয়াবিন ইত্যাদি। মূলত সকল স্বাস্থ্যকর খাবারই শরীরের সার্বিক স্বাস্থ্যে কিছু না কিছু ভূমিকা রাখে। তাই নিজেদের খাদ্যাভাস এমন ভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে সুষম খাদ্য পেয়ে শরীর থাকে সম্পূর্ণ সুস্থ। আর এই খাদ্যাভাস গড়ে তোলার সময় চুলের স্বাস্থ্যকে অবহেলা করা যাবে না মোটেও।

চুল পড়া বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহ

চুল পড়া বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় খাদ্যাভাস তৈরির পাশাপাশি চাই কিছু পন্থা অনুসরণ করা। সাধারণ কিছু পন্থা অনুসরণের মাধ্যমেই চুল পড়া কমে আসতে পারে উল্লেখযোগ্য হারে। যেমনঃ

নিয়মিত মাথা পরিষ্কার করুন

অপরিষ্কার মাথা চুল পড়ার অন্যতম কারণ। যদিও স্বাস্থ্য সচেতন সকল নারী পুরুষই আশা করি মাথার ত্বক পরিষ্কারে অত্যন্ত মনোযোগী। তাও একে অবহেলা করা যাবে না কোনো ভাবেই। মাথার চুল পরিষ্কার রাখতে প্রতিদিন সময় নিয়ে গোসল করুন। নিয়মিত মাথায় শ্যাম্পু করুন। তবে শ্যাম্পুটি যেন অতিরিক্ত কঠোর শ্যাম্পু না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন। একই সাথে শ্যাম্পুর পরে কন্ডিশনার ব্যবহার করতে ভুলবেন না। অনেকেই মানানসই শ্যাম্পু নির্বাচন করতে হিমসিম খান। এক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন।

তেল ব্যবহার করুন

মাথার চুলে নারিকেল তেল ব্যবহার করার সংস্কৃতি আদিযুগ থেকেই এই ভারতীয় উপমহাদেশে চলে আসছে। তবে বর্তমানে বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত যে, নারিকেল তেল চুলের স্বাস্থ্য রক্ষায় দারুণ প্রভাব রাখে। এটি চুলের ক্ষতি হওয়া অনেকাংশে কমায় এবং অতি-বেগুনি রশ্মি থেকে চুলকে রক্ষা করে। নারিকেল তেলে রয়েছে লরিক এসিড (Lauric Acid)। লরিক এসিড আমিষকে চুলের সাথে মিশতে সাহায্য করে। এছাড়াও নারিকেল তেলে মাথায় ঘষার সময় মাথার রক্ত সঞ্চালন বেশ ভাল হয়। এটি চুলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

নারিকেল তেলের পাশাপাশি জলপাই এর তেলও ব্যবহার করা যায়। জনমনে এটি অলিভ ওয়েল হিসেবেই পরিচিত। অলিভ ওয়েল এর প্রধান উপাদানগুলো হলো ওলেয়িক এসিড, পালমিটিক এসিড এবং স্কোয়ালিন। এই সবকটি’ই চুলকে নরম করে তোলে। এই গুণটি অনেক শ্যাম্পু, কন্ডিশনার এও রয়েছে। তবে তা কৃত্রিমভাবে। অলিভ ওয়েল প্রাকৃতিকভাবে চুলের ভেতরে নরম করে তোলে ও আদ্রতা বজায় রাখে। অলিভ ওয়েল ব্যবহার করতে প্রথমে ১ বা ২ চামচ তেল মাথায় ঢেলে ভাল ভাবে মাখিয়ে নিতে পারেন। ৩০-৪০ মিনিট রেখে চুলে ভাল ভাবে শ্যাম্পু করে ফেলুন। তেলের মাত্রা নিজ প্রয়োজন অনুসারে বাড়াতে কমাতে পারেন।

সঠিকভাবে চুল আঁচড়ান

সঠিকভাবে চুল না আঁচড়ানোর ফলে অনেক বেশি চুল পড়ে। সবচেয়ে ক্ষতিকারক হলো ভেজা চুল আঁচড়ানো। কারণ ভেজা অবস্থায় চুল সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় থাকে। তবে ভেজা চুল যদি আঁচড়াতেই হয় তবে খুব চওড়া চিরুনি ব্যবহার করা উচিত। এছাড়াও চুলে জট লেগে গেলে তা আঙুল দিয়ে ছাড়ানো উচিত। চিরুনি দিয়ে জোর করে নয়।

চুল শুকাতে হেয়ার ড্রায়ার পরিত্যাগ করুন

চুল শুকাতে হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করা খুবই ক্ষতিকারক একটি কাজ। কর্মজীবী মহিলারা সাধারণত দ্রুত চুল শুকাতে এই যন্ত্রের ব্যবহার করেন। তবে চুল দ্রুত শুকালে চুলের প্রোটিনগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। এছাড়াও চুল বার বার ভেজালে ও বার বার শুকালেও চুলের ওপর খারাপ প্রভাব পড়ে। তাই চুল যতটা সম্ভব স্বাভাবিক ভাবে শুকানোই শ্রেয়।

অ্যালকোহল ও কেমিক্যাল পরিত্যাগ করুন

অ্যালকোহলের জন্য চুল পড়া তেমন শোনা না গেলেও একে অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশেষত অ্যালকোহল চুলের বৃদ্ধিতে বাধা প্রদান করে। তাই হটাৎ করে চুল পড়া শুরু হলে যত দ্রুত সম্ভব অ্যালকোহলের অভ্যাস ত্যাগ করা উচিত। এছাড়াও অনেকে চুলে রঙ করে থাকেন। এক্ষেত্রে খুবই সাবধানী হওয়া উচিত কারণ আপনার মাথার ত্বক ও চুল রঙের সাথে না মানিয়ে নিতে পারলে চুলের স্বাস্থ্যে খুব বাজে প্রভাব পড়তে পারে।

প্রাকৃতিক বস্তু ব্যবহার করুন

  • মেথিঃ চুলকে স্বাস্থ্যকর করে তোলার পেছনে রাসায়নিক বস্তুর চেয়ে প্রাকৃতিক বস্তুই বেশি নির্ভরযোগ্য। যেমন মেথি। সাধারণত মেথি তেলের সাথেই ব্যবহার করা হয়। আধা কাপ নারিকেল তেলে ১ চা চামচ পরিমাণ মেথি দিয়ে কয়েক মিনিট জ্বালিয়ে নিন। এরপর ঠান্ডা মিশ্রণটি চুলের গোড়ায় মাখিয়ে দিয়ে ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করুন। অতঃপর শ্যাম্পু ব্যবহার করে ধুয়ে ফেলুন।
  • অ্যালোভেরাঃ মেথির মতো অ্যালোভেরাও বহুল প্রচলিত। কাচা বাঁজার থেকে সুপার শপ সব স্থানেই পাবেন অ্যালোভেরা। অ্যালোভেরা পাতা থেকে অ্যালোভেরা জেল সংগ্রহ করে সম্পূর্ণ চুলে লাগিয়ে রাখুন। ২০ মিনিট পরেই ধুয়ে ফেলতে পারেন শ্যাম্পু দিয়ে।
  • মেহেদি ও সরিষার তেলঃ অনেকের পছন্দের তালিকায় মেহেদি ও সরিষার তেলও রয়েছে। মেহেদি অনেকেই বেটে মাথায় দেয়। তবে চাইলে এই মেহেদিকে সরিষার তেলের সাথে ফুটিয়ে ব্যবহার করা যায়। ২৫০ মিলিলিটার সরিষার তেলে ১৮-২২টি মেহেদি পাতা দিয়ে ফুটান। ঠান্ডা হলে চুলে প্রয়োগ করতে পারেন।
  • পেঁয়াজের রসঃ তেলের পাশাপাশি আরেকটি ভাল উপায় হলো পেঁয়াজের রস। পেঁয়াজ ঠিক কিভাবে চুলের উপকার করে তা এখনো পরিষ্কার না হলেও গবেষকরা মনে করেন পেঁয়াজের সালফার জাতীয় পদার্থ এর পেছনে দায়ী। তবে ২০১৪ সালের একটি ছোট গবেষণায় দেখা গেছে শতকরা ৮৭ ভাগ লোকের মাথায় পেঁয়াজের রস ব্যবহারের ফলে উপকার হয়।

এর বাইরেও আরো নানা ধরনের ভেষজ চিকিৎসা রয়েছে। যেমন ডিম ও মধুর মিশ্রণ, নানা ধরনের হেয়ার প্যাক থেকে শুরু করে নানা কিছু। তবে মনে রাখতে হবে যে সকলের চুল এক রকম নয়। তাই সকলের চুলে একই পদ্ধতি ভাল ফলাফল দেবে না। বিশেষত রাসায়নিক যেকোনো কিছু ব্যবহারের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্চণীয়।

নিচের ভিডিওটি থেকে জেনে নিন চুল পড়া বন্ধ করার উপায় সম্পর্কে ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির এর কিছু পরামর্শঃ

শেষকথা

শরীরের প্রতিটি অংশই গুরুত্বপূর্ণ। চুলও তেমনই আমাদের শরীর ও জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর এর মূল্য আরো গূড় ভাবে অনুধাবন করেন তারাই যারা এর অভাব বোধ করছেন। তাই চুলকে স্বাস্থ্যবান রাখতে আগে থেকেই গড়ে তুলতে হবে খাদ্যাভাস, মেনে চলতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। সঠিক উপায়ে চললে বয়স হওয়ার পরেও হয়তো আপনার চুল থাকবে সুন্দর। যা আপনাকে করে তুলবে অনেকটাই উজ্জ্বল।

অনবরত জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

১) চুলে কলপ দিলে চুলের ক্ষতি হবে কি?

উত্তরঃ মনে রাখতে হবে কলপও এক ধরনের রঙ। যদিও কালো রঙ হিসেবে এর ব্যবহার সোনালি, বেগুনি, লাল ইত্যাদি রঙের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু এটি রাসায়নিক পদার্থ বিধায় আর দশটি রঙের মতই একে সাবধানতার সাথে ব্যবহার করতে হবে। নিতান্তই ব্যবহার করতে হলে ভালো কোম্পানির কলপ ব্যবহার করুন।

২) আমার হটাৎ অনেক দ্রুত চুল পড়ছে, কি করণীয়? 

উত্তরঃ হটাৎ চুল পড়া অনেক বেড়ে গেলে তা হয়তো কোনো নির্দিষ্ট কারণে হচ্ছে। অস্বাভাবিক হারে চুল পড়লে আপনার সম্পূর্ণ মেডিকেল হিস্ট্রি সহ ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ নিন।

৩) আমার একজন পরিচিত চুলে রাসায়নিক ব্যবহার করে অনেক ভাল ফল পেয়েছে। আমিও কি একই পদ্ধতি অনুসরণ করবো?

উত্তরঃ অবশ্যই না। একেক জনের চুল একেক রকম। যা তার চুলের সাথে মানানসই তা আপনার সাথে নাও হতে পারে। যেকোনো কৃত্রিম পদার্থ ব্যবহারের আগে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।

৪) হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করা খারাপ। কিন্তু আমার চুল অনেক লম্বা এবং শুকাতে অনেক সময় লাগে। এক্ষেত্রে কি করতে পারি?

উত্তরঃ লম্বা চুলের একটি বড় সমস্যা হলো চুল শুকাতে বেশি সময় লাগা। এক্ষেত্রে চুল ফাকা করে রোদ পোহানোটাই সেরা উপায়। হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করলে চুল এমনিতে পড়ে যাবে। তার থেকে চুল ছোট করে ফেলাই ভাল।

৫) বর্ষা কালে কি চুলের অতিরিক্ত যত্ন প্রয়োজন?

উত্তরঃ হ্যাঁ। বর্ষা কালে চুলে তেল দেওয়ার ব্যাপারে নিয়মিত থাকুন। এছাড়াও চুল বৃষ্টির পানিতে ভিজলে অবশ্যই গোসল করতে ভুলবেন না।

রিলেটেড আর্টিকেল গুলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button